প্রণবকান্তি দেব

১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:৩২

এমন বিরহী বৈশাখ আর আসেনি বাঙালির জীবনে

বুকের ভেতর এক আচানক ধুকপুক নিয়েই ডুবে গেল বছরের শেষ সূর্যটা। শেষ বিকেলটা হারিয়েই গেলো একেবারেই কোনো কোলাহল বিহীন। পড়ন্ত আলোর রোশনাইটুকু টুক টুক করে নিভে গেল একেবারে কোনো আয়োজন, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই...বসন্তের শেষ বিকেলটা এতো উদ্যমহীন, এতো চুপচাপ, এতো খালি খালি কেটে গেল- অবিশ্বাস্য লাগে!

এই চৈতী রাত পেরুলেই নতুন একটা বছর। প্রথম সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই বাঙালির সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে আবেগের, বাঙাল মন-মনন-চিন্তা'র সবচেয়ে কাছের উৎসব বাংলা বর্ষবরণ। অথচ কী সুনসান নীরবতা চারদিকজুড়ে! করোনা খেয়েছে উৎসবের সকল রঙ। মিলনের উৎসব কই, সবখানে একই কথা 'দূরে থাকুন'। স্বাধীনতার পরে এমন এমন বিরহী বৈশাখ আর আসেনি বাঙালির জীবনে। এতো ধূসর, হাহাকার জড়ানো বৈশাখ দেখেনি কেউ।

বর্ষবরণই তো একমাত্র উৎসব আমাদের, যেখানে ভেদাভেদহীন শেকড়ের সন্ধান পাওয়া যায়, বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর কৃষ্টির কাছে ফেরা যায়। নববর্ষই তো আমাদের নিয়ে যায় বাঙালি চেতনার মূল সড়কে, আমাদের চিত্তকে শাণিত করে অসাম্প্রদায়িক উদারচিন্তার মন্ত্রে। কিন্তু ১৪২৭ বঙ্গাব্দ এলো ভিন্ন, অচেনা এক প্রেক্ষাপটে। এ প্রেক্ষাপট আমাদের বহু বার্তা দিয়ে যায়...

আজ এই যে আমাদের ছায়ানট নিস্তব্ধ, রমনার বটমূলে কেবল বিরান পাতাদের অশ্রুপাত, চারুকলায় আছড়ে পড়া বোবাকান্না, লাল-সাদা রঙ জুড়ে শঙ্কার উঁকিঝুঁকি, এই যে আজ আমাদের এই শহরের বুকজুড়ে কোনো উত্তাপ নেই, চাঁদনীঘাট, সংস্কৃত কলেজ মাঠ কিংবা মুরারীচাঁদের সবুজ আঙ্গিনায় খাঁ খাঁ শূন্যতা, কোথাও বেড়ানোর প্রস্তুতি নেই, সাজগোজ নেই, কোথা হতেও ভেসে আসবে না একতারার সুর কিংবা ঢোলের বাজনা, বৈশাখী মেলার খৈ, মোয়া থেকে ভেসে আসবে না কাঁচা গুড়ের গন্ধ, পান্তা-ইলিশ, অথবা মাটির সানকির কোনো আমন্ত্রণ পাবে না কেউ, সবাই থাকবে দূরত্বে, নিরাপদ দূরত্বে- একেবারে অচেনা এই বৈশাখ এবার আমাদের।

মিলনের আশায় চিরকাল উদগ্রীব থাকা এই বাঙালি এখন ঘরবন্দি, মুখোমুখি এক ভয়াবহতার। করোনার বিভীষিকায় পর্যুদস্ত মানুষ এখন। উৎসবের আনন্দের চেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার আরাধনায় ব্যস্ত এখন আমাদের জনপদগুলো। বৈশাখ এসেছে সেই অভাবগ্রস্ত, শঙ্কিত, বিপন্ন মানুষের মাঝে। ত্রাণ কেড়ে নিতে বাধ্য হওয়া, কেবল চাকুরীটা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পথচলা ক্ষুধার্ত, দুঃখী, বঞ্চিত মানুষের ঘরে এবারের বৈশাখ তাই আনন্দহীন, ফিকে।

আমরা যদি অন্য চোখে দেখি, নববর্ষকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির চাকায় যে গতি আসতো, এবার সেটা তলিয়ে গেল। হালখাতা খুলবে কী? কৃষকের দেনার কী হবে? জানি এ ধাক্কাগুলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে বয়ে বেড়াতে হবে আগামী দিনগুলোতে। আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ডিজিটাল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে টুকটাক পয়লা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করেছে কিন্তু এই উৎসবপ্রিয়, ধুলো-কাদা-জল গায়ে মেখে পথ চলা কোটি বাঙালির তৃষ্ণা কী তাতে মিটবে? এ বড়ো জটিল সমীকরণ!

আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের পথে, আমাদের জাতীয় চিন্তা, মননচর্চার ক্ষেত্রে এ ধাক্কা কতটুকু প্রভাব ফেলবে-সেটাও ভাবনায় আসে। চলতি জীবনের বাঁকে বাঁকে এবারের পয়লা বৈশাখ কী ক্ষণে ক্ষণে পথে এসে দাঁড়াবে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে?

নতুন বছর যে নানা টানাপড়েন নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য তা তো আঁচ করাই যাচ্ছে। যতই বলি, 'শুভ নববর্ষ', ভেতরে অতৃপ্তি তবু থেকেই যাবে। কেননা, সর্বগ্রাসী করোনা আমাদের ভাবনার ছায়াপথে ইতোমধ্যে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। ভয় হয়, মানুষ কী ভুলে যাবে তবে তাঁর চিরন্তন স্বভাব, মানুষ কী আর হাত বাড়িয়ে দেবে না? প্রবোধ দেই-হৃদয় বাড়িয়ে দেবে হয়তো।

এই করোনা কালের পয়লা বৈশাখ আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে যাবে? যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি জাতির সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক আয়োজন যে বার্তা নিয়ে আসতো বছর ঘুরে এবার সেটি কী বার্তা নিয়ে এলো?

মানুষ হও, মানবিক হও। মানুষই আনন্দ, মানুষই উৎসবের অন্য নাম।

প্রণবকান্তি দেব: লেখক, শিক্ষক, সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত