মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

০৫ মে, ২০২০ ২২:৩০

সংসদীয় রাজনীতির কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির এক কিংবদন্তি পুরুষ। স্বাধিকার, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের উন্মেষ ও বিকাশে গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সবসময় ছিলেন সামনের কাতারে। ভাটিবাংলার অবিসংবাদিত এই নেতা ছিলেন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির এক নির্ভীক কণ্ঠ।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৫ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতির মধ্য দিয়ে। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ তিনি সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় সংসদের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে কিছু দিন আইন পেশায়ও যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই টুকরা হলে মওলানা ভাসানীকে ত্যাগ করে সুরঞ্জিত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। পরে ন্যাপের ভাঙনের পর গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১- এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন।

পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই - শাল্লা আসনে সামান্য ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের একটি আসনে উপ-নির্বাচন করে বিজয়ী হন।পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান। এসময় সংবিধান সংশোধনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি নবগঠিত রেল মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এক বছরের মাথায় ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে মন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। অবশ্য এই সরকারের শেষ মেয়াদ পর্যন্ত অবশ্য তিনি দপ্তর বিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৭১ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷ পরেরদিন ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জে তাঁর মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জন্মস্থান দিরাইয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বভাবসুলভ রসবোধ আর যুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতায় তিনি পৌঁছেছিলেন অনন্য উচ্চতায়।তিনি ছিলেন সত্যিকারের মাটি ও মানুষের নেতা।মানুষের মনের ভাষা তিনি পড়তে পারতেন। মানুষকে উজ্জীবিত করাই ছিল যেন তাঁর প্রশান্তি। রাজনৈতিক সকল সংকটে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি প্রথাবিরোধী হুংকার দিতেন আপন মহিমায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের যোদ্ধা এবং সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। সাত বারের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন ও গণতন্ত্র বিকাশে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ।

বিজ্ঞাপন

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন পড়াশোনা করা রাজনীতিবিদ। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এই নন্দিত পার্লামেন্টারিয়ানের সাহিত্য,সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। বক্তব্য,বিবৃতিতে তিনি প্রায়শই কবিতার পঙক্তি ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষা রপ্ত করা,সাহিত্যের রসবোধ আর প্রখর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জননেতা ছিলেন তিনি। তেজ ও নাটকীয়তায় ভরা বক্তব্যে তিনি সংসদ থেকে জনসভা সর্বত্র মুগ্ধতা ছড়াতেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্র আর উল্টোস্রোতে সাঁতার কেটে হয়ে উঠেছিলেন একজন সংগ্রামী। স্বভাবসুলভ বিপ্লবী। অমিত সাহস নিয়ে কথা বলতেন যুক্তিপূর্ণ মুক্তচিন্তায়। হাস্যরসাত্মক ভাবে সহজ ভাষায় কঠিন আক্রমণ করতেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো তারকা। মাটি আর মানুষের কাছে থেকে রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং কর্মী বান্ধব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় উঠেছিলেন রাজনীতির বরপুত্র এবং ভাটি অঞ্চলের সিংহ পুরুষ। নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি জননেতা । জাতীয় সংসদে,সংবাদ সম্মেলনে, রাজনৈতিক জনসভায় তিনি কথা বললে জনতা হাসতেন, কাঁদতেন, জাগতেন। সজ্জন, সদালাপী ব্যক্তি সুরঞ্জিত ছিলেন সব দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বরেণ্য রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের প্রয়োজনীয়তা যতদিন যাচ্ছে তত যেন আরও বাড়ছে। তাঁর অনুপস্থিতি দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তৈরি করেছে গভীর শূন্যতা। রাজনীতির কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭৫ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। জয়তু জনতার নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা : সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত