হৃদয় দাশ শুভ, টিএসসি থেকে

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ২০:২৬

‘আজ মৌলবাদীদের দাপট সর্বত্র’

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাবাহী মুক্তিযোদ্ধা ইদু

আমরা যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম বর্তমানে সেই চেতনা থেকে আমরা অনেকটাই সরে এসেছি। আজ মৌলবাদীদের দাপট সর্বত্র। আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই সেই অসাম্প্রদায়িকতা থেকে অনেকটাই সরে এসেছি।

সিলেটটুডের প্রতিবেদকের সাথে কথোপকথন কালে অনেকটা আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বলছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাবাহী মুক্তিযোদ্ধা মহিবুল ইসলাম ইদু।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের এক তারিখে যখন পাকিস্তানি সরকার নির্বাচিত সংসদ ভেঙ্গে দেয় তখন স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। সেই সময়কার পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পাশাপাশি ঘোষণা দিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা কোথাও প্রদর্শন বা বহন করা যাবে না। এমনকি যারা পতাকা বহন বা প্রদর্শন করবে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

সেই ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পরে ছাত্ররা সর্বদলীয়  ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবে। সেই ঘোষনামত পরদিন ২ মার্চ তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব কলা ভবনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। আর তৎকালীন স্বৈরশাসক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই পতাকা মালিবাগের গুলবাগ থেকে প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে বহন করে কলাভবনে নিয়ে আসেন মহিবুল ইসলাম ইদু।

সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবসের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি চত্বরে তার সাথে দেখা হয় সিলেটটুডের প্রতিবেদকের। এসময় গল্পে গল্পে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অনেক কথাই বলেন তিনি।

তৎকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে মহিবুল ইসলাম ইদু বলেন, ‘আমি যখন মিছিল সহকারে পতাকা বহন করে নিয়ে আসছিলাম তখন পথে রমনা পার্কের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের সামনে আমাদের মিছিলকে সেনাবাহিনী আটকে দেয়, কিন্তু আমাদের সাথে মানুষের এতবেশী উপস্থিতি ছিলো যে সেনারা পিছু হটে আমাদের পথ করে যেতে দিতে বাধ্য হয়।

তিনি বলেন, ‘গুলবাগ থেকে মিছিল শুরু করার পর থেকে দলে দলে মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিতে থাকে। মুক্তিপাগল মানুষ তখন স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে ছিলো আর সেজন্যই পতাকা দেখে তারা আবেগ তাড়িত হয়ে পরে সেজন্য শাসকের বন্দুকের মুখেও তারা ভীত হয়নি।’

এই হাজার হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে যাই সেখানে ডাকসুর ভিপি হাজার হাজার মানুষের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বলেও জানান তিনি।

বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা বহনকারী মহিবল ইসলাম ইদু আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আমরা যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম সেই চেতনা থেকে আমরা অনেকটাই সরে এসেছি। মৌলবাদীদের দাপট আজ সর্বত্র। আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা সেই অসাম্প্রদায়িকতা থেকে অনেকটাই সরে এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘৭৫ থেকে ৮০ এর দশক পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস পরিবেশন করা হয়েছে যে কারণে ওই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছানো যায়নি।

তবে বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখনকার তরুণদের হাতে হাতে এন্ড্রয়েড স্মার্টফোন তারা চাইলেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস টা জানতে পারবে। আর বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানতে অনেক আগ্রহী এটাও আমাকে আশাবাদী করছে।

মুহিবুল ইসলাম ইদু মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, তিনি যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠকও। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুহিবুল ইসলাম ইদু ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত ছিলেন। সে সময় তিনি ঢাবির সেক্টর ২-এ মুক্তিযুদ্ধ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন। তার বাড়ী রাজধানীর মালিবাগ গুলবাগে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানান সময় পালিয়ে বেড়াতে হয়, এমনকি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেও পারতেন না কাউকে।

বর্তমানে এ মুক্তিযোদ্ধা “আমরা মানুষ” নামে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটা সামাজিক সংগঠন চালাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনান। ঢাকা শহরে ৫০টি স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে যুদ্ধের গল্প শোনানো হয়। এছাড়াও দেশের ৩৫টি জেলার বিভিন্ন স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শিক্ষার্থীরকে যুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, এটির লক্ষ্য নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও চেতনা বিকশিত করা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত