আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৪ মে, ২০২০ ১৯:০৫

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এক সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা

২০ জানুয়ারি। চীনে ছড়িয়ে পড়া বিপজ্জনক এক নতুন ভাইরাসের খবর অনলাইনে পড়ে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট এক অধীনস্থ সহকর্মীকে ফোন করলেন ভারতের কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা। জানতে চাইলেন, ‘ভাইরাসটি কি আমাদের দেশেও আসবে?’ জবাব পেলেন, ‘অবশ্যই আসবে, ম্যাডাম!’ আর তখনই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি।

চার মাস পর, সারা দুনিয়া যেখানে ভাইরাসটির দাপটে কাঁপছে, সেখানে এ পর্যন্ত মাত্র ৫২৪ জন আক্রান্ত ও ৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে কেরালায়। এমনকি এখনো সামাজিক সংক্রমণও শুরু হয়নি রাজ্যটিতে।

কেরালার প্রায় সাড়ে তিন কোটি নাগরিকের বসবাস। মাথাপিছু আয় মাত্র ২ হাজার ২০০ পাউন্ড। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা এর দ্বিগুণ, এবং মাথা পিছু আয় ৪০ হাজার ৪০০ পাউন্ড; আর সেখানে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে। আবার, কেরালার চেয়ে দশ গুণ জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ৫১ হাজার পাউন্ড; সেখানে এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে মারা গেছেন ৮২ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের মারাত্মক সামাজিক সংক্রমণ ঘটে গেছে।

বিজ্ঞাপন

৬৩ বছর বয়সী মন্ত্রী কে কে শৈলজাকে ইতোমধ্যেই 'করোনাভাইরাসের ঘাতক ও রকস্টার স্বাস্থ্যমন্ত্রী' নামে ডাকতে শুরু করেছেন অনেকে। হাসিখুশি, চশমা পরা, উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই বিজ্ঞান শিক্ষিকার সঙ্গে এমন উপাধি আপাতদৃষ্টিতে একটু বেমানান মনে হলেও, এমন স্বল্প আয়ের ছোট্ট একটি রাজ্যে তিনি যেভাবে বৈশ্বিক মহামারিটিকে সামলাচ্ছেন, তা একইসঙ্গে বিস্ময়কর ও অনুসরণীয়। খবর গার্ডিয়ান ও বিবিসির।

চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবরটি পড়ার তিনদিন পর এবং কেরালায় প্রথম কোনো কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার আগেই, নিজের টিমের সঙ্গে একের পর এক মিটিং করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা। ২৪ জানুয়ারি সেই টিম একটি কন্ট্রোল রুম প্রতিষ্ঠা করে এবং রাজ্যের ১৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই নিজেদের পর্যায় থেকে একই কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয় চিকিৎসা কর্মকর্তাদের।

এরইমধ্যে, ২৭ জানুয়ারি চীনের উহান থেকে আসা একটি বিমানের যাত্রীদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাবলি মেনে পরীক্ষার সময় প্রথম কোনো কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সেটি শুধু কেরালাই নয়, সমগ্র ভারতেই শনাক্ত হওয়া প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী। ততদিনে এই পরিস্থিতি সামলানোর প্রস্তুতি ভালোভাবেই নেওয়া হয়ে গেছে কেরালার।

এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে কে কে শৈলজা বলেছিলেন, যখনই এই ভাইরাসের কথা শোনা যায়, তখন থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ২০১৮ সালে আরেক ভাইরাস 'নিপাহ' আমাদের রাজ্যে ছড়িয়েছিল। ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল তখন।

বিজ্ঞাপন

সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই এবার আমরা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, কীভাবে করোনার মোকাবেলা করা হবে। তাই জানুয়ারির শেষদিকে যখন প্রথম বিমানটি উহানে আটকে পড়া কেরালাবাসীদের নিয়ে এখানে নামল, আমরা প্রস্তুত হয়েই ছিলাম।

তখন বিমানবন্দরেই প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপা হয়। যাদের সামান্য উপসর্গও দেখা গেছে, তাদেরই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ওই বিমানেই এসেছিলেন উহানে মেডিকেল পড়তে যাওয়া এক ছাত্র। তিনিই ছিলেন ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি।

এরপর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে, ইতালির ভেনিস থেকে দেশে ফেরা এক মালায়ালি পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দরে শৈলজার অতন্দ্র নজরদারীকারী টিমের চোখ ফাঁকি দিয়ে, ভ্রমণের ইতিহাস গোপন করে বাড়ি চলে যায়। যে মুহূর্তেই চিকিৎসাকর্মীরা তাদের মধ্যে একজনের করোনাভাইরাস আক্রান্ত থাকার বিষয়টি ধরতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়েন তাদের খোঁজে। কিন্তু তাদের ঠিকানা ঠিক ছিল না। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় তাদের। সন্ধান চেয়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞাপন। প্রচার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অবশেষে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। ততদিনে তাদের ৬ জন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। তাদের রাখা হয় কোয়ারেন্টিনে।

উপমহাসগরীয় দেশগুলো থেকে শ্রমিকরা দেশে ফিরতে শুরু করলে কেরালার ওপর আরেকটি ধকল আসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে ২৩ মার্চ রাজ্যটি চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশজুড়ে লকডাউন জারি করার দুই দিন আগের ঘটনা। এতেও শৈলজার দূরদর্শিতা টের পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

কেরালা যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকির মুখে, তখন ১ লাখ ৭০ হাজার অধিবাসীকে কোয়ারিন্টিনে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে কঠোর নজরদারি করতে থাকেন। যেসব নাগরিকের বাড়ির ভেতরে বাথরুম নেই, তাদের রাজ্য সরকারের খরচে এক অভিনব আইসোলেশন ইউনিটে রাখা হয়। এভাবে কোয়ারেন্টিনে থাকা নাগরিকের সংখ্যা নামিয়ে আনা হয় ২১ হাজারে।

দ্য গার্ডিয়ানকে শৈলজা বলেন, 'লকডাউনের সময় কেরালায় আটকা পড়া প্রতিবেশি রাজ্যগুলোর দেড় লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আমরা করেছি। ছয় সপ্তাহ ধরে দিনে তিন বেলা খাবার দিয়েছি তাদের।' ওই শ্রমিকদের পরে বিশেষ ট্রেনে নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শৈলজার এমন দূরদর্শিতার নজির এটিই প্রথম নয়। করোনাভাইরাসের আগে থেকেই ভারতে তিনি রীতিমতো তারকা। ২০১৮ সালে 'নিপাহ' ভাইরাসের আক্রমণ তিনি যেভাবে সামলিয়েছেন, সেই ঘটনার অনুপ্রেরণায় গত বছর দেশটিতে 'ভাইরাস' নামে একটি সিনেমাও মুক্তি পেয়েছে। শুধু কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই নয়, বরং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও সশরীরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখার জন্যও সুনাম রয়েছে তার।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তার নেওয়া প্রস্তুতিগুলোর একটি ছিল, রাজ্যের প্রতিটি জেলায় আগে-ভাগেই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দুটি করে ডেডিকেটেড হাসপাতাল এবং প্রতিটি মেডিকেল কলেজে ৫০০টি করে বেড প্রস্তুত রাখা।

শৈলজা বলেন, তার রাজ্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বড় একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে জনগণ। এ রাজ্যে স্বাক্ষরতার হার যথেষ্ট ভালো হওয়ায় জনগণকে বোঝানো সহজ হয়েছে। তিনি বলেন, কেন বাড়ি থাকতে হবে, লোকে তা ভালোভাবেই বোঝেন। তাদের বোঝানো সহজ।

দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ভারত সরকার ১৭ মে লকডাউন তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কে কে শৈলজার অনুমান, এর পর করোনাভাইরাসে মারাত্মক আক্রান্ত উপমহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী কেরালার ফিরবেন। তিনি বলেন, 'জানি এটি অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে; তবে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।'

পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে ইতোমধ্যেই 'প্ল্যান-এ', 'প্ল্যান-বি' ও 'প্ল্যান-সি' করে রেখেছেন তিনি। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আবাসিক হোটেল ও কনফারেন্স সেন্টার রিকুইজিশন করে ১ লাখ ৬৫ হাজার বেড প্রস্তুত থাকবে। যদি ৫ হাজারেরও বেশি ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তাদের অবশ্য মুশকিলে পড়ে যেতে হবে; তবে ইতোমধ্যেই আরও ভেন্টিলেটরের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তবে বড় সংকট হবে জনবল; বিশেষ করে, কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের প্রশ্নে। তিনি বলেন, 'এজন্য আমরা ইতোমধ্যেই স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।'

বলে রাখা ভালো, কেরালায় পরিস্থিতি সারা দুনিয়ার জন্য উদাহরণস্বরূপ হলেও ভারতকে করোনাভাইরাসে বেশ ভুগতে হচ্ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৮১০। এরমধ্যে মারা গেছেন ২ হাজার ৫৬৪ জন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত