হাসান মোরশেদ

১১ অক্টোবর, ২০১৫ ১৯:৫৩

দাসপার্টির খোঁজে খসড়া পর্ব: ১১

২০ জুন ২০১৫। রমজানের দ্বিতীয় দিন।

সকাল সাতটার দিকে আমরা কাকেলছেও গ্রামের নদীর ঘাটে। ইলিয়াস পড়েছেন গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ইউনিফর্ম পায়ে বুট মাথায় ক্যাপ। জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোষাক এটি। ইলিয়াস তার সবথেকে বেদনাবিধুর যুদ্ধক্ষেত্রে আজ ফিরে যাবেন প্রায় ৪৪ বছর পর যোদ্ধার সাজে।

আমাদের আজকের পরিকল্পনায় জগতজ্যোতি দাসের গ্রাম জলসুখা। না তার পরিবারের কেউ সেখানে নেই এখন আর, ভিটে বিক্রী হয়ে গেছে। আমরা যাবো তার ছোটবেলা বন্ধু ও যুদ্ধদিনের সহযোদ্ধা আব্দুর রশিদের সাথে দেখা করতে, যে জায়গা দিয়ে তার লাশ রাজাকারেরা নিয়ে এসেছিলো প্রদর্শনের জন্য সেই জায়গাটা দেখা। তারপর জগতজ্যোতি দাসের শেষযুদ্ধের স্থান খৈয়াগোপির বিল, সম্ভব হলে পাহাড়পুর এবং অবশ্যই মাকালকান্দি।

এবার আমাদের নৌকা চলছে উজানে, কাকেলছেও থেকে আজমিরীগঞ্জের দিকে। এখনো রোদ উঠেনি তেমনভাবে, ছায়া ছায়া ভেজা ভেজা ভাব, আকাশে মেঘ আছে, নদী ও বিশাল। গতকাল সারাদিন যে জায়গাগুলো ঘুরেছি সেগুলো ক্রমশঃ পেছনে সরে যাচ্ছে।

এ জীবনে হয়তো আর কোনদিন এসব জায়গায় আসা হবেনা। ইলিয়াস চোখ বুজে বিশ্রাম নেন। নজরুল ও তানিম সিনেমার গল্প করে। দাসপার্টি নিয়ে সিনেমা করতেই হবে, কোথায় কোথায় শ্যুট করা যেতে পারে- দৃশ্যায়ন কেমন হবে, চরিত্রগুলো কেমন বাছাই করতে হবে এইসব গল্প করে তারা- আমি শুনি।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর হাতের ডানে আজমিরীগঞ্জ বাজার পেরোয় আমাদের নৌকা। আজমিরীগঞ্জ নামতে পারলে ঐ জায়গাটা দেখা যেতে পারতো যেখানে জগতজ্যোতির ক্ষতবিক্ষত শরীর বেঁধে রাখা হয়েছিলো প্রদর্শনীর জন্য। ইলিয়াসের সাথে কথা বলি কিন্তু তিনি বলেন আজমিরী বাজারে যেতে হলে ঘুরে যেতে হবে, সে ক্ষেত্রে পরবর্তী গন্তবব্যগুলোতে দেরী হয়ে যাবে। দুদিন আগে সন্ধ্যাবেলা আমরা আজমিরীগঞ্জ বাজারে পৌঁছেছিলাম। প্রায় অন্ধকারে দেখেছিলাম ‘মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’ নামে একটা ভবন উঠছে। ইলিয়াস জানান এর কাছাকাছিই ছিলো সেই খুঁটি যেখানে যীশুর মতো বিদ্ধ হয়েছিলেন জ্যোতি। একজন মিথ, আরেকজন আমাদের খাঁটি করুণ বাস্তবতা।

আজমিরী থেকে আরো বেশ কিছু সময় উজানে এগিয়ে আরেকটা ঘাঁটে থামে আমাদের নৌকা। পিরোজপুর। দুজন মধ্যবয়স্ক আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সেখানে, এরা স্থানীয় আনসার ভিডিপির সদস্য- ইলিয়াস তাদের বলে রেখেছিলেন। নদীর এই পাড় থেকে মাইল দুয়েক পায়ে হেঁটে আমাদের যেতে হবে। তারপর আরেকটা নদী খেয়া নৌকায় পাড় হয়ে যেতে হবে জলসুখা। রাস্তার অবস্থা এতোই খারাপ, আমাদের পায়ের জুতা খুলে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শুধু ক্যামেরা, খাবার পানির বোতল, কাঁধের গামছা ছাড়া বাকী সব আমর নৌকায় রেখে নামি। ইলিয়াস তার সামরিক বুট খুলেন না, ডায়াবেটিক আক্রান্ত শরীরের পায়ের নিরাপত্তা তার জরুরী। পরিকল্পনা হয় জলসুখা থেক আবার নৌকায় ফিরে তারপর যাবো খৈয়াগোপির দিকে।

এবার আমরা পা টিপে টিপে হাঁটা শুরু করি। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। এঁটেল মাটির রাস্তা। পা আটকে রাখতে চায়। এভাবেই এগোতে থাকি আমরা সতর্কপায়ে। এগোতে এগোতে দূরে জলসুখা গ্রাম দেখা যায়। আরো সামনে গিয়ে খেয়া নৌকায় উঠতে হবে। এসময় হঠাৎ করেই বামে একটা বাঁধের মতো কিছু চোখে পড়ে এবং আমাদের এগিয়ে নিতে আসা একজন ইলিয়াসকে বলেন ঐতো ঐদিকে খৈয়াগোপির বিল।

মুহুর্তটা নাটকীয়। আমাদের পরিকল্পনায় ছিলো জলসুখা থেকে ফিরে নৌকা নিয়ে ঐদিকে যাওয়া কিন্তু এইদিকে পায়ে চলা আরেকটা রাস্তার কথা শুনে- আমাদের সাথে কোন কথা না বলেই ইলিয়াস হাঁটা শুরু করেন। আমরা তাকে অনুসরন করি। ইলিয়াসের হাঁটার গতি বাড়তে থাকে। ষাটোর্ধ একটা মানুষ, যার শরীর ডায়াবেটিস আক্রান্ত, শরীরের তিনটে জায়গায় যুদ্ধের জখম- মানুষটা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দৌড়াতে থাকে। আমি, নজরুল, তানিম ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়ি। তানিম ইলিয়াসের ছুটে যাওয়া দৃশ্যবন্দী করতে থাকে। একটা সময় মনে হয় গাঢ় সবুজ পোষাক গায়ে মানুষটা বুঝি দিগন্তে হারিয়ে গেলো।

আমরা একটা ছোট্ট খাল, অনেকগুলো হাঁসের পাল, ডানে তেপান্তরের মতো একটা মাঠ তার ঐ পাড়ে জলসুখা গ্রাম রেখে যখন ইলিয়াসের পাশে দাঁড়াই তখন তিনি হাঁপাচ্ছেন। মানুষটা মাইল দেড়েক জায়গা প্রায় দৌড়ে এসেছে। এখানে নদীর বিশাল একটা বাঁক। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার বাম দিকে নদী চলে গেছে ভাটিতে আজমিরীগঞ্জ, কাকেলছেওর দিকে আমরা যেদিক থেকে এসেছি। আর ডানে বাঁক পেরিয়ে চলে গেছে মার্কুলী, শাল্লার দিকে।

একটু ধাতস্থ হলে পড়ে ইলিয়াস আমাদেরকে নিশানা দেখান। সেইসময় নদী আরেকটু উত্তরের দিকে সরানো ছিলো। নদীর পাড়, পাড়ের পর একটা বিল, নভেম্বর মাসে শুকনা ছিলো। জিয়াউর রহমানের আমলে খালকাটা কর্মসূচীর কারনে সেই বিলটা আর নেই -নদীর অংশ হয়ে গেছে।

ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত ইলিয়াসকে পানির বোতল এগিয়ে দেই, রোজা মুখে ইলিয়াস মাথায় মুখে পানি ঢালেন।নদীর পাড়ে প্রায় পা ডুবিয়ে বসি, তাকে ও বসাই। কিছুক্ষন পর বলি ‘ইলিয়াস ভাই এইবার ধীরে ধীরে সেই দিনের ঘটনাগুলো বলেন’ কয়েকটা নৌকায় তারা ৪২ জনের দল যাত্রা শুরু করেছিলেন খালিয়াজুরির কল্যানপুর থেকে। এই নদীপথ ধরে আজিমিরীগঞ্জ পেরিয়ে বাহুবল গিয়ে বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করা ছিলো তাদের মুল অপারেশন। মাঝখানে সুকুমার দাসের দলকে সহযোগীতা করার জন্য ঘুঙ্গিয়ারগাঁও- শাল্লায় তারা পাকিস্তান আর্মির সাথে গুলী বিনিময় করেছেন। ভোরবেলা সেদিক থেকে রওয়ানা দিয়ে নয়টার দিকে এসে পৌঁছেছেন বদলপুর ইউনিয়ন অফিসের সামনে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি নদীর বাঁকে, বদলপুর সেখান থেকে মাইল খানেক আগে। ইউনিয়ন অফিসের সামনে তাদের চোখে পড়ে রাজাকারদের কয়েকটি নৌকা, জেলেদের নৌকা আটকে চাঁদা তুলছে। এসময় একজন জেলে ইলিয়াসকে চিনতে পেরে অনুরোধ করেন- ‘ ও দাসবাবুর ভাই, আপনারা আমাদের বাঁচান’

রাজাকারদের নৌকা তারা আক্রমন করেন, কয়েকটা মারা যায় ঐখানেই। দুই নৌকা পালিয়ে আসতে থাকে এদিকে। জ্যোতি তখন বাকীদের ঐখানে অপেক্ষা করতে বারোজনকে নিয়ে ঐ দুই নৌকা তাড়া করেন। অন্যরা তার সাথে আসতে চাইলে ধমক দেন- কয়টা রাজাকার ধরার জন্য সবার আসার দরকার কী?
রাজাকাররা নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শুকনো বিল পেরিয়ে পালিয়ে যায় জলসুখার দিকে। জ্যোতি তার গ্রাম জলসুখার একেবারে কাছে এসে ও ফিরে যান। কাছাকাছি আরেক দালালের বাড়িতে এসময় তারা মর্টার চার্জ করেন।

এখান থেকে নদীতে রাখা নৌকায় ফিরে যাবার আগেই তারা চায়নিজ রাইফেলের গুলীর আওয়াজ শুনেন। রাজাকারেরা চায়নিজ রাইফেল পেতোনা, এদের থাকতো বন্দুক। চায়নিজ রাইফেল ছিলো শুধু পাকিস্তান আর্মির কাছে। নদীর পাড়ে যাবার আগে বিলের কাছে গিয়েই দেখেন একদিকে আজমিরীগঞ্জ, অপরদিকে শাল্লা ও মার্কুলির দিক থেকে গানবোট করে পাকিস্তান আর্মিরা এসে নদীর পাড়ে পজিশন নিচ্ছে। বদলপুরের দিকে ও গুলীর আওয়াজ। বুঝতে পারেন, ঐদিকে ও আক্রমন করেছে পাকিস্তান আর্মির আরেকদল আর তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে দুইদিক থেকে।
দুইদিক থেকেই এসে পাকিস্তান আর্মি পজিশন নেয় নদীর পাড়ে আর তারা বারো জন্য নদীরপাড় ও বিলের মাঝখানে। দূরত্বটা এতোই কাছাকাছি যে তারা জওয়ানদের পজিশন নেয়ার জন্য অফিসারদের দেয়া উর্দূ কমান্ড ও শুনছিলেন। শুরু হয় সামনাসামনি যুদ্ধ। ইলিয়াস ও জ্যোতি সামনের কলামে- দুজনের হাতেই মেশিন গান আর দু ইঞ্চি মর্টার- এরপর মতিউর, রশিদ, আইয়ুব আলী, বিনোদ বিহারী বৈষ্ণব, ধন মিয়া, কাজল, সুনীল, নীলু জ্যোতি সবাইকে উৎসাহ দেন- আজকে শালাদের জ্যান্ত ধরবো হাতেনাতে। দুপক্ষেই আক্রমন পালটা আক্রমন চলতে থাকে, বেলা বাড়তে থাকে। মাথার উপর দিয়ে কয়েকবার চক্কর দিয়ে যায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফগার। আইয়ূব আলীর মাথার পাশে গুলী লাগলে জ্যোতি তাকে আরো দুজন সহ পিছিয়ে বদলপুরের দিকে পাঠিয়ে দেন। এরপর আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

বদলপুরে অবস্থানরত মুল দলটি ও এদিকে এগিয়ে আসতে পারেনা তাদের সহযোগীতার জন্য, পাকবাহিনীর আরেকটি দল তাদেরকে ব্যস্ত রাখে উপুর্যপরি আক্রমনে।
ইলিয়াস এসময় জিজ্ঞেস করেন – ‘দাদা কী করবো?’
জ্যোতি নির্মোহভাবে বলেন- ‘তর যা খুশী কর’
কমাণ্ডার যেনো জানতেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। শেষযুদ্ধের ভার যেনো তিনি দিয়ে যান প্রিয় সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে। এদিকে গুলী ও ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসতে থাকে। বিনোদবিহারী সহ আরো দুজনকে তারা বদলপুর থেকে যে কোনভাবেই হোক গুলী নিয়ে আসতে পাঠান। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গুলী এসে লাগে ইলিয়াসের বুকের বাম পাশে। হাত দিয়ে দেখেন হৃদপিন্ড ভেদ না করে গুলী বেরিয়ে গেছে।
মাথার গামছা খুলে বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন- বাঁচবি?
ইলিয়াস জবাব দেন- বাঁচতে পারি।
জ্যোতি আবার বলেন- তাহলে যুদ্ধ কর।

বারো জন থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। তারপর আরো কমে শুধুমাত্র জগতজ্যোতি ও ইলিয়াস। এমনকি জ্যোতির এলএমজিতে গুলী সরবরাহকারী ও নেই তখন। এবার ইলিয়াস গুলী লোড করতে থাকেন আর আর জ্যোতি একশো গজ দূরে সারিবদ্ধ পাকিস্তান আর্মিকে টার্গেট করে গুলী করতে থাকেন। এর ফাঁকে দু ইঞ্চি মর্টারের গোলা ও ছুঁড়তে থাকেন তারা। বারো থেকে পনেরোজনের মতো পাক সেনা নিহত হয়।
মধ্য নভেম্বরে বিকেল দীর্ঘ নয়। মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলী। এর ভেতর বুদ্দিদীপ্ত কৌশলে লড়াই করতে করতে তারা আশাবাদী হন আর কিছুক্ষন টিকে থাকা গেলে, অন্ধকার হয়ে গেলেই এই ব্যুহ ভেদ করে তারা বেরিয়ে যাবেন।
হায়! সময় ঐ সময়টুকু দেয়নি সেদিন।

সন্ধ্যা হবার ঠিক আগে জ্যোতির মাথা বুলেট বিদ্ধ হয়। তার নিজের মাতৃভাষায় জগতজ্যোতি শুধু একটি বাক্য উচ্চারন করেন- ‘আমি যাইগ্যা’
২০১৫ সালের জুনের ২০ তারিখ। ৪৩ বছর ৪ মাস ২৬ দিন পর ঠিক সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় ইলিয়াস থরথরে আবেগে কাঁপতে থাকেন, তাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়।
‘ গলাকাটা মহিষ দেখছেন কোনদিন? কেমন ছটফট করে, দুনিয়া তামাম করে দিতে চায়! দাদার রক্তমাখা শরীর এমন ছটফট করে। আমি জড়ায়ে ধরি তারে ‘দাদা ও দাদা’। আমার দাদা একবার মাথা তুলে, মাথা পড়ে যায়। নাই , আমার দাদা নাই, দাদা নাই...’
সেইদিন বোধ হয় ইলিয়াস কাঁদতে পারেননি, কাঁদার সুযোগ ছিলোনা যোদ্ধার। আজ ৪৩ বছর পর স্বাধীন মাটিতে ইলিয়াস কাঁদেন, চিৎকার করে কাঁদেন তার দাদার জন্য- তার কমান্ডারের জন্য। এই কান্না বড় তীব্র, শোকার্ত, কুশিয়ারার প্রবাহমান স্রোতের চেয়ে ও অধিক আর্তনাদময়। সময় যেনো থমকে থাকে এই মুহুর্তে।




দীর্ঘ বড় দীর্ঘ মনে হয় এই থমকে থাকা সময়। অনেকক্ষন পর নিষ্ঠুরের মতো আমি তার ঘোর ভাঙ্গি।
‘তারপর কী হলো ইলিয়াস ভাই?’
সেই প্রায় আলো ফুরিয়ে আসা ঘাতক বিকেল বেলা ইলিয়াস তার কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদা পানির ভেতর যতোটুকু সম্ভব পুঁতে ফেলেন- যাতে শত্রুর হাতে এই শহীদের কোন অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজির সাথে হাতে তুলে নেন দলনেতার এলএমজি ও । তার বুকে বাঁধা গামছা ছুইয়ে রক্ত পড়ছে তখনো- গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে পেছনে ফেরতে থাকেন ইলিয়াস।
সন্ধ্যের মুখে বদলপুর গ্রামে যখন ঢোকেন সহযোদ্ধা আতাউর ও কাইয়ূম তার রক্ত ও কাঁদামাখা শরীর চিনতে না পেরে চ্যলেঞ্জ করেন। পরে তার গলা শুনে জিজ্ঞেস করেন ‘দাদা কোথায়? ‘ ইলিয়াস জবাব না দিয়ে বলেন তাড়াতাড়ি এখান থেকে নিরাপদ কোথাও যেতে হবে। গ্রামের ভেতর পিয়ারী বাবুর বাড়িতে তখন যুদ্ধক্লান্ত সহযোদ্ধারা সবাই ইলিয়াস ও জগতজ্যোতির অপেক্ষায়। পেছন থেকে তখনো তাড়া করে আসছে পাকিস্তানী মিলিটারী ও রাজাকারদের সম্মিলিত দল।

ইলিয়াস দ্রুত সবাইকে অবগত করেন ‘দাদা নাই’। শোকবিহবল সবাই ইলিয়াসের হাতে জ্যোতির এলএমজি দেখেই বুঝতে পারেন প্রিয় দলনেতা আর বেঁচে নেই। কিন্তু যুদ্ধের মাঠে শোকগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে আত্মরক্ষা জরুরী এই শিক্ষা ছিলো সেদিনের গনযোদ্ধাদের। এ ছাড়া সাতজন সহযোদ্ধা গুরুতর আহত। পায়ে গুলীবিদ্ধ গোপেন্দ্র দাস এর অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর। আবু লাল কে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, সম্ভবতঃ শত্রুরা জিবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নিয়ে গেছে তাকে। এ ছাড়া ভারী অস্ত্রসহ আরো চারজন খোঁজ।

রাতের অন্ধকারে পাক আর্মি ও রাজাকারদের দল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইছে এই বিধ্বস্ত, আহত, দলনেতাহীন দলটিকে। গুলী করতে করতে তারা এগিয়ে আসছে দ্রুত। নিখোঁজ পাঁচজনের জন্য আর অপেক্ষা না করে আহত সাতজন সহ বাকী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নৌকায় চড়ে বসেন। রাতের গভীর অন্ধকারে নৌকা চলতে থাকে হাওর থেকে হাওরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পাক আর্মি ও ও রাজাকারদের টহল দল ও নৌকা নিয়ে হাওরে হাওরে খুঁজতে বের হয় ক্লান্ত যোদ্ধাদের ধরতে।

ক্রমাগত রক্তক্ষরন হতে হতে নৌকাতেই মারা যান গোপী। প্রথমে আড়িয়ামুগুর, তারপর কুঁড়িবলনপুরের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছায় দুঃস্বপ্নের মতো একটা ভয়ংকর যুদ্ধদিন কাটিয়ে আসা দলটি।
‘গোপেন্দ্র দাস এর লাশ তাহলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন?’

ইলিয়াস মাথা নাড়েন। না, লাশ ফেলে দেয়া হয়েছিলো হাওরের পানিতে। ভয়ংকর যুদ্ধের রাতে, যখন শত্রুরা প্রবল উদ্যমে খুঁজে বেড়াচ্ছে হতোদ্যম ক্লান্ত একটা যোদ্ধাদলকে যারা মোটামুটি নিশ্চিত এই অন্ধকার রাত আর ফুরাবেনা, নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা হবেনা তখন নিহত সহযোদ্ধার লাশ বোধ হয় হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া যায়। এটাই যুদ্ধ, যুদ্ধ মানেই অস্বাভাবিকতা। ইলিয়াস তার দাদার লাশ না আনলে ও এলএমজিটা নিয়ে এসেছিলেন। এটাই যুদ্ধ, এটাই যুদ্ধের প্রশিক্ষন।

আরো বেশ কিছুক্ষন পর ইলিয়াস কিছুটা সুস্থির হলে আমরা ফিরতি পথ ধরি। এবার আগের মতো অতো জোরে, প্রায় দৌড়ে নয় ইলিয়াস হাঁটেন ধীর পায়ে। বুঝি, স্মৃতির আঘাত ও আবেগের ক্ষরণ তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে এখন। একসময় সেই জায়গায় এসে পৌঁছাই যেখান থেকে আমরা খৈয়াগোপীর দিকে রওয়ানা দিয়েছিলাম।
এটা একটা গুচ্ছগ্রামের মতো। কয়েকটা ঘরবসতি। এখান থেকে সোজা জলসুখা গ্রাম দেখা যায়। পরিকল্পনা হয় আমরা এখানে অপেক্ষা করবো, আমাদের সাথে আসা আনসারের দুজন নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকায় রাখা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন, নৌকা ওখান থেকে বিদায় নেবে। আমরা জলসুখা থেকে অন্য নৌকা নিয়ে যাবো মাকালকান্দি।

আর্মিদের মতো পোষাক গায়ে ইলিয়াস,ক্যামেরা নিয়ে আমি নজরুল ও তানিম- গুচ্ছগ্রামের উৎসাহী লোকজন আমাদের ঘিরে ধরে। কয়েকটা চেয়ার আসে আমাদের জন্য। পাশেই একটা টিউবওয়েল। একটা কিশোর চাপ দেয়- আমরা হাত মুখ পা ধুয়ে নিই, পানি খাই।
ইলিয়াস বয়স্ক লোকদের কাছে জানতে চান তারা কবে থেকে আছে এখানে? ঐ ভাটির দিকের নদী ভাঙ্গনের শিকার মানুষজন এরা। নিজেরাই এই জনশূন্য পতিত জায়গায় ঘর তুলে থাকছে, এখনো ভূমির মালিকানা পায়নি।
আমাদেরকে সরকারী লোকজন মনে করে তারা অনুনয় বিনয় করতে শুরু করে। ইলিয়াস হঠাৎ ক্ষেপে উঠেন- গালি গালাজ শুরু করেন লোকজনকে।
উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার মতো করে বলতে থাকেন- ‘এই হারামজাদারা, কেউ কাউরে অধিকার দেয়না। তোমরা এই জমির মালিকানা ছাড়বানা। এই জমিতে, এইখান থেকে এক মাইল দূরে আমার দাদা প্রাণ দিছে- আমার বুকের রক্ত মিশছে এই মাটিতে। কেউ তোমাদের এই মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবেনা’
লোকজন মজা পায়। হাততালি দেয়। টের পাই মানুষটা এখনো আবেগের ক্ষরণ ও স্মৃতির ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

বেশ কিছুক্ষন পর লোকজন নৌকা থেকে আমাদের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এলে এবার আমরা জলসুখার দিকে হাঁটা শুরু করি। আধা কিমি হাঁটার পর একটা নদী কিংবা হাওর। আমরা দেখি একটা বেশ বড় নৌকা আসছে এদিকে। এই নৌকাতেই আমাদেরকে যেতে হবে জলসুখা।
নৌকা তীরে ভিড়লে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন দীর্ঘদেহী, শুশ্রুমন্ডিত একজন বয়স্ক মানুষ। সাদা পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, মাথায় টুপি তাঁর চেহারায় একটা সৌম্য শান্ত ভাব, শিশুর সারল্য। ইনিই আব্দুর রশিদ। জগতজ্যোতি দাসের একেবারে ছোটবেলার বন্ধু, যুদ্ধদিনের সাথী। আব্দুর রশীদ এগিয়ে এসেছেন আমাদের নিয়ে যেতে।  (চলবে...)

আগের পর্বের লিঙ্ক: দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব- ১০


আপনার মন্তব্য

আলোচিত