নিজস্ব প্রতিবেদক

০২ মার্চ, ২০২১ ০০:৩২

ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার পাশাপাশি পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বিবরণ থাকতে হবে

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সোমবার (১ মার্চ) বিকালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা সংরক্ষণ ও বিকাশ: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি। সভাপতিত্ব করেন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. আমজাদ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, লেখক গবেষক মফিদুল হক, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক লেখক মারুফ রসুল ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল।

সভাপতির প্রারম্ভিক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫-এ শহীদ মুক্তিযুদ্ধের চার প্রধান নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের অনন্যসাধারণ অর্জনের পাশাপাশি অপ্রাপ্তির বিষয়েও বলা প্রয়োজন, বিশেষভাবে যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শের সঙ্গে যুক্ত। যদিও আমরা সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে- গত ৫০ বছরে অধিকাংশ সময় এ দেশ শাসিত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দ্বারা। এই অপশক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যার বিচার করেছেন, ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিনষ্ট ইতিহাস বহুলাংশে পুনরুদ্ধার করেছেন। কিন্তু বিস্মৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধারে সক্ষম হলেও এখনও আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার করতে পারিনি।’

নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনন্যসাধারণ ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে ও বহির্বিশ্বে নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার জন্য বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের চার মূলনীতির প্রতিফলন সরকারের যাবতীয় কর্মে থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিরাপদ রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানপন্থী দুই জেনারেল জিয়া ও এরশাদ ধর্মের নামে রাজনীতি চালু করার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন, যা ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান এবং জাতির পিতার আদর্শের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ফলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে জঙ্গি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটছে। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিরুদ্ধে, সর্বোপরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের মাটি থেকে এদের নির্মূল করা না হলে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, ‘ইতিহাসে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের নৃশংসতার বিবরণ সমানভাবে থাকতে হবে। সকল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি পাঠ্যসূচিতে ৫০ নম্বর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা এবং ৫০ নম্বর থাকতে হবে প্রতিপক্ষের ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ভয়াবহতা ও নৃশংসতার কথা। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম বুঝতে পারবে তারা কোন পক্ষে থাকবে। বিসিএস-এর প্রশ্নপত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষের ইতিহাসের ওপর প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাঠে এসেম্বলির জায়গা না থাকলে শ্রেণিকক্ষে নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে। শুধু আইন নয়, এ বিষয়ে জনমত গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা এ বিষয়ে অনেক প্রকাশনা ও তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে।

‘তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ সার্বিকভাবে জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য হয়েছিল। কিন্তু এখনও আমরা পরিপূর্ণভাবে এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারি নাই। স্বাধীনতার পরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারীরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়েছে। ভূলুণ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নির্মূল কমিটি সৃষ্টি হয়েছিল। নির্মূল কমিটি শত প্রতিকূলতা পেরিয়েও ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেÑ তাতে জয় অবশ্যম্ভাবী। নির্মূল কমিটির উদ্যোগ এবং কার্যক্রমকে আমি পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করি এবং তাদের পরামর্শ মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা কাজ করব।’

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সকলের অবহেলা উদাসীনতার সমাজ মৌলবাদীদের দখলে চলে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা বহুগুণে বেড়েছে। সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে জঙ্গিবাদ এসেছে। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করেছিলেন, জিয়াউর রহমান চালু করেছেন। ফলে সমাজ বার বার পিছিয়ে পড়ছে। ডিজিটাল আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। ওয়াজের মধ্যে নারী, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটাক্ষের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বিজ্ঞান ও বাংলা মিলিয়ে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি তৈরি করা উচিত। শিক্ষাকে একমুখী করা দরকার। পাকিস্তানি মানসিকতা প্রচণ্ডভাবে সমাজে ও প্রশাসনে কাজ করছে। এই মানসিকতা দূর করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তরুণ প্রজন্মের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে এবং তাদের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’

নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘মাদ্রাসায় এবং অন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০০ নম্বরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা আমাদেরই সন্তান। আমরা এভাবে মাদ্রাসাগুলোকে মৌলবাদীদের হাতে জিম্মি হতে দিতে পারি না। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী হেফাজতিরা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি যুগোপযোগী করতে দিচ্ছে না। সকল মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে ।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের হাতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পতাকা সঠিকভাবে তুলে দিতে পেরেছি কিনা, তা দেখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কবর অনেক জায়গায় হারিয়ে গেছে। এগুলো সনাক্ত ও সংরক্ষণ করা দরকার। ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সনাক্তকরণের কাজসহ আরও অনেক কাজ চলছে। কিন্তু তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। আমরা এখনও সঠিকভাবে পাকিস্তানি মনোভাব তরুণদেরকে বুঝাতে পারি নি। একাত্তরের গণহত্যার ভয়াবহতা ও নৃশংসতা তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের পথে আনতে হবে। ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করতে হবে।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, লেখক গবেষক মফিদুল হক বলেন, ‘উচ্চপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ধর্মান্ধতা শুধু জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে না, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ছড়াচ্ছে। একটি পুনর্জাগরণের ডাক দেয়া দরকার, যা একমাত্র ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ দিতে পারে। নতুন প্রজন্মের সাথে মুক্তিযুদ্ধের যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে বিভিন্নভাবে। সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। আমাদেরকে তা কাজে লাগাতে হবে।’

সভায় বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের প্রতিনিধিবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা পাঠ প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সকল মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে ওয়েবিনারের প্রধান অতিথি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে বিশেষভাবে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানান। বক্তারা বলেন, কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হারাম বলে ফতোয়া দেয়া হচ্ছে, অধিকাংশ মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকাও ওড়ানো হয় না। সকল প্রাথমিক, মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক করার জন্য বক্তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত