জাকির আজিজ

২৭ মার্চ, ২০১৬ ১৪:৩০

কামরুল-মোজাম্মেল কি মন্ত্রিত্ব হারাচ্ছেন?

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের অবমাননাকর উক্তির বিরুদ্ধে দেওয়া অর্থদণ্ড, অনাদায়ে কারাদণ্ডের কারণে তাদের মন্ত্রিত্ব থাকছে কিনা, কিংবা মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা তা নিয়ে শুরু হয়েছে জোর গুঞ্জন।

রোববার (২৭ মার্চ)  প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন নয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ দুই মন্ত্রীর প্রত্যেককেই ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ৭ দিনের কারাবাসের আদেশ দেন।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় এই দুই মন্ত্রী আইনগতভাবে মন্ত্রিত্ব হারাচ্ছেন কিনা এ নিয়ে সরাসরি উত্তর দেন নি কোন সিনিয়র আইনজীবী। এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় আসার পর জানা যাবে প্রকৃত অবস্থা।

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন মন্ত্রীসভার উপর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই দুই মন্ত্রী নৈতিকতা হারিয়েছেন কিনা এবং তাদের মন্ত্রিত্ব থাকবে কিনা সে বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদালত তার রায়ে বলেছেন, এই দুই মন্ত্রী চরমভাবে আদালত অবমাননা করেছেন। এজন্য তাদের নিঃশর্ত ক্ষমার আবেদন গ্রহণ করেনি আদালত। তাদের আবেদন না মঞ্জুর করেছেন। তাদের অপরাধের গুরুত্ব এত বেশি যে তাদের ক্ষমা করা যাবে না। আগামী সাত দিনের মধ্যে এই জরিমানার টাকা দাতব্য দুটি প্রতিষ্ঠানে জমা দিতে হবে।’

দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কামরুল ইসলামের আইনজীবী বাসেত মজুমদার বলেন, ‘তাদের মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা সেটি আদালত এখনো ক্লিয়ার করেনি। পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার আগে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’

একই বিষয়ে আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আদালত তাদের কনভিক্টেড বলেছেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, আদালত অবমাননার দায়ে দুইজন মন্ত্রীকে জরিমানা করা হয়েছে। তাদের যে সাজা হয়েছে, তা সংবিধানের ৫৮ ও ৬৬ অনুচ্ছেদকে আঘাত করে না। এ দুটি অনুচ্ছেদে কখন মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্য পদ কীভাবে চলে যাবে তা বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ওই দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব থাকা না থাকার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে। আজ রবিবার আদালত অবমাননার আদেশের পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
 
শফিক আহমেদ বলেন, দুই মন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন কি না, এটি নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। নৈতিকতার বিষয়টি ভিন্ন, সংবিধানে নৈতিকতার বিষয়টি বলা হয়েছে সংসদ সদস্য পদের জন্য। কারণ সংবিধানে বলা হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধে নৈতিকতা জনিত কারণে দুই বছর সাজা প্রাপ্ত হয়। তাহলে তাদের সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে না। আমি মনে করি, দুই মন্ত্রী যে সাজা পেয়েছেন, এতে তাদের মন্ত্রিত্ব যাবে না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মন্ত্রী পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। তিনি বলেন, আদালতে আদেশের পর এই দুই মন্ত্রী তাদের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। দেশের মানুষ জেনে গেছেন, তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। দোষী সাব্যস্ত হয়ে মন্ত্রিত্বে দায়িত্ব পালন করলে দেশের মানুষ কি বলবে? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, তারা নৈতিকতা হারিয়েছেন। অতএব আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই তাদের পদত্যাগ করা উচিত।

এদিকে, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, শপথ ভঙ্গের অপরাধে সর্বোচ্চ আদালত দোষী সাব্যস্ত করে দুই মন্ত্রীকে সাজা দিয়েছে। নৈতিকতার বিষয় থাকায় তাদের অবিলম্বের মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত। যদি তারা পদত্যাগ না করেন তবে প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেয়া।

খন্দকার মাহবুব আরও বলেন, দুইজন মন্ত্রী যে ভাষায় প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারকদের নিয়ে জঘন্য মন্তব্য করেছেন, এরপর তারা গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেছেন, দুই জন মন্ত্রীকে জরিমানা করে যে সাজা দেয়া হয়েছে তা লঘু দণ্ড। এই শাস্তি আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেয়া হয়েছিল। তাতে তার প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ চলে যায়। আমরা মনে করি আপিল বিভাগ দুই মন্ত্রীকে যে সাজা দিয়েছে এজন্য তাদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করা উচিত।

এর আগে গত ৮ মার্চ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রায়ের দিন আপিল বিভাগ দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে তারা স্তম্ভিত বলে মন্তব্য করেন। এরপর তাদেরকে ১৫ মার্চ আদালতে সশরীরে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেন। এর আগে দুই মন্ত্রীকে তাদের বক্তব্যের কারণ দর্শাতে বলেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুই মন্ত্রী তাদের বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বক্তব্য আদালত গ্রহণ না করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলেন। সে হিসেবে তিনি ফের ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। ১৫ মার্চ আদালত অবমাননা বিষয়ে নিষ্পত্তি না হওয়ায় এর চূড়ান্ত রায়ের জন্যে নির্ধারিত হয় ২৭ মার্চ।

প্রসঙ্গত, দুই মন্ত্রী আদালত তথা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন  যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর আপিলের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায়। মীর কাসেমের আপিলের রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি মামলা পরিচালনায় থাকা দায়িত্বশীলদের প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘সাঈদীর মামলার শুনানির সময়ও এ রকম অসঙ্গতি ধরা পড়েছিলো।’

প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্য আদালতে এমন মন্তব্যের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মীর কাসেমের বিচারে প্রসিকিউশনের গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গত ৫ মার্চ  রাজধানীতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এসব মন্তব্যের মাধ্যমে 'হাফ রায়' দেওয়া হয়ে গেছে। তারা আপিল শুনানি আবারও নেওয়ার দাবি জানান।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে আদালতে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মীর কাশেমের ফাঁসি বহাল থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মীর কাশেমের আর ফাঁসি বহাল রাখার সুযোগ নেই। হয় তাকে খালাস দেওয়া হবে অথবা শাস্তি কমিয়ে দেওয়া হবে। তিনি প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বেঞ্চ পুনর্গঠন করে পুনরায় আপিলের শুনানির দাবিও জানান।

অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রসিকিউশন নিয়ে এমন মন্তব্যের পর তাঁর আর প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকা অনুচিত।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান এক আইনজীবী। ৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুনু এ নোটিশ পাঠান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই মন্ত্রীকে তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে লিগ্যাল নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। তিনি একে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ অভিযোগ করে সরকারের সমালোচনা করেছেন।

মন্ত্রীদের বক্তব্যের দিনই সুপ্রিম কোর্ট বার আয়োজিত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতি ও মীর কাসেম আলীর রায় নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় অবহেলার অভিযোগ নাকচ করে দিলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম দুই মন্ত্রীর অভিযোগকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করেন।

রায় ঘোষণার আগে আদালতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গণজাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের অভিযোগ শীর্ষ এ যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর ষড়যন্ত্র চলছে। মীর কাসেমের রায়কে কেন্দ্র করে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এ রায় নিয়ে যে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে প্রয়োজনে আবারও শাহবাগ অবরোধ করে রাখার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে।

মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালীন সময়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের রেশ ধরে দেশব্যাপী নানামুখী আলোচনা ও সরকারের দুই মন্ত্রীর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্যকে সরকারের মন্তব্য বলে জানান।

সোমবার (৭ মার্চ) মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের নয়। মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্যে তিনি বিব্রত হয়েছেন, তাঁর সরকারও বিব্রত।

অবশেষে সব বিতর্ক, সমালোচনা আর আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে আপিল বিভাগ তাদের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।

সব বিতর্ক,আলোচনা-সমালোচনাকে পেছনে ফেলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গত ৮ মার্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আদালত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত