নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ জানুয়ারি, ২০২০ ১৭:৩৯

সিলেট থান্ডার্সের ক্রিকেটাররা ইংরেজি বুঝে না, হতাশ গিবস

অনেক আশা নিয়ে হার্সেল গিবসকে কোচ হিসেবে এনেছিলো সিলেট থান্ডার্স। কিন্তু সেই আশার গুড়েবালি। বঙ্গবন্ধু বিপিএলের পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে অবস্থান করছে সিলেট। ৮ ম্যাচ শেষে সিলেটের পয়েন্ট মাত্র ২। প্লে অফে খেলার সম্ভাবনাও প্রায় শেষ। এ অবস্থায় ঘরের মাঠে ম্যাচ খেলতে এসেছে সিলেট থান্ডার্স। বৃহস্পতিবার থেকে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুরু হবে বিপিএলের সিলেট পর্ব।

দলের এই অবস্থায় হতাশ হার্সেল গিবস। সবচেয়ে হতাশ ক্রিকেটারদের ইংরেজি বুঝতে না পারায়। ক্রিকেটারদের মানসিকতা এবং ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝতে না পারায়ও হতাশ তিনি। বুধবার সিলেট স্টেডিয়ামে দলের অনুশীলন শেষে এই হতাশার কথাই জানান দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাবেক তারকা।

গিবস বলেন, স্থানীয় ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো, তাদের অনেকেই ইংরেজি বোঝে না। আমার জন্য তাই তাদেরকে অনেক কিছুই বোঝানো কঠিন। এটি খুবই হতাশার। আমি যখন কথা বলি, দেখি যে তারা শুনছে। কিন্তু দেখেই বুঝতে পারছি যে, এসব তাদের মাথায় ঢুকছে না। অনুধাবন করতে পারছে না।

সিলেটের কোচ বলেন, খেলাটা নিয়ে তাদের সার্বিক বোঝাপড়ার মান আরও বাড়াতে হবে। একটা বড় ব্যাপার হলো, তারা খুবই টেম্পারামেন্টাল। ওদের কাছে কিছু ব্যাখ্যা করাই কঠিন আমার জন্য। কারণ তারা বুঝতেই পারে না।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেদিন রুবেল মিয়া ব্যাটিং ওপেন করেছে। এক পর্যায়ে তার রান ছিল ২৮ বলে ১৪। টাইম আউটের সময় আমি মাঠে গিয়ে তাকে বললাম, ‘হচ্ছেটা কি? ২৮ বলে ১৪ রান!’ সে শুনে কেবল মাথা নাড়ল। এটা তার দোষ নয়, কিন্তু বাস্তবতা। ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝতে না পারারও বড় একটি উদাহরণ এটি। ২০২০ সাল চলে এসেছে এখন। এখনও যদি একজন ব্যাটসম্যান বুঝতে না পারেন যে ২৮ বা ২৫ বলে ১৪ রান করলে আমাকে সেখান থেকে চালিয়ে যেতে হবে, পুষিয়ে দিতে হবে, তাহলে খুবই হতাশার। হতে পারে, আমি খুব বেশি প্রত্যাশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম। হতে পারে, স্থানীয় ক্রিকেটারদের মানসিকতা নিয়ে একটু বেশিই আশা ছিল আমার।

গিবস বলেন, আপনাদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছি, আপনারা সব বুঝতে পারছেন, ওদের সঙ্গেও এভাবে বুঝিয়ে বলতে পারলে ভালো লাগত। আমি অবশ্যই চাইব, আমি যখন কথা বলছি, আমার প্রতিটি শব্দ তারা যেন বুঝতে পারে। কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না! খুবই হতাশার।

এই ভাষা সমস্যা বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ নিল ম্যাকেঞ্জি কীভাবে দূর করছেন এই নিয়েও প্রশ্ন গিবসের। বলেন, আমি ঠিক নিশ্চিত নই, নিল ম্যাকেঞ্জি যখন কথা বলে, ওরা কতজন ঠিকভাবে বুঝতে পারে। আমি তো তার মতোই দক্ষিণ আফ্রিকান, আমি ঠিক জানি না, সে যা বলতে চায়, তার সবটুকু ওদের কাছে বুঝিয়ে দিতে পারে কিনা। আমি জানি সে দারুণ ব্যাটিং কোচ, ওর কথা মতো কাজ করলে ছেলেরা অনেক শিখতে পারবে। কিন্তু আমি জানি না, ওর কথা ছেলেরা কতটা ধরতে পারছে।

'পরের বছর বাংলাদেশে এলে নতুন ভাষা শিখে আসতে হবে আমাকে' হেসে এমন মন্তব্যও করেন গিবস।

ক্রিকেটাররা ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে সাবেক এই হার্ড হিটার বলেন, বাস্তবতা হলো, গড়পড়তা মানের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার তারাই, যারা ম্যাচ পরিস্থিতি ভালো পড়তে পারে। সিলেটের অধিনায়ক মোসাদ্দেক ভালো ক্রিকেটার উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু তাকে উপলব্ধি করতে হবে, কতটা ভালো ক্রিকেটার সে হতে চায়। যেটি বললাম, এটি আসলে ক্রিকেট বুঝতে পারার ব্যাপার। শুধু মোসাদ্দেক নয়, মিঠুন আছে, এই ছেলেগুলি ভালো ক্রিকেটার। এবারের টুর্নামেন্টে মিঠুনের দুটি ইনিংস, টি-টোয়েন্টিতে ইনিংস গড়ে তোলার দিক থেকে আমার দেখা সেরা টি-টোয়েন্টি ইনিংসগুলোর মধ্যে থাকবে হয়তো। কিন্তু অনেক সময়ই এই ছেলেরা, একটু বেশি চিন্তা করে ফেলে। তারা ভাবে, বড় শটই সবকিছু। আসলে যা মোটেও ঠিক নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইনিংস কিভাবে গড়া হচ্ছে, মাঠের কোন জায়গা দিয়ে শট খেলব, কখন আক্রমণ করব, কখন নিজেকে সংযত রাখব, কখন জুটি গড়ব। মিঠুনকে দিয়েই উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথম ম্যাচে দুর্দান্ত খেলল। আরেক ম্যাচে সেদিন চল্লিশের মতো করল (ঢাকা প্লাটুনের বিপক্ষে অপরাজিত ৪৯)। খুব ভালো। কিন্তু সেই ইনিংসের পরের ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হলো, যখন ইনিংসের ৬ ওভার বাকি। অনেক সময়ই এই ছেলেরা, নিজেদের সামর্থ্যে আস্থা রাখতে পারে না। ক্রিকেটে এমন পরিস্থিতি আসে, যখন ৪-৫টি বল দেখে খেলতে হয়, তার পর চালাতে হয়। এই ব্যাপারগুলি বুঝতে হবে। মিঠুন উল্টো চেষ্টা করতে গিয়েছে, কাজে লাগেনি।

গিবস বলেন, সবই ছোট ছোট ব্যাপার। কিন্তু গড়পড়তা ক্রিকেটাররা যত সময় এসব ঠিকঠাক করতে পারে, তুলনামূলক ভালো ক্রিকেটাররা আরও বেশি সময় করতে পারে। এই ছেলেরা কেবল যদি এই মানসিক দিকগুলোয় উন্নতি করতে পারে, ওদের খেলায় বিশাল পার্থক্য দেখতে পাবেন। ওদের হাতে শট আছে, স্কিল আছে। কেবল মানসিকতা উন্নতি করতে হবে। ব্যাপারগুলি ছোট ছোট। শতকরা ১ ভাগ উন্নতির ব্যাপার। নিজেকে যত ভালো বুঝতে পারা যায়, ততই ভালো হয়ে ওঠা যায়।

সাকিব আল হাসানের প্রশংসা করে তিনি বলেন, সাকিব সবার চেয়ে আলাদা। কেন? সেটিই বুঝতে হবে অন্যদের। সে আলাদা কারণ তার ভাবনা অন্য পর্যায়ের। খেলাটা বুঝতে পারার ক্ষমতা তার অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেজন্যই সে এত ভালো। গত দুই বছরে তার ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝতে পারার ক্ষমতা অনেক বেড়েছে, এজন্যই সে সব সংস্করণে এত ধারাবাহিক হতে পেরেছে। কিন্তু এই ছেলেরা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে যায়। পরের দিকের ব্যাটসম্যানদের জন্য কাজ রেখে যায়। কাজ শেষ করে আসে না। এই ব্যাপারটি আমি খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছি, শুধু আমাদের দলে নয়, সব দলের স্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যেই। ওদের বুঝতে হবে, টি-টোয়েন্টি মানেই কেবল তেড়েফুঁড়ে খেলা নয়। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই বলেছি, টি-টোয়েন্টি মানে কেবল চাপ সৃষ্টি করাই নয়, নিজেদেরও চাপ সহ্য করার সামর্থ্য থাকতে হবে। আমি সবসময় তিনটি ‘পি’ নিয়ে কথা বলি, ‘প্রেশার, পার্টনারশিপ অ্যান্ড প্যাশেন্স।’ ব্যাটিং-বোলিংয়ে এই তিনটি ব্যাপারই গুরুত্বপূর্ণ, সংস্করণ যেটিই হোক।

গিবস বলেন, পাশাপাশি ক্ষুধাটাও থাকতে হবে। বিশ্বের ভালো সব ব্যাটসম্যানরা সবসময় রান করতে চায়, সংস্করণ যেটিই হোক। সবসময়ই ক্ষুধার্ত থাকে। কখনোই সহজে ছেড়ে দেয় না। বিরাট কোহলি, এবি ডি ভিলিয়ার্স, এই মানের ব্যাটসম্যানরা কোনো রানেই সন্তুষ্ট হয় না। সবসময় আরও বেশি করতে চায়। এই ছোট ব্যাপারগুলি এখানকার স্থানীয় ক্রিকেটারদের বুঝতে হবে। যদি বুঝতে পারে, দেখবেন ওরা কতটা ভালো ক্রিকেটার হয়ে উঠছে।

সিলেট থান্ডার্সের তলানিতে অবস্থান নিয়ে দলের কোচ বলেন, আমরা নিজেরাই নিজেদের এই অবস্থায় ঠেলে দিয়েছি। মাঠে পরিস্থিতি ঠিকভাবে পড়তে পারার জায়গায় আমাদের ঘাটতি থেকে গেছে। সবই খেলার মৌলিক ব্যাপার, চাপের মধ্যে নিজেদের মেলে ধরা, ব্যাটে-বলে জুটি গড়ে তোলা। কোচ হিসেবে আমি এসবের দিকেই তাকিয়ে থাকি, ম্যাচ পরিস্থিতি কোন ক্রিকেটার কতটা ভালো বুঝতে পারে। আমাদের ছেলেরা সবাই ভালো। ব্যাটে-বলে সবাই প্রতিভাবান। কিন্তু যেটি বললাম, মাঠে খেলাটা বুঝতে পারার ক্ষমতায় আমাদের এই স্কোয়াড পিছিয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি বুঝে মাঠে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া, এই ব্যাপারগুলোতে ঘাটতি থেকে গেছে। এজন্যই আমরা ভুগেছি।

তিনি বলেন, দিনশেষে সবাইকে গভীরভাবে ভাবতে হবে যে আমরা একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে, একটি ব্র্যান্ডকে এই লিগে প্রতিনিধিত্ব করছি। পারফরম্যান্সে তাই গর্ব খুঁজে নিতে হবে। সেই সুযোগ মিলিয়ে যাচ্ছে না। পরের চার ম্যাচে সবার সামনেই সুযোগ থাকছে নায়ক হওয়ার। ঘুরে দাঁড়ানোর। অবশ্যই আমরা এখন আর প্লে অফে খেলতে পারব না। কিন্তু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ঠিকই আছে। আমি গতকাল রাতে ওদেরকে বলেছি, নতুন বছর এসেছে। শারীরিক, মানসিক ও টেকনিক্যাল, খেলার সব দিকে উন্নতি করতে হবে একজন ক্রিকেটার হিসেবে। সামনে তাকিয়ে এটিই দলের কাছে আমার প্রথম চাওয়া।

সিলেটে স্কোয়াড নিয়েও কিছুটা অসন্তোষ গিবসের কণ্ঠে। বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ড্রাফটের সময় আমি ছিলাম না। আমাকে একটি স্কোয়াড ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি যদি ড্রাফটের সময় থাকতাম, অবশ্যই ভালো দুয়েকজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দলে নিলাম। বাঁহাতি পেসার নিতাম। বৈচিত্র্য থাকত। কিন্তু আমাকে এই স্কোয়াডই দেওয়া হয়েছে। কোচ হিসেবে আমি খুঁজব, কিভাবে আমরা প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি। আমরা যখন মাঠে নেমেছি, প্রতিপক্ষ দেখেছে যে আমাদের কেবল একজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। প্রতিপক্ষের বোলারদের জন্য তাই আমাদের ব্যাটসম্যানদের চাপে রাখা সহজ হয়েছে, কারণ আমাদের সবই প্রায় ডানহাতি ব্যাটসম্যান! স্কোয়াডে কেবল একজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, এমন স্কোয়াড আর কোথাও সম্ভবত দেখতে পাবেন না। প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে অন্তত দুজন বাঁহাতি থাকবে, এটিই ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড হওয়া উচিত। যাতে প্রতিপক্ষের বোলাদের চাপে রাখা যায়। আমার সেই সুযোগ ছিল না। কাজটি তাই কঠিন ছিল। আর আগে যেটি বললাম, ম্যাচ পরিস্থিতি বোঝার মানসিকতা যদি না থাকে, শুরুতে যদি জুটি গড়ে না ওঠে, পরের দিকের ব্যাটসম্যানদের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হয়। আরেকটা দিকের কথাও বলি। আমাদের দলে ডানহাতি স্পিনার আছে, বাঁহাতি স্পিনার আছে। কিন্তু বল টার্ন করেনি, এবার উইকেট দারুণ (ব্যাটিংয়ের জন্য)। ডানহাতি বা বাঁহাতি, দুই ধরণের স্পিনারদের জন্যই কাজটি হয়ে উঠেছে কঠিন। গতির বৈচিত্র্য ও লাইন-লেংথ এখানে গুরুত্বপূর্ণ স্পিনারদের জন্য।

গিবস বলেন, একগাদা ডানহাতি ব্যাটসম্যানের কথা বারবার বলতে হচ্ছেই। বৈচিত্র্য যখন ছিল না ব্যাটিং অর্ডারে, প্রয়োজন ছিল ব্যাটসম্যানদের রান করা। সেটি হয়নি। এই স্কোয়াড নিয়েই আমাকে কাজ করতে হয়েছে। আশা করি, সামনের ম্যাচ কয়েকটির পর ওরা গভীরভাবে ভাববে যে স্কিলের দিক থেকে কোথায় উন্নতি করতে হবে। মাঠের পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে কিভাবে বুঝতে পারা যায়। প্রয়োজনের সময় চাপের মধ্যে মানিয়ে নেওয়া জরুরি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত