সোশ্যালমিডিয়া ডেস্ক

২২ মার্চ, ২০২০ ১৯:৪৩

করোনা মোকাবেলার অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরলেন মৃত ব্যক্তির ছেলে

শনিবার নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন রাজধানীর মিরপুরের এক বাসিন্দা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশের ২য় ব্যক্তি হিসেবে মারা যান তিনি। এই ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে তার ছেলে ইকবাল আবদুল্লাহ নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। বাবার চিকিৎসা ও করোনাভাইরাস পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে তা ফুটে ওঠেছে ছেলের এই স্ট্যাটাসে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার অব্যবস্থার চিত্রও ফুটে ওঠেছে ইকবাল আবদুল্লাহর আবেগঘন পোস্টে।

ইকবাল আবদুল্লাহর পোস্টটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো:

পিতার মৃত্যু এবং সন্তানের ব্যর্থতা
আমি কখনো ভাবিনি যে আমার পিতার মৃত্যুর ঘটনা আমাকে এইভাবে লিখতে হবে। কিন্তু কিছু মিডিয়ার মিথ্যা রিপোর্ট দেখে আমি বাধ্য হলাম ফেসবুকে কিছু সত্য প্রকাশ করতে।

গত ১৬ তারিখে আব্বা অসুস্থ বোধ করলে আমাদের ড্রাইভার ওই দিন বিকেলে তাঁকে কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসে। ওই সময় আমরা ভাইয়েরা সবাই অফিসে। আমি অফিস থেকে বাসায় এসে শুনলাম, ডাক্তার ধারণা করছে উনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য প্রস্তাব করেছে। অতঃপর ওই রাত্রেই আমরা টেস্ট এর জন্য IEDCR (আইইডিসিআর)-এর হান্টিং নম্বরে ফোন দেওয়া শুরু করি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাদের সঙ্গে আমরা কমিউনিকেশন করতে সমর্থ হই। তারা আমাদের জানায়, যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশ ফেরত না এবং বিদেশ ফেরত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে উনি আসেন নাই, সেহেতু এই টেস্ট ওনার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি তাদের বলেছিলাম, উনি মসজিদে যান এবং ওখান থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে কি না। তারা আমাদের বলেছেন যে, এই ভাইরাস বাংলাদেশে কমিউনিটিতে মাস লেভেলে এখনো সংক্রমিত হয়নি; সুতরাং আপনারা চিন্তা করবেন না। এটা সাধারণ শ্বাসকষ্টের প্রবলেম।

ওই রাত্রেই আনুমানিক সাড়ে ১০টায় আমি তাঁকে শ্যামলীর একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং আমাদের পরিচিত একজন স্পেশালিষ্ট ডক্টরকে দেখাই। উনি আমাকে বলেন, রোগীর নিউমোনিয়া হয়েছে। তাঁকে নিউমোনিয়ার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। তবে বাংলাদেশের কোনো হসপিটাল এই রোগীর ভর্তি নেবে না। আপনারা বাসায় ট্রিটমেন্ট করেন। আমি ওই রাত্রে বাসায় চলে আসি এবং আব্বাকে নেবুলাইজার দেওয়া এবং মুখে খাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক দিতে থাকি। পরের দিন ১৭ তারিখে দুপুরে আমি আব্বাকে নিয়ে যাই শ্যামলীর ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। তারা রোগী দেখে বলে যে, রোগীর অবস্থা ভালো না; তাঁকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হবে। এবং তাদের আইসিইউ তারা দিতে পারবে না। এরপর আমি অন্য একটি হাসপাতালে কথা বলি। ওরা বলে, ওদের আইসিইউ খালি আছে। আমরা দ্রুত আব্বাকে নিয়ে কেয়ার হাসপাতালে যাই এবং আইসিইউতে ভর্তি করি। ১৫ মিনিট পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের বললেন, এই রোগী তারা রাখতে পারবেন না।

অতঃপর আমরা রোগী নিয়ে কল্যাণপুরের একটি হসপিটালে যাই। তারা আমাকে কেবিন দিয়ে সাহায্য করে; কিন্তু তাদের আইসিইউ খালি নাই। রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টায় হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে বলেন, এই রোগীর আইসিইউ লাগবে, আপনারা দ্রুত আইসিইউ-এর ব্যবস্থা করেন। আমি বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলতে থাকি, কোথাও আইসিইউ খালি নাই। অতঃপর মিরপুরের ওই হাসপাতাল তাদের আইসিইউ দিতে রাজি হয়। আমি এবং আমার ছোট ভাই রাত্রে ৪টার সময় আব্বাকে নিয়ে সেখানে আসি এবং দুপুর ১২টার পর থেকে আব্বা লাইফ সাপোর্টে চলে যান। ১৮ তারিখ দুপুর থেকে আমরা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ IEDCR-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি; কিন্তু ব্যর্থ হই। অতঃপর ১৯ তারিখ বিকেলে IEDCR রাজি হয় এবং রাত্রে টেস্ট করে এবং পরের দিন ২০ তারিখ দুপুরে IEDCR আমাদের জানায় যে, রিপোর্ট পজিটিভ। আমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলে ১৫ দিন।

রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর থেকে ওই হাসপাতাল আমাদের প্রেশার দিতে থাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা অনুমতি না দিয়ে তাদের বলতে থাকি ট্রিটমেন্ট দিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আর রোগীর কাছেও যায়নি এবং আমাদের আইসিইউ-এর ভেতর ঢুকতেও দেয়নি। যাহোক, আমার আব্বু অবশেষে ২১ তারিখ ভোর তিনটার সময় ইন্তেকাল করেন।

আমরা সন্তানরা ব্যর্থ, পিতার সঠিক ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে এবং এমনকি তার জানাজাতে আমরা উপস্থিত থাকতে পারি নাই। সন্তান হিসেবে, একজন পুত্র হিসেবে এরচেয়ে কঠিন কষ্ট আর কিছুই হতে পারে না। আমার বুকে পাথর বেঁধে বাসায় অবস্থান করছি সরকারের আইন মেনে ১৫ দিন। কিন্তু কিছু পেজ এবং ফ্রন্টলাইনের মিডিয়া আমাদের নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, আমার ভগ্নিপতি বিদেশ থেকে আমাদের বাসায় এসেছে- যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমার দুই ভগ্নিপতি, বড় বোন এবং তার স্বামী চিটাগংয়ের দুটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। অন্য ভগ্নিপতি জাপান থাকে। সে গত এক বছরের মধ্যে আসে নাই। আমার বাবা যেদিন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে চলে যায়, সেদিন, মানে ১৯ তারিখে আমার বড় বোন এবং বড় দুলাভাই চিটাগং থেকে আমাদের বাসায় আসে এবং তারাও হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করছে।

আমাদের এই বিপদের সময় দয়া করে আমার পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা রিপোর্ট করবেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যরা সুস্থ আছে। কারও মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দেয় নাই। আমার ছোট ভাই এবং আমার ড্রাইভারের কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়েছে, যেটা নেগেটিভ এসেছে। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন, বাংলাদেশের সবাইকে যেন আল্লাহ হেফাজত করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত