ওলীউর রহমান

০৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:৫১

বিশ্ব ইজতেমা : একটি ধর্মীয় আন্তর্জাতিক মহা-সমাবেশ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে শিল্প নগরী টঙ্গীর সুবিশাল ময়দানে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশ সহ মুসলিম বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ এতে অংশ গ্রহণ করেন। মুসলিম জাহানের সুবৃহৎ এই সমাবেশের জন্য খাটানো হয় বিশাল প্যান্ডেল।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে দেশর সর্ববৃহৎ জুমুআর জামাত অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর ময়দানে। মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য-এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পাকিস্তান, ভারতও ইউরোপীয় দেশ সমূহ সহ বিশ্বের প্রায় ৫০/৫৫টি দেশ থেকে মুসল্লিরা অংশ গ্রহণ করেন বিশ্ব ইজতেমায়।

আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে সরকারী-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। গণমাধ্যম গুলো গুরুত্ব সহকারে ইজতেমার খবর প্রচার করে। আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে ইজতেমার কার্যক্রম সমাপ্ত হয়।

বিশ্ব ইজতেমার ব্যবস্থাপনা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষের সপ্তাহ ব্যাপী সমাবেশ, নিজস্ব উদ্যোগে পানাহার, বয়ান শ্রবণ, আযানও নামাজ আদায়, প্রাত্যহিক ক্রিয়া কর্ম সম্পাদন কোন বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সমাপ্ত হয়। এছাড়া প্রায় দেড়শত একর ভূমির উপর বিশাল প্যান্ডেল তৈরি, পানি বিদ্যুৎ সরবরাহও এসবের ব্যয়ভার বহন সত্যিই একটি বিস্ময়কর ব্যাপার।

বিশ্বইজতেমার প্রস্তুতি এবং প্রচারণার জন্য ইজতেমার চার মাস পূর্বে দশদিন ব্যাপী একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এটাকে বলাহয় জুড়। এই সমাবেশে উপস্থিত থাকেন তাবলীগ জামাতের নতুন পুরাতন অনেক সাথী। এটাই মূলত ইজতেমার প্রস্তুতি মূলক আয়োজন। দশদিন ব্যাপী এই সমাবেশ বা জুড় থেকে বিপুল সংখ্যক সাথী চারমাস তথা তিন চিল্লার জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হন।

যারা এখান থেকে তিন চিল্লার জন্য বের হন, তাদেরকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। একভাগকে রাখা হয় ইজতেমার মাঠে ইজতেমার প্রস্তুতি মূলক কাজের জন্য। আর অপরভাগকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয় সারা দেশ জুড়ে। এরা সারা দেশের শহরে-বন্দরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য চষে বেড়ান এবং মানুষদেরকে ইজতেমার জন্য দাওয়াত দিতে থাকেন। অবশেষে সবাই গিয়ে সমবেত হন ইজতেমার মাঠে। ইজতেমার মাঠে যারা থাকেন তারা পরেরদিন থেকেই কাজে লেগে যান। টঙ্গীর তুরাগ নদীর পূর্ব তটের বিশাল ময়দানের অসমান জায়গা গুলো তারা প্রথমে সমান করেন। এসব কাজের জন্য তাদেরকে কোন মজুরী দেওয়া হয়না বা কেউ তা চায়ও না। তাবলীগের বিভিন্ন কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তারা সবাই নিজেকে দ্বীনের দায়ি বা প্রচারক এবং আল্লাহর কামলা মনে করেন। তাই কারো অন্তরে দুনিয়াবি কোন স্বার্থের মানসিকতা থাকেনা। সবার সাথে থাকে হালকা বিছানা, রান্না-বান্না করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাব পত্র এবং নিজের পক্ষ থেকেই খাবার দাবারের ব্যবস্থা করেন তারা। আর এটাই আল্লাহর পথের মুবাল্লিগদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুই পর্বে। এবার বিশ্ব ইজতেমার ৫১তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সর্বপ্রথম বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইলে। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। এর পর ১৯৫৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জে। ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর পাগার নামক স্থানে। ১৯৬৭ সাল থেকে তুরাগ নদীর পূর্বতীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্বইজতেমা। কালের পরিক্রমায় সময়ের পরিবর্তনে এবং তাবলীগ অনুসারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় বিশ্বইজতেমা আজ রূপ পরিগ্রহ করেছে মুসলিম বিশ্বের এক সুবৃহৎ সম্মেলনে। বিশ্বইজতেমার মত একটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের কাছে এক বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। এই সুবাদে বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের সুনামও পরিচিতি।

উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে চরম অবক্ষয়ও এক দুঃসময়ে বিংশ শতাব্দির তৃতীয় দশকে মাওলানা ইলিয়াস (র.) তাবলীগ আন্দোলন এবং তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি এ আন্দোলন সারা বিশ্বে মুসলমানদের মাঝে দাওয়াতে দ্বীনের তৎপরতা অবিরাম গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে। তাবলীগ জামাত হলো একটি আন্তর্জাতিক দাওয়াতি সংস্থা। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং ইবাদত সমূহের অনুশীলনও শিক্ষাদানই হচ্ছে তাবলীগ জামাতের মৌল কর্মসূচী। সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য একটি দাওয়াতি আন্দোলন হল তাবলীগ জামাত। আল্লাহর হুকুম এবং নবী (সা.) এর তরীকা বা আদর্শের প্রতি মানুষ কে আগ্রহী করে তুলা এবং মানুষের অন্তঃকরণে ইসলামের চিল্লা চেতনাকে জাগ্রত করাই হলো তাবলীগের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জনপদেই রয়েছে তাবলীগ জামাতের সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং দাওয়াতি তৎপরতা।

পঞ্চাশের দশকে জনৈক মাওলানা আব্দুল আজিজও তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কাজের সূচনা হয়। কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে যেসকল সংগঠন ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছে এর মধ্যে তাবলীগ জামাত অন্যতম। বিশ্বইজতেমা বিশ্ব তাবলীগ জামাতের সর্ববৃহৎ ইজতেমা বা সমাবেশ। তাবলীগ জামাতের বাৎসরিক কাজের হিসাব, পর্যালোচনা ও দাওয়াতি কাজের আরো বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যেই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। বলা হয়ে থাকে, পবিত্র হজ্জের পর এটাই মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ সমাবেশ।

মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্বও তাৎপর্য অপরিসীম। মুসলিম বিশ্ব ইতিহাসের এক নাযুক সময় অতিক্রম করছে। এক সময় শুনা যেত জুমআর খুতবায় খতীবগণ কাশ্মীর, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য দোয়া করতেন। এর পর ইমামও খতীবগণের দোয়ায় যুক্ত হলো বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলমানদের কথা। এর আর কিছুদিন পরে যুক্ত হলো ইরাক এবং আফগানিস্তানের মজলুম মুসলমানের কথা। ইমাম খতীবদের দোয়ায় এর পরে যুক্ত হলো মায়ানমারের মজলুম আরাকান মুসলমান এবং ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের কথা। এর পরে যুক্ত হলো চীন সহ আর বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানদের কথা। এভাবে মজলুম মুসলিম জনপদের তালিকা বৃদ্ধিই পাচ্ছে দিন দিন।

বর্তমান সময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মজলুম মুসলমান মা-বোনদের আর্ত-চিৎকার। এক কথায় মুসলমানরাই হচ্ছে বিশ্বের সমস্ত পরাশক্তি সমূহের এবং তাদের আঞ্চলিক সহযোগী শক্তিসমূহের প্রধান টার্গেট এবং প্রতিপক্ষ। আজ মুসলমানদের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। মুসলমান মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে আজ গোটা দুনিয়া ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অশান্তির দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। একের পর এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কলুষিত করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের এ দুরবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঐক্যহীনতা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহ।  

বিশ্বইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা এসে সমবেত হন, পারস্পরিক জানাজানি হয়। এখানে এসে একত্রিত হন নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা বর্ণের মুসলমান-এক মহান প্রভূরবান্দা, মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত ও তাঁর নির্দেশিত পথ ও পদ্ধতির অনুসারী এবং এক কুরআনের বিশ্বাসী হিসেবে। তাই বিশ্বইজতেমা মিল্লাতের বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারে। যা মুসলিম মিল্লাতের চলমান নাজুক ও বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।

আমাদের প্রত্যাশা আসন্ন বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য, বিশ্বশান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এবং গোটা দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম এবং বিশ্বনবী (সা.) এর আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত