এনামুল হাসান নোমান

০২ এপ্রিল, ২০১৭ ২০:১৫

হাওরপাড়ের কান্না : তলিয়ে যাচ্ছে সোনার ফসল

আমরা যারা শহরে এসে বাবু সেজে বসে আছি, তাদের অনেকেই গ্রামের খবর রাখিনাÑ হাওরের খবর রাখিনা। হরেকরকম নাম দিয়ে যে ভাত আমরা দিনে তিনবার চিবিয়ে খাই, সে ভাতের উৎসস্থল হাওর যখন পানির নীচে তলিয়ে যায় তখন আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েনা। খবরের কাগজে ফসল তলিয়ে যাবার খবরটি নিখুঁতভাবে এড়িয়ে যাই।

এই মুহূর্তে হাওরপাড়ের খবর বলতে গেলে গলা ধরে আসে। সুনামগঞ্জের অধিকাংশ হাওরের অবস্থাই করুণ। সকালে বাবা ফোন দিয়ে বললেন, “ আমাদের হাওরটা তলিয়ে গেছে..”।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই দেখা যায় অতিবৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান নদীর পানির চাপে সুনামগঞ্জের বাঁধগুলো ভেঙে ভেসে যাচ্ছে। একেকটা বাঁধকে টিকিয়ে রাখতে হাজারো কৃষকের প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। আর যে বাঁধ কোনভাবেই রক্ষা করা যায়নি, সে বাঁধের পাড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সর্বস্বান্ত কৃষক। সারাবছরের হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে সোনার ফসল একটু একটু করে পাকতে শুরু করেছে, সে ফসল তলিয়ে যাবে চোখের সামনে! একজন কৃষকের কাছে এমন দৃশ্য চেয়ে দেখা মৃত্যুর মতো।

দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের অন্যতম বড় ফসলভাণ্ডার সুনামগঞ্জে এমন দৃশ্য প্রায় প্রতিবছরই দেখতে হয়। এখানকার হাওর রক্ষা বাঁধগুলো একেবারেই নড়বড়ে অবস্থায় থাকে। বাঁধগুলোর স্ট্রেংথ যদি ন্যুনতম মানেরও হতো, তাহলে প্রতিবছর এখানে এত ক্ষয়ক্ষতি হতোনা। প্রতিবার বর্ষা মৌসুম আসার আগেই হাওর রক্ষা বাঁধগুলো নির্মাণ, পুন:নির্মাণ বা শক্তিশালি করার জন্য সরকার থেকে প্রজেক্ট আসে।

এরকম অনেক বাঁধ নির্মাণের কাজ সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাঁধই খুব দুর্বলভাবে তৈরি করা হয়। সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ বাজেট আসে তা সম্পূর্ণ কাজে লাগালে বাঁধ এতো নড়বড়ে হওয়ার কথাই না। কিন্তু বাজেটে স্থানীয় ছোটবড় বোয়ালেরা বড়বড় কামড় বসানোর পর যে টাকা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে বাঁধ তৈরি করা মোটামুটি অসম্ভব কাজ।

এসব ব্যাপার একেবারেই ওপেন সিক্রেট। তার উপর কাজের কচ্ছপগতি। বাঁধ নির্মাণের সময়সীমা শেষ হয়ে যাবার পরও দেখা যায় কাজ দশ পার্সেন্টও হয়নি। এত দীর্ঘসূত্রিতার কারণ জানতে চাইলে কেউই কোন সদুত্তর দিতে পারেনা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দোষ দেয় উপজেলা/জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের, আর ঊর্ধ্বতনরা দোষ দেয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের। এভাবে ঘষতে ঘষতে প্রতিবারই পানি এসে নিয়ে যায় কৃষকের সর্বস্ব।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আর নাগরিক সমাজের উদাসীনতা দেখলে মনে হয় হাওর শুধু কৃষকের সম্পদ। ভাত শুধু কৃষকেরাই খায়। ফসলহানির বিরূপ প্রভাব যে সারাদেশের উপর পড়ে সেটা বুঝেও চুপ থাকা ও উদাসীনতা প্রদর্শন যে কতবড় আত্মঘাতী প্রবণতা তা আমরা কবে বুঝবো? কিছু মানুষের সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কুফল আপামর কৃষকসমাজ তথা পুরো বাংলাদেশ ভোগ করতে পারেনা। সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে চলমান ফসলহানীর জন্য কারা দায়ী তার তদন্ত হউক।
পাশাপাশি এই হাওর অঞ্চলকে সরকার কর্তৃক দুর্গত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাঠানো হউক।

  • এনামুল হাসান নোমান: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ইমেইল: [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত