এনামুল হাসান নোমান

১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:৪১

দিরাই-শাল্লা আর আগের মতো নেই!

সংঘর্ষের ঘটনায় হাসপাতালে আহতদের কয়েকজন

গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) দিরাইয়ে জলমহাল দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হলো। খবরের কাগজ ঘেঁটে যা বুঝা গেল, বিবদমান দুই গ্রুপের মূল পরিচয় কেউ বর্তমান এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুসারী আর কেউ সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি মতিউর রহমানের অনুসারী। উভয়পক্ষেরই মূল শক্তি ও ভরসার জায়গা এই দুই নেতা। যদিও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মতিউর রহমানের মতো দুজন প্রাজ্ঞ নেতা এরকম ঘটনার অবতারণা দেখতে চাননা বলেই সকলের বিশ্বাস।

সাম্প্রতিক এই ঘটনার কথা উল্লেখ করার কারণ হলো ইদানিং দিরাই-শাল্লায় বড় রকমের রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে যার প্রাথমিক বিস্ফোরণ মঙ্গলবারের ঘটনা। যদিও জলমহাল নিয়ে এখানে আগেও অনেক সংঘাত হয়েছে, কিন্তু এই রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

ছুটি কম থাকায় ঘনঘন বাড়িতে যাওয়া হয়না, তবে মাস দুয়েক পরপর দুয়েকদিনের জন্য এলাকায় গেলে দিরাই-শাল্লার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে হতাশ হই। একই টেবিলে বসে যারা কয়দিন আগেও চা খেয়ে খেয়ে গল্প করেছে এখন তারা সুরঞ্জিত গ্রুপ আর মতিউর গ্রুপে ভাগ হয়ে কেউ কারো মুখও দেখতে চায়না! অথচ একসময় দিরাই শাল্লার রাজনৈতিক সম্প্রীতি ছিল প্রবাদতুল্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বন্ধু বান্ধবদের সাথে রাজনীতি নিয়ে আলাপ হলে যখন তারা তাদের এলাকার অস্থিরতার কথা বলতো, আমরা দিরাই-শাল্লা অঞ্চলের ছেলেরা তখন আমাদের এখানকার ভদ্র আর শান্ত রাজনীতির কথা বলতাম। হরতাল, অবরোধ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে অস্থিরতা, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে সংঘাত, কিংবা সরকারী দল ও তার অঙ্গ সগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল কোনকিছুই স্পর্শ করেনি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সংসদীয় এলাকাকে। কিন্তু হঠাতই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল এখানকার সরকার সমর্থক তৃণমূল কর্মীরা। কে এই বিভক্তির মূলে দায়ী- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমান? এমন প্রশ্নের উত্তরে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে পরস্পর দোষারোপ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না।

তবে কোন গ্রুপেই এখন আর সক্রিয় নন তৃণমূলের এমন কয়জন প্রবীণ নেতার সাথে আলাপ করে উঠে আসে ছোটখাটো কিছু বিষয় যা আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। দিরাই শাল্লায় যখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলনা তখন সব রকমের কর্তৃত্ব আর ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয়ে পড়ে তার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির হাতে। দলীয় পদ থেকে শুরু করে অন্যসকল বিষয় আশয় গুটিকয়েক নেতার হাতে জিম্মি হয়ে পড়ায় ভুক্তভোগী নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। তবে একচেটিয়া আধিপত্যের ভয়ে মুখ খুলেনি কেউ। আর কেউ নীরবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন দলীয় কার্যাবলী থেকে।

সুযোগের অপেক্ষায় থাকা জেলা সভাপতি মতিউর রহমান এই সুযোগটাই কাজে লাগান। দিরাই শাল্লায় গিয়ে তিনি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তার ঘনিষ্ঠ সেই প্রভাবশালীদের সমালোচনা করেন। আর এতেই যেন প্রাণ ফিরে পান ক্ষুব্ধ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া সেই নেতাকর্মীরা। মতিউর রহমানকে কেন্দ্র করে তারা গড়ে তুলেন ভিন্ন এক বলয় যার লক্ষ্য সুনামগঞ্জ-২ আসনে সুরঞ্জিতের পরিবর্তে মতিউরকেই সংসদ সদস্য করা। মতিউরও মাঠে নামলেন ঠিকই, কিন্তু বেছে নিলেন ভুল রাস্তা। তিনি দলীয় ব্যানারে সভা-সমাবেশ, আলোচনা সভা ইত্যাদির আয়োজন করতে শুরু করলেন তবে সেখানে বর্জন করলেন আওয়ামী লীগের অনেক পদধারী ও প্রবীণ নেতাদের কারণ তারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুসারী।

আর এতেই যেন বিভেদের আগুনে ঘি পড়লো। উভয় পক্ষের মধ্যে তৈরি হলো চরম হিংসাত্মক সম্পর্ক যা দিরাই শাল্লার মানুষকে একের পর এক নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করলো। গ্রাম-গঞ্জে ১৪৪ ধারা, তুচ্ছ বিষয়ে মারমুখী পরিস্থিতি বা বন্দুকযুদ্ধ করে পাখির মতো মানুষ মারার মূলে সরকারী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি ও বেপরোয়া মনোভাবকেই দায়ী করছেন দিরাই শাল্লার সাধারণ মানুষ।

  • এনামুল হাসান নোমান : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ইমেইল- [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত