মো. আব্দুল মতিন

২৯ এপ্রিল, ২০১৭ ২০:০৫

লুটেরা যেন হাওরবাসীর ত্রাণেও ভাগ না বসায়

হাওরে সব হারিয়ে মানুষের শহরমুখি হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ফাইল ছবি

বৈশাখের ধান উঠার সম্ভাবনা তৈরি হলে চৈতালি চাঁদনিরাতের রোমান্টিকতা, সবুজ ধান সোনালী হয়ে গোলায় উঠলে বৈশাখের নবান্ন সুখে সাগর সদৃশ জলের বিস্তর প্রান্তর হয়ে উঠে শুধু সুখের হাওর। অন্ন সুখে শ্রাবণ মেঘের দিনে ভাটির কন্যা রূপ গুণে মুগ্ধতা ছড়ায়। হাওরের ঢেউয়ে কৃষক - মাঝি অন্ন সুখে রাধারমণ,করিম, হাছন, দূর্বিন সুরে গান ধরে। বারোমাসের অন্ন সংস্থান করে হাওরের একফসলি বোরো ধান। ক্ষুধা মুক্ত মনে বাউলিয়া সুর বাসা বাঁধে; শ্রাবণের অবিরাম বর্ষণের অথৈ পানিতে জীবনযুদ্ধে পরাজিত মন বৈঠাহাতে হৃদয়ে জমাট জীবন যুদ্ধের গ্লানি অবচেতন মনে গেয়ে উঠে, 'মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে,আমি আর বাইতে পারলামনা'। অভাবে আগুন লাগা সংসার ছেড়ে যাওয়া প্রেয়সীর টান পড়ে হৃদয়ে বাউল করিমের সুরে, 'কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি'? টান পড়ে দূর্বিন শাহের বিচ্ছেদ সুরে, 'কিসুখে রইয়াছি আমি গো সখী জানে বন্ধে দেখেনা /গেল বন্ধু আর আইলনা'!

এটাই ভাটির হাওরের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অসাম্প্রদায়িক ভাটি আর হাওরের শাশ্বত রূপ।

হাওরের সেই শাশ্বত রূপ খুব বিরূপ হয়েছে এবার। এবার সাত জেলায় কোটি মানুষের ভাগ্যে অন্ন সুখ নেই। চৈত্রে আগাম প্রবলবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি, কাঁচা-পাকা ধান তলিয়েছে, কোটি স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে, ধানে ব্যবহৃত কীটনাশক পানিতে অ্যামোনিয়া তৈরি করে অক্সিজেন কমেছে, মাছ, হাঁস, গরু মরা সহ হাওরের বাস্তুসংস্থান পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে; হাওরের কষ্টের দুর্গন্ধে বসবাস করা দায় হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে' হাওরের রাজধানী' খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার কৃষকের। এখানে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির পুরোটাই তলিয়ে গেছে।

ত্রাণ সচিবের ভাষ্য অর্ধেকের বেশী মানুষ মারা না গেলে দুর্গত এলাকা না হলেও এখানের গরীব, ধনী সবাই জীবন্মৃত, অসহায় অবস্থায় আছেন যা আপনার অন্তর্দৃষ্টিই কেবল তাঁদের কাতর সুর বুঝতে পারে।

মহাদুর্দিনে সান্ত্বনার বাণী আর কৃষকের নিদানের দুঃখ ঘুচাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি সুনামগঞ্জে আসছেন। ইতোমধ্যে হাওরের দু:খ লাগবে সরকার অপ্রতুল হলেও ত্রাণসামগ্রী দিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু হাওরবাসীর শঙ্কা যারা হাওরের বাঁধের টাকা হাওরের কোটি মানুষের পেটের অন্নের কথা চিন্তা না করে; হাওরবাসীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির জন্য সরকারী বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা নিজেদের বেষ্টনীর জন্য ভাগ করেছে সে সেসব লুটেরা যেন নতুন করে বরাদ্দকৃত ত্রাণের মধ্যেও আবার ভাগ না বসায়! আপনার মঞ্চে যেন তাঁরা চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে আপনার বক্তব্যে অতি উৎসাহী হয়ে হাততালি দিয়ে দুর্গতদের নিয়ে তামাশা না করে। আর এদের বিচার ও যেন সত্যিকারে হয়।

যদি তা করতে পারেন তবে দুঃখি মানুষ একটু হলেও হাসবে, আপনার উপর তাঁদের আস্থা ও সম্মান দুটিই বাড়বে। কারণ চৈত্রের আগাম অতিবৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এই হাওরের মানুষ ড. জয়া সেনকে আপনার দেয়া নৌকাকে এইতো সে দিন তাঁরা বিজয়ী করেছেন।

আমি এর আগে অত্যন্ত বিশ্বাস নিয়ে পত্রিকায় লিখেছিলাম 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই পারেন হাওরে কৃষকের কান্নার জলের নিদানের ঢেউ থামাতে' শিরোনামে। জানিনা একথাগুলো আপনার কাছে যাবে কিনা? যারা হাওরের ইজারার নামে বুর্জোয়া বেশে সব খাই এর দলে তাঁদের কাছ থেকে সেটা বাতিল করে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে হাওরবাসী স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দেয়া সেটা করুণা নয়, সময়ের দাবি।

তাছাড়া ঋণ, সুদ, বিদ্যুত বিলের বোঝা সহ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হাওরবাসী যেন শহরের বাড়তি বোঝায় পরিণত না হয় সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার।

নগরবিদদের মতে, শুধু ঢাকাতে ৩০ লাখ লোক বসবাস করার সক্ষমতা থাকলেও এখন সেখানে দেড়কোটির ও বেশী লোক বাস করছে! পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় ঢাকা মহানগরে প্রতিদিন ১ হাজার ৪ শত ১৮ জন মানুষ বাড়ছে ফলে বছরে যুক্ত হচ্ছে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ জন। হাওর দুর্যোগ যদি পুশ ফ্যাক্টর হিসেবে মানুষকে শহরমুখী করে তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে?

এছাড়া ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়,পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে হাওর অঞ্চলে খর্বকায় মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাওর অঞ্চল থেকে দক্ষ মানবসম্পদ প্রাপ্তির বিষয়টিও আজ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এজন্য হাওর অঞ্চলের জন্য পৃথক ভাবে ভাবার সুযোগ রাখে।

পরিবেশ বিষয়ের তাত্ত্বিকরা পরিবেশবাদের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের ৮০% ভোগ এবং উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্রকে বিবেচনায় পরিবেশ বিপর্যয়ের যে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন তার ভয়াল থাবা যে আজ হাওরে আঘাত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে সরকার না ভাবলে নিকট ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে।

  • মো. আব্দুল মতিন: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর,সুনামগঞ্জ।
  • এবিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত