রওশন আরা বেগম

০১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ২০:১৬

ধর্মনিরপেক্ষতা!

সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম নিরপেক্ষতা। আর এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। কারণ রাষ্ট্রের এই মূল নীতিই ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে মানুষকে মানবিক ও ইহজাগতিক নাগরিকে পরিণত করে।

ব্যক্তির ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা না হলেও এর চরিত্র অন্য রকম যা আজ ধর্মাশ্রয়ী মানুষের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা কী বুঝি? ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ যদি ব্যক্তির ইহজাগতিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে তাহলে ব্যক্তি যদি নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য ঐ সব বিধিনিষিধ উপেক্ষা করে নিজস্ব স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটায় সেই ক্ষেত্রে তাকে সেক্যুলার ধরা হবে।

তবে একজন ধার্মিক মানুষ কতটা সেক্যুলার হতে পারে? এক ধর্মে যেটা হারাম করা হয়েছে অন্য ধর্মে সেটা হালাল করা হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া হারাম আর ইসলাম ধর্মে সেই গরুর মাংস খাওয়াকে হালাল করা হয়েছে। তেমনি এক ধর্মে মুর্তিপুজা হারাম আর অন্য ধর্মে সেই মুর্তিপুজাকে ধর্মের অংশ বলে ধরা হয়। এই অবস্থায় দুই ধার্মিকের সহাবস্থান কিভাবে সম্ভব হবে?

এ রকম তীব্র বিপরিত অবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করবে আইনের মাধ্যমে। আর এই আইন কোন ধর্মাশ্রয়ী আইন নয়। এই অবস্থা রাষ্ট্রীয় আইন মেনে নিয়েই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্ম পালন করতে পারবে। এর মধ্যে যদি এক ধর্মের কাজকর্মের কারণে অন্যের ধর্মানুভুতিতে আঘাত আসে সেই ক্ষেত্রে কি হবে? সেই ক্ষেত্রে একমাত্র ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রই নাগরিককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড দিবে, যা সৌদি আরব করে যাচ্ছে। আর ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।

এখন সেক্যুলারিজম এর বিকাশ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ইউরোপের রেনেসাই হলো ইহজাগতিকতার বিকাশ। এর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তি তর্কের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ধর্মীয় পীড়নের বিরুদ্ধে একটা জাগতিক মানবতাবাদী জনগোষ্ঠির প্রতিবাদ শুরু হলো। স্ত্রী পুরুষের যৌন মিলন ছাড়াই মেরীর পেটে যিশুর জন্ম হয়। আর সেই যীশুর হাতেই নানান মীরাকেল ঘটনা ঘটে। এই সবই একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের কাছে মিথ ছাড়া আর কিছু নয়।

ইউরোপের মানুষের ধারণায় ও ক্রিয়াকলাপে সেক্যুলারিজম নিশ্চিতভাবে রূপ পেতে থাকে রেনেসার সময় থেকে। আর তখন থেকে ইউরোপে আধুনিকতার সুত্রপাত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ, মানুষ হিসাবে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। এটা মানুষের মানবমুখী মনোভবের যাত্রা।

এটাই ইহজাগতিকতার সাথে সম্পর্কযুক্ত মানব জীবন। প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, মন্ত্র- তন্ত্র ইত্যাদির দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মানুষের চিন্তা ও কর্মকে মুক্তি দিয়ে জাগতিক সকল বিষয়ে তাকে উতসাহিত করাই সেক্যুলারিজম।

সব ধর্মের সহাবস্থানই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয় না। ইহজাগতিক ভাবনার ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রয়োজন অপরিসীম। আর এই ধর্মের থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা আধুনিক রাষ্ট্রের মূলনীতি বলেই স্বীকৃত হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অসত্য। ধর্মের সাথে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই বোঝায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, পরলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন তবে ইহজাগতিকতাই রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম।

ধর্ম থাকতে পারে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে। রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে সেই সাথে ধর্মহীন বা নাস্তিকের অধিকারও নিশ্চিত করবে সমানভাবে। তবে রাষ্ট্রের সাথে কোন ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না। একজন নাস্তিক ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে তার মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে আর সেই অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে আমি আধুনিক বলছি এই কারণে যে ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে আধুনিকতার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। কারণ ইহজাগতিক তাই হলো রাষ্ট্রের মূল সূত্র। ধর্মনিরপেক্ষতাই ইহজাগতিকতার দিকে নিয়ে রাষ্ট্রকে আধুনিক করে আর মানুষকে সংস্কার মুক্ত করে উন্মুক্ত চিন্তার দ্বার খুলে দেয়।

এখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু বলতে চাই। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয় এই দোহাই দিয়েই বাংলাদেশকে আস্তে আস্তে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষণাপত্রে আদেশ বলে সংবিধানের প্রস্তবনার পূর্বে ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’’ যুক্ত হলে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এলো সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’ এরই ধারাবাহিকতার পথ ধরে ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন।

রাষ্ট্র একটা ইহজাগতিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কোন পারলৌকিকগত কোন ধর্ম থাকতে পারে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই বলেই রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের এই কাজকে গুরুতর অপরাধ হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে।

সিরিয়া, সংযুক্ত আরোব আমিরাতের মত দেশগুলো রাষ্ট্রের কোন ধর্ম রাখে নাই। সেখানে বাংলাদেশের মত বহু ধর্ম বর্ণ মিশ্রিত দেশে কিভাবে তা সম্ভব হলো? আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই ধর্মীয় রাজনীতিকে বাতাস দিয়ে আরো বেগবান করে তুলছে। তাই শুরু হয়েছে নাস্তিক নিধন। অবিশ্বাসীদের বাঁচার অধিকার নেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ধর্মীয় জঙ্গিরা এক এক করে হত্যা করে যাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার মানুষদের। ধার্মিক সরকার এই বিষয়ে একেবারেই নীরব ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই ধর্মকে আশ্রয় করে বাংলাদেশে ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠছে। যেমন বাইতুল মোকাররাম একটা সরকারী কেন্দ্রীয় মসজিদ। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউণ্ডেশন আর একটি সরকারী সংস্থা। এই ভাবে ধার্মিক রাষ্ট্রের সহযোগীতায় অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে যা ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিপন্থি।

উন্নত দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার একটা উদাহারণ দিয়ে এই লেখাটি শেষ করতে চাই। এই বছরের গোড়ার দিকে কানাডার অটোয়ার মেয়র তার অফিসে ধর্মযাজক ডেকে এনেছিলেন কিছু ধর্মীয় কাজে। এই খবরটি চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হাই কোর্ট থেকে তলব করা হলো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে মেয়র এই কাজটি কেন করেছেন, যা ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিপন্থি।

অবশেষে মেয়রকে কোর্টে হাজিরা হয়ে ক্ষমা চেতে হয়েছে কৃত কর্মের জন্য।

রওশন আরা বেগম : কানাডা প্রবাসী লেখক।

("ধর্মনিরপেক্ষতা" অমীমাংসিত এক আলোচনা। এ নিয়ে আমরা আরও কিছু লেখা প্রকাশ করতে চাই। প্রিয় পাঠক, আপনিও লিখুন। নিজের পরিচয় আর ছবি সহ পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেইল [email protected] ঠিকানায়।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত