লোকমান আহমদ চৌধুরী

২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ২০:৩৫

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসায় আইন কোনো বাধা নয়

গুরুতর অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে হর্তাকর্তারা আমাদেরকে আইন দেখাচ্ছেন। তাদের চোখ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে সাপলুডু খেলায় মেতে উঠে জাতিকে যে আইন দেখাচ্ছেন সেই আইনের ৪০১ ধারায় এব্যাপারে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

ফলে সরকারই পারে খালেদা জায়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে। এখানে আইন কোনো বাধা নয়।

বেগম খালেদা জিয়া আজ এত অসুস্থ যে তা লেখনীর মাধ্যমে বা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তার চিকিৎসকদের প্রেসকনফারেন্সের বদৌলতে সকলেই তা জেনেছেন। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে উন্নত চিকিৎসা। ডাক্তাররা পরিষ্কার করে বলেছেন, আমরা যা কিছু করা সম্ভব তা করেছি। আমাদের কাছে সেই উন্নত প্রযুক্তি নেই যা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও গণতন্ত্রের জন্য তাকে কারারুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়াকে কেন আটক করে রাখা হয়েছে সেটি আমার চেয়ে দেশবাসী আপনারা অনেক ভালো জানেন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে তাকে আটক করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ একাত্তরের পর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু করেছিল। শুধু বিচ্ছিন্ন হয়নি, তারা জনগণের ওপর নিপীড়ন করেছে, নির্যাতন করেছে। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা সেগুলো ভুলে যাইনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে এবং সেখান থেকে এখন পর্যন্ত সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে সংবিধানকে এখন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে আজকে কেউ কথা বলতে পারে না। আজকে কারও অধিকার নেই, বাক স্বাধীনতা নেই। আজকের বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বিদেশে নিয়ে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ আইনে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে- সরকারের তরফে এমন একটি আশ্বাসে ঘুরানো হচ্ছে বিএনপিকে। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে যেতে তার পরিবার ও দল থেকে বারবার আবেদন করা হচ্ছে। ৭৬ বছর বয়সি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত। করোনা আক্রান্ত হয়ে খালেদা জিয়া ৫৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তখন তাকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে; যা তার মতো একজন বয়স্ক মানুষের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

গত ১২ অক্টোবর খালেদা জিয়া নতুন উপসর্গ নিয়ে আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন তার একটি বায়োপসি করা হয়। কিছুদিন বাসায় থাকার পর ১৩ নভেম্বর আবারও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এবার রক্তদানের পাশাপাশি তার এন্ডোস্কপিও করা হয়েছে। টানা ২৬ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ৭ নভেম্বর বাসায় ফেরেন তিনি। এর ছয় দিনের ব্যবধানে খালেদা জিয়াকে আবার ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর ১৪ নভেম্বর দিবাগত রাত থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে সিসিইউতে রাখা হয়েছে। এ রোগের চিকিৎসা সব দেশে নেই। তা সম্ভব কেবল  যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালে।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৫ মার্চ সরকার শর্তসাপেক্ষে সাজা স্থগিত করে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। এরপর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করে করে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়৷ সর্বশেষ ১১ নভেম্বর খালেদা জিয়ার পুত্রবধু শর্মিলা রহমান খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর আবেদন করেন৷ এর আগে ৬ মে বিদেশে পাঠানোর আবেদন করা হলেও তা নাকচ হয়৷

 সেটা আইন ও ক্ষমতার আলোকে প্রধানমন্ত্রীই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী চাইলে হয় না, বাংলাদেশে এমন কিছু নেই- এমনটি আর দেশে বিতর্কের বিষয় নয়। এর জলন্ত প্রমান পর্যাপ্ত। বিশ্বাসীও প্রচুর রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

সাংবিধানিকভাবে তার ক্ষমতা এতই যে, তিনি শুধু প্রাকৃতিক বিষয়গুলোর বাইরে সব করতে পারেন। অর্থাৎ তিনি চাইলেই বিএনপির দাবি অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়া সম্ভব। বিষয়টা নির্ভর করছে তার চাওয়া-না চাওয়ার ওপর।

উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়া নিয়ে বিতর্কের ঢেউয়ের মধ্য নানা কথা যোগ হচ্ছে। আইনি মারপ্যাঁচের বাহাসে সরকার থেকে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেই খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে পারবেন। খালেদা জিয়াকে জেলখানায় গিয়ে আবার আবেদন করার মতো নিষ্ঠুর পরামর্শও বাতলানো হচ্ছে।

সরকার সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার নজির নেই দাবি করলেও বাস্তবে এমন নজির রয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত জাসদ নেতা আ স ম রবকে ১৯৭৯ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানি নেয়া হয়েছিল। একই কারণে ২০০৮ সালে মোহাম্মদ নাসিম ও আবদুল জলিলকেও বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। ওই ক্ষেত্রে মানবিক বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিলে সবার আগে। সেই উদাহরণ টেনে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০১ ধারার বিধানমতে, সরকার শর্তহীন বা শর্তযুক্তভাবে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ করতে পারেন। এ আইনেই বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময় এটার পরিবর্তন, সংযোজন এবং অন্য কোনো শর্ত আরোপ করতে পারেন। অর্থাৎ এটা সম্পূর্ণভাবে সরকারের এখতিয়ার।

বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। উচিৎ নয়। এরপরও সরকারি মহল থেকে রসিকতা - মশকরা চলছে, যা নিন্দনীয়।

তার চিকিৎসকরা বলছেন,  দেশে চিকিৎসা করে খালেদা জিয়াকে সুস্থ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই তাকে বিদেশে উন্নত কোনো মেডিক্যাল সেন্টারে দ্রুত স্থানান্তরের কথা আসছে।

মেডিক্যাল বোর্ড স্পষ্টভাবে বলেছে যে, উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হতে হতে আজকের এ অবস্থা তার। খালেদা জিয়া তার পুরানো জটিল রোগগুলো ছাড়াও ডিকমপেন্স্যাটেড লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীর থেকে রক্ত যেতে যেতে তার হিমোগ্লোবিন একেবারে কমে গেলে এবং রক্তবমি হতে থাকলে তাকে এবার হাসপাতালে নেয়া হয়।

মারুফ কামাল খানের অভিযোগ: বেগম জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ এবং হার্ট, কিডনি ও চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি নিয়মিত চিকিৎসাধীন ও চিকিৎসকদের তদারকিতে ছিলেন। তাকে জেলে নেয়ার পর সব বন্ধ হয়ে যায়। সেই বিবেচনায় পরিবার ও দল থেকে বলা হচ্ছে, তাকে তিলে-তিলে শেষ করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে।

জবাবে মন্ত্রী পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিলে, সেখানে মা-ছেলে মিলে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন৷ কথার পিঠে কথার অভাব নেই। যে কারো বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে এ ধরনের বাহাস দুঃখজনক।  সবক্ষেত্রে নীতিহীনতার চর্চা আমাদের ভবিষ্যতকে কেবল আরো অন্ধকারই করছে। সর্বাপরি জনগনের জন্য আইন- আইনের জন্য জনগণ নয়। তাই প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে হলেও খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। এটা শুধু মানবিক দিক নয় বরং সাংবিধানিক অধিকারও বটে।

রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার বাইরেও অনেক মানুষ আছেন, যারা সমাজের প্রতি তাদের দায় অনুভব করেন। প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়ান। তারা রাজনীতিবিদ নন। তারা মানবিক। অবশ্যই মানবিকতাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। জনগণের বা ব্যক্তির অধিকারের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হতে দেয়া যায় না।

আশাকরি বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সরকার মানবিক ব্যবহার করবে। সব রাজনৈতিক  ভেদ-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবিকতার জয় হবে। যেমরটি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন- ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়টি বিবেচনা করুন’।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ও সদস্য জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, সিলেট।

(লেখায় প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত