মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১৯ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১০:০৫

জীবনে শুদ্ধতার মিরাজুন্নবী

মহানবীর (সা.) মেরাজ কেন হয়েছিল? মেরাজের নিগূঢ় রহস্য কী? এসব প্রশ্নের জবাব একমাত্র মহান আল্লাহই ভালো জানেন। এরপরও পবিত্র কোরআন, সহিহ হাদিস, ইতিহাস এবং সমসাময়িক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে কতগুলো কারণ বের হয়ে আসে। যেমন মহানবীর (সা.) জন্মের আগেই পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। জন্মের ৫ কিংবা ৬ বছর পরে মাতা আমিনার মৃত্যু হয়। পিতামাতার ইন্তেকালের পর তিনি দাদা আবদুল মোত্তালেবের কাছে লালিত-পালিত হন। মহানবীর (সা.) বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন হলো, তখন দাদাও মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর তিনি চাচা আবু তালেবের কাছে লালিত-পালিত হন।

মহানবী (সা.) যুবক হলে খাদিজার (রা.) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ৪০ বছর বয়সে মহানবী (সা.) নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন। ১০ বছর গোপন ও প্রকাশ্যে ওহির দাওয়াত প্রদান করলেন। নবুয়তের ১১তম বছরে কাফেররা মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করল। এ কঠিন সময়ে মহানবী (সা.) এর ঢাল ছিলেন চাচা আবু তালেব। তিনি স্বীয় ক্ষমতার প্রভাবে কাফেরদের অত্যাচার থেকে মহানবীকে (সা.) রক্ষা করতেন। ঘরের ভেতরে খাদিজা (রা.) মহানবীর (সা.) দুঃখ দূর করার জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতেন। মহান আল্লাহর কী ইচ্ছা! এ বছরে অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে আবু তালেব ও খাদিজা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মৃত্যুতে রাসূল (সা.) শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। হৃদয়ের সুপ্ত বেদনাগুলো দূর করার জন্য তখন আল্লাহ মহানবীকে (সা) তার একান্ত সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন। আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.) বলেন, 'একদিকে নবীর (সা.) দাওয়াতি কাজের সফলতা আর অন্যদিকে নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের চরম পর্যায় অতিক্রম হচ্ছিল। এ দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থায় দূরদিগন্তে মিটমিট করে জ্বলছিল তারকার মৃদু আলো, এমনি সময়ে মেরাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল।'

সূরা ইসরার শুরুতে মাত্র একটি আয়াতে আল্লাহ পাক ইসরা ও মেরাজের এ ঘটনা এবং তার উদ্দেশ্য অতীব সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। ইহুদিদের অপকীর্তির ভবিষ্যৎ পরিণাম (ফল) বর্ণনা করেছেন। এখানে মক্কা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ করানোর তাৎপর্য হতে পারে এই যে, অতিসত্বর পৃথিবীতে ইহুদিদের কর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বায়তুল মোকাদ্দাস ও পৃথিবীতে সর্বত্র মুসলিমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৫ হিজরিতে এটা বাস্তবায়িত হয় ওমর ফারুকের (রা.) হাতে বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয়ের মাধ্যমে রাসূলের (সা.) মৃত্যুর চার বছরের মাথায়। উল্লেখ্য যে, ইহুদি থেকে মুসলমান হওয়া সাহাবি কাব আল আহবাবের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ছাখরাকে পেছনে রেখে সালাত আদায় করেন, যেখানে মেরাজের রাতে রাসূল (সা.) সালাত আদায় করেছিলেন। (আহমাদ, ইবনে কাছির)।

অতঃপর তৎকালীন বিশ্বের সব পরাশক্তি মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়। এরপর উমাইয়া ও মিসরের ফাতেমীয় খেলাফত সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে। সর্বশেষ তুরস্কের ওসমানি খেলাফত বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মাত্র ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। মুসলমান আবারও তার হারানো কর্তৃত্ব ফিরে পাবে যদি সে ইসলামের পথে ফিরে আসে। সূরা ইসরায় বিশ্ববিজয়ের এ ইঙ্গিতটি দেয়া হয়েছিল এমন একটি সময়ে যখন রাসূল (সা.) মক্কার পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এতে বোঝা যায় যে, মূল বিজয় নিহিত থাকে সঠিক আকিদা ও আমলের মধ্যে, অর্থবিত্ত ও জনশক্তির মধ্যে নয়। মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হয় ১২ নববি বর্ষের হজের মৌসুমে আকাবায়ে উলার কিছু আগে অথবা ১৩ নববি বর্ষের হজের মৌসুমে অনুষ্ঠিত আকাবায়ে কুবরার আগে। অর্থাৎ মেরাজের ঘটনার পরপরই ইসলামী বিপ্লবের পূর্বশর্ত হিসেবে ইমারত ও বায়াতের ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয় মিনা প্রান্তরে এবং তার পরেই তিনি মদিনায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখানে ইসলামী সমাজের রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়।

মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় আল্লাহ প্রদত্ত সর্বশেষ দ্বীন হলো ইসলাম। দ্বীন (ইসলাম) প্রচার করা ছিল নবীর (সা.) দায়িত্ব। তিনি মানুষ ও জিনজাতিকে জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন অর্থাৎ যারা দ্বীন গ্রহণ করবে তারা আখেরাতে জান্নাত লাভ করবে, আর যারা দ্বীনকে অস্বীকার করবে তারা আখেরাতে জাহান্নামে যাবে। রাসূলের (সা.) ঈমান সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাত, জাহান্নাম, ফেরেশতা, হাওজে কাউসার ইত্যাদি দেখিয়েছেন। কেননা সংবাদ কখনও সচক্ষে দেখার মতো হয় না। অদৃশ্য জগতের যেসব খবর নবীদের মাধ্যমে জগদ্বাসীর কাছে পৌঁছানো হয়, ওহির মাধ্যমে প্রাপ্ত সেসব খবর এর সত্যতা সচক্ষে যাচাইয়ের মাধ্যমে রাসূল (সা.)-সহ বিশ্ববাসীকে নিশ্চিতভাবে আশ্বস্ত করা হলো।

রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাসূল হলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাকে মেরাজে নিয়েছেন। আগে ইবরাহিম ও মুসাকে (আ.) দুনিয়াতেই আল্লাহ স্বীয় কুদরতের কিছু নমুনা দেখিয়েছেন। (সূরা আনআম : ৭৬; ত্বহা : ২৩)। আর আমাদের নবী (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'এ রাসূলদের মধ্য থেকে আমি কাউকে কারও ওপর প্রাধান্য দিয়েছি।' (সূরা বাকারা : ২৫৩)। কেবল আমাদের নবীকে আখেরাতের দৃশ্য দেখিয়ে প্রমাণ করা হলো যে, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী। আগে কেউ এ সুযোগ পায়নি এবং কখনও পাবে না। পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিস গবেষণা ও অনুসরণের মধ্যেই দুনিয়ায় সর্বোচ্চ উন্নতি এবং আখেরাতে মুক্তি ও সম্মান পাওয়া সম্ভব। অন্যপথে মানব জাতির সত্যিকারের উন্নতি ও মঙ্গল নিহিত নেই। বস্তুত মেরাজের পথ ধরেই মানুষ দুনিয়াতে কেবল চন্দ্রবিজয় নয়, বরং এর চেয়ে বড় বিজয়ের পথে উৎসাহিত হতে পারে। একইভাবে সে আখেরাতে জান্নাতুল ফেরদাউস লাভে ধন্য হতে পারে। মেরাজে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত উপহার দেয়ার মাধ্যমে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও ভীতিপূর্ণ ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত সৎ মানুষ তৈরি হতে পারে এবং প্রকৃত অর্থে সামাজিক শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে। অতএব সমাজ বিপ্লবের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো, মানুষের মধ্যকার আত্মিক ও নৈতিক বিপ্লব সাধন। সালাতই হলো আত্ম সংশোধনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান।

আখেরি নবী মুহাম্মদকে (সা.) আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য নবীদের তুলনায় অনেকগুলো বিষয়ে অতিরিক্ত মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসরা ও মি’রাজ। তিনি মক্কা থেকে হিজরতের পূর্বেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়। মি’রাজের দিন তারিখ সম্পর্কে সিরাত গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন মতামত পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা মসহুর মত হচ্ছে- নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭ রজব। ইমাম নববী এবং ইমাম কুরতবীর মতে, নবুয়তের পাঁচ বৎসর পর ঘটেছিল মি’রাজ। ইমাম তাবারী উল্লেখ করেছেন, নবুয়তের প্রথম বৎসরই মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে। নবুয়তের দ্বাদশ বৎসর রামাদ্বান মাসে হয়েছে বলেও কারও কারও মত রয়েছে। কারও কারও মতে হিজরতের চৌদ্দ মাস পূর্বে নবুয়তের ত্রয়োদশ বৎসর মুহাররাম মাসে হয়েছিলো মি’রাজ। হিজরতের এক বৎসর পূর্বে রবিউল আউয়াল মাসে মি’রাজ হয়েছে বলেও মতামত পাওয়া যায়। ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা কুরআনে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও আংশিকভাবে এসেছে। বিস্তারিত ঘটনা বেশ কিছু হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে।

মক্কা শরীফের মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণকে কুরআন শরীফে ইস্রা (রাত্রিবেলার ভ্রমণ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, মহাপবিত্র সে সত্ত্বা, যিনি রাতের বেলায় তাঁর বান্দাকে ভ্রমণ করিয়েছেন, মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত- যার চতুর্পার্শ্বে আমি বরকত দিয়ে ভরে দিয়েছি, যাতে করে তাঁকে আমার কুদরতের নিদর্শনাদি দেখাবার সুযোগ দেই। নিশ্চয় তিনি প্রবল শ্রবণকারী ও দর্শনকারী- (ইসরা: ১)। আর মসজিদুল আক্বসা থেকে ঊর্ধ্বগমনের অংশটুকু মি’রাজ নামে অভিহিত হয়েছে হাদিস শরীফে। মি’রাজ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বগমন ইসরা ও মি’রাজ। মি’রাজের বিস্তারিত ঘটনাকে সংক্ষেপে নিম্নরূপে পেশ করা যায় :

নবী করীমকে (সা.) জিবরীল (আ.)-এর সাহচর্য সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। সেখানে অবতরণ করে নবী করীম (সা.) অন্যান্য নবীদের ইমাম হয়ে নামায আদায় করেন। অতঃপর সে রাতেই তাঁকে মসজিদুল আক্বসা থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। হযরত জিবরীর (আ.) দরজা খোলার জন্য আওয়াজ দিলে দরজা খোলা হয়। নবী করীম (সা.) হযরত আদমকে (আ.) দেখতে পেয়ে তাঁকে সালাম করলেন। আদম (আ.) প্রিয়নবীকে স্বাগত জানিয়ে সালামের জবাব দিলেন। তাঁর নবুয়তের স্বীকৃতি দিলেন। আল্লাহ তা’আলা তখন আদম (আ.)-এর ডান দিকে সমগ্র নেক্কারদের এবং বাম দিকে সমগ্র পাপীদের রূহসমূহ একত্রিত করে নবী কারীমকে (সা.) দেখালেন। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে গেলে দেখা হল ইয়াহিয়া এবং ঈসার (আ.) সাথে। তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে মুসা (আ.) এবং সর্বশেষ আসমানে ইবরাহীমের (আ.) সাথে সাক্ষাত হয়। এরপর নবী কারীমকে (সা.) আরও ঊর্ধ্বে নেয়া হয়, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার আওয়াজ কানে আসছিলো। অতঃপর আরও ঊর্ধ্বে সিদরাতুল মুনতাহার তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি আল্লাহর অতি কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। সে সময় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে যা যা দেবার তা দান করেন এবং পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দেন। ফেরার পথে হযরত মুসার (আ.) সাথে পুনরায় সাক্ষাত হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আল্লাহ তা’আলা আপনাকে কী নির্দেশ প্রদান করেছেন? তিনি বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ দিয়েছেন। মুসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মতের জন্য এটি কঠিন হয়ে যাবে। আপনি আল্লাহর কাছে আবার গিয়ে নামাযের পরিমাণ কমিয়ে দেয়ার দরখাস্ত করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) হযরত জিবরীল (আ.) এর প্রতি তাকিয়ে তাঁর মতামত চাইলেন। জিবরীল (আ.) ইতিবাচক সাড়া দিলে আল্লাহর কাছে ফেরত গিয়ে নামাযের সংখ্যা কামানোর আবেদন জানালেন। কমালো হলো। পুনরায় মুসা (আ.) আরও কমানোর জন্য পাঠালেন। এভাবে বারবার যাওয়া আসা করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ালো ফরয নামাযের সংখ্যা। হযরত মুসা (আ.) আরও কমানোর জন্য যেতে বললে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আর যেতে আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। যতটুকু হয়েছে, তা আমি সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি। কিছুদূর চলে আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, ‘‘আমার পক্ষ থেকে ফরয নামায চূড়ান্ত করে দিলাম, আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিলাম, ওয়াক্তের সংখ্যা পাঁচে নামিয়ে দিলাম; কিন্তু সওয়াব ৫০ ওয়াক্তেরই দেবো’’। বিস্তারিত বর্ণনার জন্য দেখুন: ফতহুল বারী ও তাফসীর ইব্ন কাছীর।

মি’রাজের অন্যতম প্রধান অর্জন হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায। এছাড়াও নবী কারীমকে (সা.) আল্লাহ তা’আলা জান্নাত, জাহান্নামের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী এবং আল্লাহর কুদরতের অনেক কিছু দেখান। জাহান্নামের প্রধান নিয়ন্ত্রক ফিরিশতাকে তিনি দেখলেন যে, তাঁর চেহারায় হাসি-খুশির লেশমাত্র নেই। জাহান্নামে অন্যায়ভাবে ইয়াতিমদের ধন সম্পদ আত্মসাৎকারীদেরকে দেখলেন, তাদের ঠোঁটগুলো উটের ঠোঁটের মত মোটা। তারা পাথরের ন্যায় জ্বলন্ত অঙ্গার মুখে প্রবেশ করাচ্ছে, আর তা তাদের নাড়িভুঁড়ি সব জ্বালিয়ে গুহ্যদার দিয়ে বের হয়ে আসছে।

জাহান্নামে তিনি ব্যভিচারীদেরকে দেখলেন যে, তাদের সামনে তাজা সুস্বাদু গোশত রয়েছে, তার পাশে রয়েছে পচা দুর্গন্ধময় গোশত। তারা তাজা ভাল গোশত রেখে পচাটাই খাচ্ছিল। যেহেতু দুনিয়াতে বৈধ স্বামী/স্ত্রী রেখে তারা পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত ছিল। সুদখোরদের দেখলেন, তাদের পেট ইয়া বড় সাইজের। জাহান্নামে তারা এমনভাবে পড়ে আছে যে, একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না। ফেরাউন এবং তার অনুসারীরা জাহান্নামে চলাচলের সময় তাদেরকে পদদলিত করছিলো। যেসব বিবাহিত মহিলাগণ তাদের স্বামী থাকা স্বত্বেও পরপুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে তাদের শাস্তি দেখতে পেলেন, তাদের স্তনে কড়া লাগিয়ে তাদেরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে বহুবিধ গুনাহ’র শাস্তি প্রদানের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যাতে তিনি উম্মতকে এসব বিবরণ শুনিয়ে সতর্ক করেন। হাদিস শরীফের বিভিন্ন অধ্যায়ে তা বর্ণিত হয়েছে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা, ৫ ওয়াক্ত ফরয নামাযকে যত্নের সাথে আদায় করা, সর্বোপরি শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণই হচ্ছে মি’রাজের সঠিক শিক্ষা ও তাৎপর্য।

এ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম না করে আমাদের সমাজে মি’রাজ উপলক্ষে সে রাতে বা দিনে বিশেষ ইবাদত করার যে প্রচলন আছে, তার স্বপক্ষে নবী কারীমের (সা.) কোন সহিহ হাদিস নেই। তিনি নিজে জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম মি’রাজ উপলক্ষে কোন বিশেষ ইবাদত করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই; এমন কি তাবেঈন, ইমাম আবু হানীফা বা প্রসিদ্ধ ইমামগণের কারো পক্ষ থেকেই এর স্বপক্ষে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর স্বপক্ষে যে হাদিসগুলো প্রচার করা হয়, হাদিস বিশারদ ওলামা ও আইম্মায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তার একটিও সহিহ নয়। কিছু কিছু হাদিস দ্বায়ীফ (দুর্বল) আর অধিকাংশই মাউদু (বানোয়াট)। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সুন্নতের উপর আমল করার তাওফিক দিন। বিদআত থেকে দূরে রাখুন।

নিঃসন্দেহে ইসরা ও মি’রাজ নবী কারীমের (সা.) জীবনে তথা ইসলামে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নবী করীম (সা.) জীবনে এমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। তবে শুধু গৎবাঁধা আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে বর্তমান পরিস্থিতির সাথে পর্যালোচনা করার মধ্যে নিহিত রয়েছে আমাদের জন্য অধিকতর শিক্ষণীয় ও করণীয় কাজ। মক্কা মুকাররামার মসজিদুল হারাম থেকে রাতের বেলার এ ভ্রমণের স্থলপথের যাত্রাবিরতি ঘটেছিল ফিলিস্তিনের মসজিদুল আক্বসাতে। সেথায় আল্লাহ তা’আলা সমস্ত নবীদেরকে একত্রিত করে আখেরি নবী মুহাম্মদের (সা.) ইমামতিতে দু’রাকাত নামায পড়ার আয়োজন করেছিলেন। অতঃপর বাইতুল মাক্বদাস থেকে ঊর্ধ্বগমন। একেবারে আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যে। ভ্রমণের সে অংশটুকুর নাম হচ্ছে মি’রাজ। ইস্রা ও মি’রাজের এ সুন্দর ঘটনার আলোচনা করতে গেলে আজকে মুসলিম মিল্লাতের মনের মাঝে বিরাজ করে একরাশ শূন্যতা। মি’রাজের অন্যতম পবিত্র স্থান মুসলমানদের তৃতীয় পুণ্যভূমি বাইতুল মাক্বদাস ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার হয়ে আজ লাঞ্ছিত। ইস্রা ও মি’রাজের আলোচনায় আরেকটি বিষয় আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।

ঘটা করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মি’রাজ পালনের এ রেওয়াজটা এল কোত্থেকে? তার আগে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত। মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল কবে? মি’রাজ যে সশরীরে সংঘটিত হয়েছে স্বপ্নে বা মানসিকভাবে নয়, এ ব্যাপারটা কুরআন এবং হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু কোন সনে কোন মাসে বা কোন তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে ব্যাপারে মুসলিম ইতিহাসবিদগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। প্রখ্যাত সিরাতগ্রন্থ র্আবাহীকুল মাখতুমে আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী তন্মধ্যে ৬টি মতামত উদ্ধৃত করে বলেছেন-
১. নবুয়তের প্রথম বৎসরেই মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস এবং ফকীহ ইমাম তাবারী এ মতকে সমর্থন করেছেন।
২. নবুয়তের পাঁচ বৎসর পর মি’রাজ সংঘটিত হয়। ইমাম কুরতুবী ও ইমাম নববী এ মতকে সমর্থন করেছেন।
৩. নবুয়তের দশম বৎসর ২৭ রজব মি’রাজ সংঘটিত হয়। সম্ভবত এ মতটিই আমরা ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি।
৪. হিজরতের ৬ মাস পূর্বে নবুয়তের দ্বাদশ বৎসরে রামাদ্বান মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়।
৫. হিজরতের ১৪ মাস পূর্বে মুহাররাম মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়।
৬. হিজরতের এক বৎসর পূর্বে রবিউল আউয়াল মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়।

উল্লিখিত মতামতসহ প্রায় ১৪টি মতামত সিরাত বিশেষজ্ঞগণ ও ইসলামী ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করে গেছেন। তাহলে মি’রাজ কবে সংঘটিত হয়েছিল সে সন, মাস বা দিন তারিখটিই যেখানে অমীমাংসিত, সেখানে তা আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার সুযোগ কোথায়? দ্বিতীয়ত, মি’রাজ যেহেতু মক্কী জীবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) ১০ থেকে প্রায় ১৫ বৎসর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রতি বৎসর মি’রাজের রাত বা দিবস পালন করার জন্য নিজে কোন আমল করেছেন বা সাহাবায়ে কেরামকে করতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনদের জামানায় এমন কোন আমল চালু ছিল বলে কোন দলিল প্রমাণ আছে?

রাসুলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর পরবর্তী জামানায় এমন কিছুর চর্চা হলে তো মি’রাজের দিন তারিখ নিয়ে আর কোন মতভেদ থাকার কথা ছিল না। দিন তারিখের মতভেদটাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, উত্তম যুগে কোন কালেই মি’রাজের দিবস বা রাতে কোন ইবাদত অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে উম্মতের মধ্যে যখন থেকে বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটে, তখনই কোন এক সময়ে মি’রাজ পালনের এ রেওয়াজ শুরু হয়ে যায়।

মি’রাজের রাতের ফযিলত, বিশেষ নামাযের বিবরণ ও পরবর্তী দিন রোযা রাখার পক্ষে যে সমস্ত হাদিস বর্ণনা করা হয়, তার একটাও হাদিস বিশারদদের দৃষ্টিতে সহিহ বা নির্ভরযোগ্য নয়, বরং একান্তই দুর্বল ও বানোয়াট হাদিস। মউদু বা বানোয়াট হাদিসের ভিত্তিতে কোন আমল বা ইবাদত করা জায়েজ নয়। নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, কেউ যদি আমার ব্যাপারে মিথ্যা কথা রচনা করে হাদিস বলে বর্ণনা করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা যোগাড় করে-(বুখারী, মুসলিম)।

যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে- মি’রাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যতম পুণ্যভূমি বাইতুল মাক্বদাস ও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের অবসান ও ইরাকে মার্কিন হামলা ঠেকানোর জন্য এ বিশ্বের অনেক শান্তিকামী সাধারণ মানুষ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ ও র‍্যালি চালিয়ে আসছে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দ্বীনের সহিহ জ্ঞানদান করুন। যাবতীয় বিদআত পরিহার করে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইবাদত ও আমল করার তাওফিক দিন। আমীন!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত