মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

২৬ জুন, ২০২৩ ০১:৪০

হালাল উপার্জন ও হারাম বর্জন

বৈধ ও হালাল উপার্জনের উপর নির্ভর করা এবং অবৈধ ও হারাম উপার্জন বর্জন করা মুসলিমের জন্য অন্যতম ফরয ইবাদত। শুধু তাই নয়, এর উপর নির্ভর করে তার অন্যান্য ফরয ও নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হওয়া বা না হওয়া। বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার কারণে অনেক মুসলিম এ বিষয়ে কঠিন বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত। অনেক ধার্মিক মানুষ রয়েছেন যারা সুন্নাত, মোস্তাহাব ইত্যাদির বিষয়ে অনেক সচেতন হলেও হারাম উপার্জনের বিষয়ে মোটেও সচেতন নন।
কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে এটি বক-ধার্মিকতা ছাড়া কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন : “হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবহিত।”

এখানে আমরা দেখছি যে, পবিত্র বস্তু হতে আহার করা সৎকর্ম করার পূর্ব শর্ত। বৈধ ও অবৈধতার দুইটি প্রকার রয়েছে। এক প্রকার খাদ্য স্থায়ী ভাবে অবৈধ। যেমন শুকরের মাংস, মদ, প্রবাহিত রক্ত, মৃত জীবের মাংস ইত্যাদি। এই প্রকারের অবৈধ খাদ্য বাধ্য হলে ভক্ষণ করা যাবে বলে কুরআন কারিমে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকারের অবৈধ খাদ্য উপার্জন সংক্রান্ত। সুদ, জুয়া, ঘুষ, ডাকাতি, জুলুম, যৌতুক, অবৈধ মজুদদারি, অবৈধ ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ওজনে-পরিমাপে কম দেওয়া, ভেজাল দেওয়া, প্রতারণা বা মিথ্যার মাধ্যমে ক্রয়বিক্রয় করা, চাকুরিতে চুক্তিমত দায়িত্ব পালন না করে বেতন নেওয়া, সরকারের বা জনগণের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করা ইত্যাদি এ জাতীয় অবৈধ খাদ্য। কুরআন-হাদিসে এ প্রকারের অবৈধ খাদ্য কোনো কারণে বা প্রয়োজনে বৈধ হবে বলে বলা হয়নি।

অবৈধ উপার্জন থেকে আত্মরক্ষার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, “তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করার জন্য তা বিচারকগণের নিকট পেশ করো না।”

সূরা নিসার ২৯ আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে,- “হে মু’মিনগণ, তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না; তবে তোমাদের পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ।”

এভাবে আমরা দেখছি যে, অন্যের ধন-সম্পদ বৈধ ইসলাম সম্মত ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যম ছাড়া গ্রহণ করাই অবৈধ। যে কোনো ভাবে অন্যের অধিকার নষ্ট করা অবৈধ। কুরআন ও হাদিসে বিশেষ কয়েক প্রকার অবৈধ উপার্জনের বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন উপরের একটি আয়াতে বৈধ ব্যবসায়িক লেনদেন ছাড়া অন্যের সম্পদ গ্রহণ নিষেধ করা হয়েছে। যৌতুক, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সকল জুলুম এর অন্তর্ভুক্ত। যৌতুকও অন্যান্য প্রকারের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসকর্মের মত অন্যের সম্পদ জোর করে বা চাপ দিয়ে গ্রহণ করা।

বিবাহের ইসলাম সম্মত লেনদেন হলো কনে বা কনে-পক্ষ পাত্র বা পাত্রপক্ষকে কিছুই দেবেন না। শুধুমাত্র কনেই পাত্রের ঘরে আসবে। আর পাত্রপক্ষ কনেকে মোহরানা প্রদান করবেন। বিবাহ উপলক্ষে ওয়ালিমার দায়িত্ব পাত্রের। এর বাইরে কোনো প্রকারের দাবি দাওয়া অবৈধ। এমনকি কনের পিতার ইচ্ছা ও আগ্রহের অতিরিক্ত ‘বরযাত্রী’র মেহমানদারী করতে তাকে বাধ্য করাও বৈধ নয়। আল্লাহ আমাদেরকে হারাম থেকে রক্ষা করুন।

উপরের অন্য আয়াতে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অন্যের সম্পদ গ্রাস করার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ বা অবৈধভাবে কোনো মুসলিমের অধিকার ছিনিয়ে নিবে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করবেন এবং জান্নাত তার জন্য নিষিদ্ধ করবেন।” এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল, যদি সামান্য কোনো দ্রব্য হয়? তিনি বললেন, “আরাক গাছের একটি কর্তিত ডালও যদি এভাবে গ্রহণ করে তাহলে এই শাস্তি।”

অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে বা জুলুম করে এক বিঘত পরিমাণ জমিন গ্রহণ করবে কেয়ামতের দিন তাকে সপ্ত পৃথিবী সহ সেই জমিন তার গলায় বেড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে।”

অন্যান্য আয়াত ও হাদিসে বিশেষত এতিম, সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা দুর্বল শ্রেণীর সম্পদ এভাবে গ্রাস করার নিষেধাজ্ঞা ও কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় যারা এতিমদের সম্পদ জুলুম করে ভক্ষণ করে তারা নিঃসন্দেহে তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষণ করে এবং তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।”(সূরা নিসা ১০ আয়াত।)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যদি কেউ কোনো অমুসলিম নাগরিক বা প্রবাসীকে জুলুম করে, তাকে অপমান করে, তাকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব প্রদান করে বা তার ইচ্ছা ও আগ্রহ ছাড়া তার নিকট থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করে তাহলে কেয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হব।

কুরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ অবৈধ লেনদেনের মধ্যে অন্যতম হলো, ওজনে বা মাপে কম দেওয়া, ভেজাল দেওয়া, ধোঁকা দেওয়া, ফাঁকি দেওয়া, সরকার বা জনগণের সম্পদ গ্রহণ করা, সুদ গ্রহণ বা প্রদান, ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান ইত্যাদি। ওজনে বা মাপে কম দেওয়া বা ভেজাল দেওয়ার নিষেধাজ্ঞায় এত বেশি আয়াত ও হাদিস রয়েছে যে, সেগুলি একত্রে উল্লেখ করার জন্য একটি পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন।

সূরা মুতাফফিফিন এর ১ম আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে, “ওআইল জাহান্নামের ভয়াবহ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে-পরিমাপে কম দেয়, এভাবে কুরআন কারিমে বারংবার পূর্ণরূপে ওজন, মাপ ও পরিমাপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সকল প্রকারের ফাঁকি, কমতি বা কম প্রদানের কঠিন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে। এরূপ করলে পৃথিবীতে কঠিন গযব ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: “যখন কোন সম্প্রদায়ের মানুষেরা মাপে-ওজনে বা পরিমাপে কম বা ভেজাল দিতে থাকে, তখন তারা দুর্ভিক্ষ, জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও প্রশাসনের বা ক্ষমতাশীলদের অত্যাচারের শিকার হয়।”

অন্য যে বিষয়টি হাদিস শরীফে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে তা হলো ফাঁকি, ধোঁকা প্রবঞ্চনা বা ভেজাল দেওয়া। প্রস্ততকারক সংস্থা বা দেশের নাম পরিবর্তন করা, উপাদান-উপকরণ হিসেবে পণ্যের লেবেলে যা লেখা তার অন্যথা করা ইত্যাদিও এই ‘গিশ্শ’-এর অন্তর্ভুক্ত। যে কোনো প্রকারে ধোঁকা দেওয়া বা প্রকৃত অবস্থা গোপন করার নামই গিশ্শ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) গিশ্শ বা প্রবঞ্চনা থেকে নিষেধ করেছেন।

এক হাদিসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: যে ব্যক্তি আমাদেরকে ফাঁকি বা ধোঁকা দিবে আমাদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।”

অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে গ্রহণ ও প্রবঞ্চনা উভয়ের একত্রিত একটি রূপ হলো, চাকুরিজীবীর জন্য কর্মে ফাঁকি দিয়ে পুরো বেতন গ্রহণ করা। সরকারি বা বেসরকারি যে কোনো কর্মস্থলে কর্মদাতার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, কর্মে অবহেলা ইত্যাদি সবই এই পর্যায়ের।

কুরআন ও হাদিসে নিষিদ্ধ একটি বিষয় হলো গুলূল! সকল প্রকার অবৈধ উপার্জনকেই গুলূল বলা হয়। তবে বিশেষভাবে সরকারী বা জনগণের সম্পদ কোনো নেতা, কর্মকর্তা, কর্মচারী বা নাগরিক কর্তৃক দখল, গ্রাস বা ভক্ষণ করাকে গুলূল বলা হয়। পাপী ছাড়া কোনো নবী-রাসূল বা কোনো সৎ মানুষের জন্য এভাবে সরকারী বা অন্যের ধন সম্পদ গোপন করে গ্রাস করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন: “কোনো নবীর পক্ষে অসম্ভব যে তিনি অবৈধভাবে কিছু গোপন করে গ্রাস করবেন। এবং কেউ অবৈধভাবে কিছু গোপন করে তাহলে কেয়ামতের দিন সে তা নিয়ে আসবে। অতঃপর প্রত্যেককে যা যে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে। তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।”

অবৈধ উপার্জনের অন্যতম পদ্ধতি ঘুষ। যে ব্যক্তি কোনো কর্মের জন্য বেতন, সম্মানী বা ভাতা গ্রহণ করেন, সেই কাজের জন্য ‘সেবা গ্রহণকারী’, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা অন্য কারো থেকে কোনো প্রকার হাদিয়া, বখশিশ বা বদলা নেওয়াই ঘুষ। এ ছাড়া নেতা, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিচারক প্রমুখকে তাদের কৃপাদৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য যে হাদিয়া প্রদান করা হয় তাও ঘুষ বলে হাদিস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, “ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষদাতাকে লানত অভিশাপ করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)।”

অবৈধ উপার্জনের অন্যতম হলো রিবা বা সুদ। ঋণ হিসাবে প্রদত্ত অর্থের উপরে সময়ের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণই ইসলামী শরীয়তে সুদ। এছাড়া একই জাতীয় দ্রব্যের লেনদেনে কমবেশি করাও ইসলামে সুদ বলে গণ্য। কুরআন ও হাদিসে অত্যন্ত কঠিনভাবে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা বাকারাহ-এর ২৭৫-২৭৯ আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে, “যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তির মত দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে। তা এজন্য যে, ‘তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মত।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন। যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার বিষয় আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা (এই নিষেধাজ্ঞার পরে) পুনরায় (সুদের কারবার) আরম্ভ করবে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না।ৃ হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বাকি আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মু’মিন হও। যদি তোমরা তা না ছাড় তবে জেনে রাখ যে, ইহা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ।”

বিভিন্ন হাদিসে সুদের পাপের ভয়াবহতা ও ঘৃণ্যতা বুঝাতে বিভিন্ন উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে সুদকে ব্যভিচারের চেয়ে জঘন্যতর ও ভয়ঙ্করতর পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হারাম উপার্জনের অন্যতম ভয়াবহ দিক হলো, হারামের পাপ ছাড়াও এর কারণে অন্যান্য ইবাদত কবুল হয় না। বিভিন্ন হাদিসে বারংবার তা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “হে মানুষেরা, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (বৈধ) ছাড়া কোনো কিছুই কবুল করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনগণকে সেই নির্দেশ দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নবী ও রাসূলগণকে দিয়েছেন ৃ এরপর তিনি একজন মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি (হজ্ব, উমরা ইত্যাদি পালনের জন্য, আল্লাহর পথে) দীর্ঘ সফরে রত থাকে, ধূলি ধূসরিত দেহ ও এলোমেলো চুল, তার হাত দু’টি আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে দোয়া করতে থাকে, হে প্রভু! হে প্রভু !! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, তার পোশাক হারাম, তার পানীয় হারাম এবং হারাম উপার্জনের জীবিকাতেই তার রক্তমাংস গড়ে উঠেছে। তার দোয়া কিভাবে কবুল হবে!

অন্য হাদিসে তিনি বলেন : “বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোনো প্রকার ইবাদত আল্লাহর নিকট উঠানো হয় না।”

তিনি আরও বলেন : “ওযু-গোসল ছাড়া কোনো নামায কবুল হয় না, আর অবৈধ সম্পদের কোনো দান কবুল হয় না।”

মুহতারাম হাযেরীন, অবৈধ উপার্জনে আল্লাহ বরকত দেন না। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি বৈধ পন্থায় ধনসম্পদ গ্রহণ করে তার সম্পদে বরকত দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি অবৈধভাবে কোনো সম্পদ গ্রহণ করে তার উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মত যে খায় অথচ পরিতৃপ্ত হয় না।

বিভিন্ন হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কোনো পাপ দিয়ে অন্য পাপ মোচন করা যায় না। এজন্য অবৈধ উপার্জন থেকে ব্যয় করলে আল্লাহ বরকত দেন না। উত্তরাধিকারীদের জন্য তা রেখে গেলে তা তার নিজের জাহান্নামের পাথেয় হয়। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে ব্যক্তি অবৈধভাবে সম্পদ স য় করে এরপর তা দান করবে, সে এই দানের জন্য কোনো সাওয়াব পাবে না এবং তার পাপ তাতে ভোগ করতে হবে।”

ইবনু আব্বাসকে (রা) প্রশ্ন করা হয়, ‘একব্যক্তি একটি প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিল। তখন সে জুলুম করে ও অবৈধভাবে ধনসম্পদ উপার্জন করে। পরে সে তাওবা করে এবং সেই সম্পদ দিয়ে হজ্জ করে, দান করে এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে।’ তখন ইবন আব্বাস বলেন, ‘হারাম বা পাপ কখনো পাপমোচন করে না। বরং হালাল টাকা থেকে ব্যয় করলে পাপ মোচন হয়।

ইবনু উমারকে (রা) বসরার এক গভর্নর প্রশ্ন করেন, আমরা যে এত জনহিতকর কাজ করি এর জন্য কি কোনো সাওয়াব পাব না? তিনি উত্তরে বলেন, আপনি কি জানেন না যে, কোনো পাপ কখনো কোনো পাপমোচন করতে পারে না? আপনাদের এইরূপ দান-খয়রাতের উদাহরণ হলো, এক ব্যক্তি এক হাজীর বাহন উটটি চুরি করে তাতে চড়ে জিহাদে শরীক হয়েছে, তার এই ইবাদত কি কবুল হতে পারে?”

শয়তান অনেক সময় মুমিনকে হারাম উপার্জনের ভয়াবহ পাপের দিকে প্ররোচিত করার জন্য তার মনে ওয়াসওয়াসা দিতে পারে যে, সুদ, ঘুষ, যৌতুক, চাঁদাবাজি, ভেজাল, ফাঁকি, কর্মে ফাঁকি, খিয়ানত ইত্যাদি হারাম কর্মের পাপ জিকির, নামায, তাহাজ্জুদ, তাওবা, দাওয়াত, জিহাদ ইত্যাদি ইবাদতের মাধ্যমে মাফ হয়ে যাবে। অথবা এভাবে উপার্জিত হারাম সম্পদের কিছু অংশ হজ্জ, উমরা, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিম, বিধবা, দরিদ্র ইত্যাদি খাতে ব্যয় করলে পাপমোচন হয়ে যাবে। এই চিন্তা যে কত ভয়াবহ তা আমরা উপরের হাদিসগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারি। শয়তান এইপ্রকারের প্ররোচনার মাধ্যমে মুমিনকে ত্রিবিধ ক্ষতির মধ্যে নিপতিত করছে। প্রথমত, তিনি এ সকল কঠিন মানুষের অধিকার জড়িত হারাম ও কবিরা গোনাহে লিপ্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, তার নামায, তাহাজ্জুদ, দোয়া, হজ্জ, দান ইত্যাদি ইবাদত আল্লাহর দরবারে গৃহীত হচ্ছে না এবং তিনি পরিশ্রম করেও সাওয়াব থেকে বি ত হচ্ছেন, কারণ তিনি আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিশ্রম না করে শয়তানের প্রবঞ্চনার ভিত্তিতে পরিশ্রম করছেন। তৃতীয় ও আরও মারাত্মক বিষয় হলো, হারাম ধনসম্পদ দান করে আল্লাহর নিকট সাওয়াব আশা করলে তাতে মুমিনের ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

আমাদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে যে ব্যক্তি প্রথম জীবনে হারাম ধনসম্পদ উপার্জন করেছেন, তার কি তাওবার ও মুক্তির কোনো উপায় নেই? হাযেরীন, কুরআন-হাদিস থেকে জানা যায়, যে সকল পাপে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা ছাড়াও মানুষের পাওনা বা হক্ক নষ্ট হয় সে সকল পাপ থেকে আন্তরিকতার সাথে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁর বিধান অবমাননার দিকটি ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু যার অধিকার নষ্ট হয়েছে বা ক্ষতি হয়েছে তার কাছ থেকে ক্ষমা লাভ ছাড়া তার বিষয়টি আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এজন্য তাদের সম্পদ ফেরত দিয়ে বা যে কোনোভাবে তাদের থেকে ক্ষমা নিতে হবে।

আমরা জানি যে, বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পাপে লিপ্ত ব্যক্তি অগণিত মানুষের ওজন কম দিয়েছেন, ঘুষ নিয়েছেন, সরকারের বা জনগণের সম্পদ গ্রাস করেছেন, কর্মে ফাঁকি দিয়েছেন। এখন তিনি কিভাবে তাদেরকে চিনবেন বা সম্পদ ফেরত দিবেন। এক্ষেত্রে তিনি চারিটি কাজ করতে পারেন: (১) সকল প্রকার অবৈধ উপার্জন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করবেন, (২) অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পূর্ণ অর্থ-সম্পদ মাজলুম বা যাদের থেকে অবৈধভাবে নিয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় ও দান করবেন। এতে কখনোই তিনি নিজের কোনো পুণ্যের আশা করবেন না। তবে হয়ত আল্লাহ দয়া করে এর সাওয়াব মাজলুমদেরকে প্রদান করবেন এবং তাকে পাপমুক্ত করবেন। (৩) আল্লাহর কাছে বেশি-বেশি ক্ষমা চাইবেন (৪) বেশি বেশি নেক কর্ম করবেন। হয়ত এগুলির মাধ্যমে আল্লাহর কেয়ামতের দিন তার ক্ষমার একটি ব্যবস্থা করতেও পারেন। সর্বাবস্থায় অন্যান্য হারামের চেয়ে উপার্জনের হারাম বেশি ভয়াবহ। অন্যান্য পাপের ক্ষমা লাভ সহজ, কিন্তু বান্দার হক্ক বা হারাম উপার্জনের ক্ষমা লাভ কঠিন। এজন্য মুমিন সর্বদা এই জাতীয় হারাম বর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকবেন।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে হারাম উপার্জন বর্জনের তাওফিক প্রদান করুন। আমিন!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত