শবনম সুরিতা

১৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০১

তবুও রাষ্ট্র, তবুও কাঁটাতার

“ডানা নন্দী মজুমদার!

বেজুড়াতে বাড়ি তার!”

এই দুটি লাইন সারাক্ষণ কানের সামনে একনাগাড়ে সুর করে আউড়ে যেত আমার ঠাকুমা। ততক্ষণ আউড়ে যেত যতক্ষণ না আমার মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে যায়। ঠিক গেঁথে গেছেও। সে কারণেই কেউ আদিবাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে এক মুহুর্তও না ভেবে ফস করে বলে দিতে পারি, “সিলেট! মাধবপুর থানা! বেজুড়া!” এমনই মহিমা ছোটবেলায় শোনা এই দুটি লাইনের। স্মৃতিতে অনড়, অবিচল।

২০১০ সালের এপ্রিলে বাবার সাথে প্রথমবার বাংলাদেশ গেলাম। ঢাকা, এবং পরে সেখান থেকে সিলেট। বাসে করে যাচ্ছি। হঠাৎ শুনি বাসের চালক বাস থামিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কী একটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে। বিরক্ত হলাম খানিক। সময় নষ্ট হচ্ছে। ভালো করে কান পাতলাম আবার তারপরঃ “মাধবপুর!” আমি হতবাক! উত্তেজনায় পাশে বসা বাবার হাত চেপে ধরলাম। বাবাও খেয়াল করেছিল। কিছু বলেনি।

ছোটবেলায় আমরা বড় হই রূপকথার গল্প শুনে। ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর কাহিনী শুনে আকাশ-পাতাল কল্পনা করি সেই বয়েসে। আমিও তাই করতাম। এখনও করিনা বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্ত আমার শৈশব, কৈশোর এমনকি এখনের সদ্যপ্রাপ্ত যৌবনের বিশাল অংশ জুড়ে আছে যে কল্পরাজ্য, তার নাম সিলেট, বাংলাদেশ। গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদ বা ঢাল-তরোয়ালের প্রয়োজন পড়েনি আমার এই কাহিনীর প্রেমে পড়তে। শুরু হয়েছিল মায়ের গলায় ছোটবেলা থেকে শুনে আসা, “পদ্মা রে আমার, সাধের পদ্মা, কও আমারে! আইজ মনবাঁশুরী কাইন্দা মরে তুমার বালুচরে, পদ্মা, কও আমারে!” দিয়ে। তারপর আজকাল তো আমিও গলা ছেড়ে গাই “এখানে রমণীরা নদীর মত, নদীও নারীর মত কথা কয়”। এই প্রেমকাহিনীর শেষ যে কোথায় তা এখনও জানিনা।

আমায় মাঝে মাঝে কিছু বন্ধুরা প্রশ্ন করেন কেন এই মাটির টান উপেক্ষা করতে পারি না আমি। আমার কাছে জুতসই কোন উত্তর সত্যিই নেই। যে দেশের নাগরিক নই, যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করিনি, তাকে কীভাবে নিজের বলে মেনে নেব? আমিও যে সেই মাটির একজন, এমন অধিকার কেই বা দিয়েছে আমায়? কিন্ত এতদিনে নিজের কাছে কিছু জিনিস একেবারে জলের মতন স্পষ্ট করে নিয়েছি। আপন-পর হিসেব করাটাও এখন একটা ছকের আয়ত্তে আনতে পেরেছি। আমার অঙ্ক খুব সোজা। রবিঠাকুরের ফর্মূলাই মেনে চলিঃ

“যে আমারে চিনতে পারে   সেই চেনাতেই চিনি তারে–

একই আলো চেনার পথে   তার প্রাণে আর আমার প্রাণে।।”

যেখানেই পাব আমার ভালোবাসার প্রত্যুত্তর, সেখানেই বাঁধা পড়ে যাই আমি প্রতিবার। আর বাংলাদেশ আর কিছু না হোক, মায়া দিয়ে বাঁধতে জানে বেশ ভালোই। প্রতিবারই বাংলাদেশ যাই আর নতুন করে অবাক হয়ে আসি। দেশটার ওপর দুঃসময়ের ঝড় বয়ে যায় একের পর এক। খবরের কাগজ পড়ি। বন্ধু-বান্ধব থেকেও খোঁজ পাই। দুঃখ হয়, কষ্ট পাই। সাহসও পাই স্পর্ধা দেখে। লড়াইয়ের চেতনা দেখে সেলাম ঠুকতেই হয়। এ দেশের মানুষগুলির প্রাণশক্তি কেমন যেন সর্বদাই অমলিন, অবিনত। কিছুদিন আগেই সে দেশেরই এক স্বল্প পরিচিত মহিলাকে কথাচ্ছলে বলছিলাম এসব কথা। জানিনা সে কেমন ভাবে বুঝেছে আমার কথাগুলি। বাংলাদেশ আসলেই অনেক বড়। মানচিত্রে নয়, মননে। আর বাংলাদেশের এই মননকে প্রতিটি বুকের ভেতর ধারণ করাটাই আসল লক্ষ্য এই সময়ে দাঁড়িয়ে। এবং সেখানেই এই দেশটার কাছে আমি ঋণী। রাষ্ট্রের পরিভাষায় যদিও আমি বিদেশিনী। কিন্ত বাংলাদেশ আমায় শিখিয়েছে ঘরে ফেরার গান। শাহবাগ আমায় যেমন শিখিয়েছে ফুটপাথের নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নেমে লড়তে। তেমনই শাহ আবদুল করিমের গানে জেনেছি জীবনের সহজ পাঠ। ঐ মাটি আমায় চার দেওয়ালের আশ্রয় দেয়নি ঠিকই, কিন্ত পরিবর্তে দিয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, যার ভেতর আস্তে আস্তে আমি খুঁজে পাচ্ছি নিজের একটা বিরাট অংশকে।

ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে গেলে প্রথম প্রথম খুব উত্তেজনায় থাকতাম। কিন্ত কিছু সময় কেটে যাবার পরই ছটফট করতাম বাড়ি ফেরার জন্য। অপরিচিত চারদিক কেমন একটা অস্বস্তিতে ফেলে দিত আমায়। বাড়ির সামনের নীলরঙা লোহার গেটটা দূর থেকে দেখতে পেলেই মনে হত অপার শান্তি!

ঘরে ফিরতে পারার এই প্রশান্তির সাথে তুলনীয় কিছুই নয়। এবং মানুষ কে কখন কোথায় ঘর বাঁধবে তা সে নিজেও অনেক সময় ঠাহর করে উঠতে পারেনা। ফলের বীজ যেমন অজান্তেই শিকড় গজায়।  আমার ঘরের ব্যাপ্তিও সেরকম দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে অনেকটা বিস্তৃত। ঠিক বাংলাদেশের মননের মতন।

তাই তো আমার ঘর আছে বরাক নদীর পাড় ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার সবুজে। আমার ঘর আছে সিলেটের প্রাণজুড়ানো বৈশাখ উৎসবে। আমার ঘর ঢাকায় মধুর ক্যান্টিন। আমার ঘর কলকাতার আকাশ কাঁপানো লাল পতাকার মিছিল। এসবেই আমার পূর্ণ অধিকার। এসবেই আমার চাওয়া-পাওয়ার প্রতিচ্ছবি।

তবুও রাষ্ট্র। তবুও কাঁটাতার। তবুও পরবাসী, নির্বাসিত। বাহিরে অন্তরে।

লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত