সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ২১:১৩

রূপপুর প্রকল্পকে কেন্দ্র করে আমলাদের ভ্রমণ বিলাস

একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, রূপপুর প্রকল্পকে পুঁজি করে বিশাল সংখ্যক পদস্থ আমলা রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আলোচনার আগে রূপপুর আণবিক প্রকল্প নিয়ে অতীতের কিছু কথা বলা দরকার। রূপপুর পাবনা জেলার ঈশ্বরদি উপজেলায় অবস্থিত। তবে এর প্রকৃত অবস্থান পদ্মা নদীর নিকট হার্ডিং ব্রিজের কাছে রেলওয়ে নগর পাকশী থেকে কাছে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে এই প্রকল্পের নাম শোনা যায়। সে সময় তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ড. আই এইচ ওসমানী। তিনি বৈজ্ঞানিক তবে কর্ম জীবন শুরু করেন ভারতের এলিট সিভিল সার্ভিস আইসিএস হিসেবে। পাকিস্তানে পরবর্তীতে তারা আইসিএস সিএসপি নামে পরিচিত।

ড. ওসমানী আণবিক শক্তি কমিশনের দায়িত্ব নেবার পর পাকিস্তানের আমলাদের   সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তার কর্মসূচীতে তারা পদে পদে বাধা দেন। এক পর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে Bureaucratic Fossil-দের জন্য কোন কাজ করা যাচ্ছে না। এই রূপপুর প্রকল্পের তিনি উদ্যোক্তা ছিলেন। যাহোক কিছু দিনের ভেতর তাঁকে সরে যেতে হয়। ইতিমধ্যে রূপপুর প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক কাজ অর্থাৎ জমি হুকুম দখল করা হয়। বিরাট পরিমাপের জমি। জমির ক্ষতিপূরণ দেয়াকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ দুর্নীতি ঘটে। এতে তৎকালীন পাবনায় একজন জেলা প্রশাসক আসামী হয়ে যান। আইয়ুব আমলে জেলা প্রশাসকরা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আইয়ুবের নিকট তারা নীল আঁখির বালক। অথচ এই জেলা প্রশাসকের দুর্নীতি এ জঘন্য এবং বিশাল যে সেই পাবনা জেলায় দায়রা জজের কোর্টে আসামী হিসেবে তার বিচার এবং কয়েক বৎসরের জেল হয়। রূপপুর প্রকল্পের এই লিগ্যাসি জেনে রাখা ভাল।

এরপর অনেক চড়াই উৎরাই হয়েছে। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বার (১৯৯৬-০১) যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন প্রকল্পটির বাস্তবায়নের ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এবারে তো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মাঝে গত কয়েকদিন আগে খবর বেরিয়েছে যে গত ৫ মাস এক ডজন সচিব সহ অন্তত পক্ষে একশত জন সরকারী কর্মকর্তা রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। হাজার হাজার ডলার ব্যয় করা হয়েছে রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প তহবিল থেকে এমনকি অনেকে এই তহবিলের অর্থ দিয়ে অন্যদেরও পরিদর্শন করেছেন, ৩  মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন সকারী প্রতিনিধি ইউরেশিয়ান দেশ ভ্রমণ করেছেন।

গত মাসে জুলাই দুজন মন্ত্রী, সচিব ও সিনিয়র সচিব সহ বেশ কয়েকজন মস্কো গিয়েছিলেন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক সচিব জনাব সিরাজুল হক খান অবশ্য গৎবাঁধা জবাবে বলেছেন যে যারা গিয়েছেন তারা সবাই রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্পের কাজে জড়িত। এপর্যন্ত যারা ভ্রমণে গিয়েছিলেন তাদের ভেতর রয়েছেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও তার একান্ত সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, রেল সচিব, জাহাজ চলাচল সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক সচিব, শিক্ষা সচিব, আইএমইডি সচিব এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব।

আমাদেরকে কি বিশ্বাস করতে হবে এদের সবাইকে যেতে হয়েছে প্রকল্পের স্বার্থে। আমরা আমজনতা বোধহয় এতটা বোকা নই। জুন মাসের ২৮ থেকে ৩০ পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সচিব জনাব খান প্যারিস গিয়েছিলেন বিশ্ব দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার প্রদর্শনীতে এবং তার পূর্বে ২৩ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত জেনেভাতে ইউরোপীয় নিউক্লিয়ার গবেষণা সংস্থার সম্মেলনে। এই পুরো ব্যয় বহন করা হয়েছে রূপপুর প্রকল্প তহবিল থেকে। সচিব সাহেব তো কয়েকদিন পর সিনিয়র সচিব হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে যাবেন। তিনি কি অবদান রাখবেন এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে। তারপরও যদি প্রোটকল দাবী করে থাকে এধরনের সম্মেলনে একজন সচিবের যাওয়ার প্রয়োজন। তাহলে তার ব্যয়ভার বহন করবে মন্ত্রণালয়। রূপপুর প্রকল্প তহবিল কেন এই দায়িত্ব নেবে।

২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য ৫০.৮৭ বিলিয়ন টাকার একটি চুক্তি সই করে। গত জুলাই মাসের ২২-২৮ তারিখে বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিনিধি দল মস্কো যান চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য। যার পরিমাণ মার্কিন ডলায় ১১.৩৬ বিলিয়ন। কয়েক ঘণ্টার চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার অজুহাতে বিরাট দলটি ছয়দিন কাটিয়ে এলেন মস্কোতে।

সম্মানিত পাঠক, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে এটি প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প। আর এদেশে কোন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে এবং নির্দিষ্ট ব্যয়ে শেষ হয় না। অতএব সময় ও ব্যয় দুটো বাড়বে। অবশ্য আপাতত বলা হয়েছে যে ২০২৩-২৪ সালের ভেতর প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এটা মেগা প্রকল্প। উদার ভাবে শুরু হয়েছে আমলাদের ভ্রমণ। এরপর হয়ত এভাবে শুরু হবে প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্য ষ্টেক হোল্ডারদের বিভিন্ন তৎপরতা যার উদ্দেশ্য হবে কিছু পয়সা হাতিয়ে নেয়া।

আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এই প্রকল্পের দুর্নীতির লিগ্যাসী আমাদের জেনে রাখা দরকার। সে সময় বিশাল পরিমাণ জমির হুকুম দখল শুরু হয় এবং ভয়াবহ দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এবারে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার সময় এই বিশাল অংকের টাকা দেখে শুরু হয়েছে অপব্যয়। এটিও এক ধরনের দুর্নীতি। কেননা এই প্রকল্পের ব্যয়ভার কতটা সরকার বহন করবে, আর কতটা রাশিয়া ঋণ হিসেবে দেবে, সেটি প্রশ্ন নয়। কেননা সব গিয়ে পড়বে জনগণের ঘাড়ে।

২০১৬-১৭ সালের অনুন্নয়ন কাজের শতকরা ১৭.৫ ভাগ ব্যয় করা হবে ঋণ পরিসেবার সুদ প্রদানের জন্য। খাতওয়ারী এটা সর্বোচ্চ। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ধরা হয়েছে শতকরা ১৪.৪ ভাগ। রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প (RNPP) একটি মেগা প্রকল্প। এর ব্যয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে বলা হয়েছে তারা মেগা প্রকল্পের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে দুর্নীতি, অপচয় এবং অপব্যয় রোধ করতে। আরএনপিপি নি:সন্দেহে একটি অতীব বৃহৎ প্রকল্প। যত কথাই বলা হোক না কেন ব্যয় আরো বাড়বে। তার উপর যদি অপচয়, অপব্যয় দুর্নীতি ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয় তাহলে তা গোটা জাতির জন্য হবে দুর্ভাগ্য জনক।

আমরা আশা করব যে দুদক নিশ্চয়ই এই প্রকল্পকে তাদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখবে। এবং কমপক্ষে একজন উপপরিচালকের পদ মর্যাদার কাউকে এই দায়িত্বে রাখা হবে যিনি সার্বক্ষণিক ভাবে মনিটরিং করবেন।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক সহকারী সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত