আব্দুল হাই আল-হাদী

১০ অক্টোবর, ২০১৬ ১৪:৫৩

‘হাত বাড়িয়ে দাও’

বাংলাদেশ জুড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যেন হিড়িক পড়েছে। সামান্য ও তুচ্ছ কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে একের পর এক শিহরণ জাগানিয়া সব হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে এমন সব বর্বর ও পৈশাচিক পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে , যা শুনলে ‘অন্ধকারের যুগ’ কিংবা ‘মধ্যযুগের’ কথা যে কারও মনে পড়ে যায়। আর এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিডিয়াতে প্রকাশিত সংবাদগুলোই আমরা জানি, কিন্তু অগোচরে ঘটে যাওয়া পৈশাচিক ঘটনার খবর মানুষ কমই জানতে পারে। আমাদের অনুমান- মিডিয়ার অগোচরে ঘটে যাওয়া পৈশাচিক ঘটনার সংখ্যা মোটেও কম নয়।


সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে খাদিজা বেগম নার্গিসকে প্রকাশ্য দিবালোকে কলেজের পবিত্র অঙ্গনে বর্বরতম পন্থায় আক্রমণ করলো আরেক ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র। এর আগে শিশু সামিউল আলম রাজনকে  বর্বর পন্থায় পিটিয়ে হত্যার পর নরপশুরা হত্যাকাণ্ডের ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর কাজীনগর গ্রামে ফুটবল খেলায় গোল হওয়া-না হওয়া নিয়ে বিরোধের জের ধরে তিন ভাইকে কুপিয়ে খুন করা হয়। কবুতর চুরির অভিযোগে রাজধানীর খিলক্ষেতে মাস্তুল এলাকার ৭-৮ ব্যক্তি কিশোর নাজিমের ওপর বর্বর হামলা চালায়। রশি দিয়ে ১৬ বছরের কিশোর নাজিম উদ্দিনের হাত-পা বেঁধে বেধড়ক পেটানোর পর অচেতন হয়ে পড়েছিল সে। এরপর পা দিয়ে লাথি মেরে নাজিমের নিথর দেহ ফেলে দেয়া হয় বালু নদীতে। প্রায় আড়াই মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, পৈশাচিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে পানি খেতে চাইলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে হামলাকারীরা। দুঃসহ আর মর্মান্তিক এই নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করেন স্থানীয় এক যুবক। রাজধানীর তুরাগে আবুল হাশেম নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তার মাদকাসক্ত ছেলে মানিক।

 ২০১২ সালের ১৪ মার্চ রাজধানীর পুরাণ ঢাকায় বিশিষ্ট অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের বড় ছেলে এটিএম কামরুজ্জামানকে খুন করে তার ছোট ভাই এটিএম খালেকুজ্জামান। খালেকুজ্জামান মাদকাসক্ত ছিল। ২০১১ সালের অক্টোবরে পুরাণ ঢাকার নরেন্দ্রনাথ বসাক লেনে মাদকাসক্ত সন্তান জাহিদুল ইসলাম খুন করে তার বাবা মনসুর আলীকে। এরপর ব্যবসায়ী মনসুর আলীর লাশ তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাটির নিচে পুতে রাখে জাহিদুল। ২০১১ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় মাদকাসক্ত ছেলে টিটুর হাতে খুন হন তার বাবা মোঃ. সালাউদ্দিন (৬০)।

গত বছর টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ঘটে এক পৈশাচিক ঘটনা। বিয়ের প্রস্তাবে  রাজি না হওয়ায় সেখানে একই পরিবারের চারজনকে ঘরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে বখাটেরা। গত বছরের ১০ অক্টোবর যাত্রাবাড়ীতে মায়ের পরকীয়ার কারণে নৃশংসভাবে খুন হয় ছয় বছরের শিশু মায়মুনা। খুলনায় কিশোরকে পায়ুপথে কমপ্রেসর দিয়ে বাতাস দিয়ে বর্বর পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। সিলেটের কানাইঘাটে নিজ বাড়ি থেকে কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর পৈশাচিক পন্থায় হত্যা করা হয়। অসংখ্য পৈশাচিক বর্বর ঘটনার প্রতিনিধিত্ব¦শীল কয়েকটি ঘটনা মাত্র এগুলো। হত্যাকাণ্ডের সাথে একই সাথে বেড়ে চলছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, যৌন হয়রানী এবং শিশু নিপীড়ন ও হত্যা ।  

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে,  প্রতিবছর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে এবং ক্রমেই তা বেড়ে চলছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১২ সালে এ ধরনের হত্যকান্ড ঘটেছে ১২৬, ২০১৩ সালে ১২৮, ২০১৪ সালে ১২৭ আর এ বছরের জুন পর্যন্ত ৬৯ জন। পুলিশ সদর দফতর সূত্র তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে খুনোখুনির ঘটনা বাড়ছে। ২০১১ সালে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৩ হাজার ৯৬৬টি। ২০১২ সালে ৪ হাজার ১১৪টি, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৩৯৩টি ও ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে।

 ২০১২ সালে ২০ হাজার ৯৪৭, ২০১৩ সালে ১৯ হাজার ৬০১, ২০১৪ সালে ২১ হাজার ২৯১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের সাত মাসে দুই হাজার ৫৭৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫১৪ নারী। গণধর্ষণের শিকার ৯৭ জন। ধর্ষণের পরই হত্যা করা হয়েছে ৫৪ জনকে। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে আরো ৭০ জন। গত জুলাই মাসেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৬৮ জন নারী, যাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৮৩ এবং গণধর্ষণের শিকার ১৫ জন। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে। মহিলা পরিষদের হিসাবে গত বছর দেশে সাত শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার দেড় শতাধিক।

এদিকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য মতে, চলতি বছরের সাত মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩০ শিশু। ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরো ৬২টি শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭টি শিশুকে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে তিন হাজার ৩০০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।গত কয়েকদিনে আরও কয়েকটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, যার বর্ণনা শুনলে সুস্থ কোন লোকেই চোখে পানি ধরে রাখতে পারবে না।

বাংলাদেশে হঠাৎ করেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে। কি কারণে এসব হত্যাকাণ্ড বাড়ছে তার অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করছেন নীতি-নির্ধারক এবং সমাজ চিন্তকরা।

 বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, বিশ্বায়নের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সনাতন জীবনাচরণ ও ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধকে বিসর্জনই সামাজিক এসব বিচ্যুতি ও অধ:পতনের মূল কারণ। ভোগবাদী জীবনস্রোতে  গা ভাসানো  জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ মানব জীবনে প্রায় নির্বাসিত। সেকালের রীতি-নীতি আধুনিক মানুষের কাছে অপাংক্তেয়। অস্থির ও চঞ্চল আধুনিক যুগে এ নীতিবোধ আঁকড়ে থাকা পশ্চাদপদতার লক্ষণ বলে বিবেচিত। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ও উদ্বিগ্নের ব্যাপার হচ্ছে-এসব ধারণা শুধু ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ নেই, সীমানা পেরিয়ে তা পুরো সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে।  সৎভাবে সরল জীবন যাপন করার মধ্যে যে একটা আলাদা আনন্দ আছে গোটা আধুনিক জীবনে তা সম্পূর্ণ অজানা। সৎ ও সরল জীবনে অভ্যস্ত মানুষেরা আজ নির্বাসিত এবং বোকা হিসেবে পরিচিত এবং সমাজের কাছে মূল্যহীন। ধূর্ত, শঠ, প্রতারক,মিথ্যাবাদী, দুর্নীতিবাজ এবং মুখোশধারী মানুষের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে পুরো বাংলাদেশ। বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মের কাছে দৃশ্যমান কোন আদর্শ নেই যা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। সীমাহীন সমুদ্রে দিকহারা নাবিকের মতো বিজাতীয় সংস্কৃতির উপাদান সমূহই তাদের নির্দেশক ও পরিচালক। বিশ্বায়নের প্রভাবে ভোগবাদী সংস্কৃতির যে আছড় পড়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে,তার সঙ্গে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সমন্বয় হচ্ছে না। হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়ালে নতুন ধরনের নৃশংসতাকে দেখানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে পরকীয়া, ধর্ষণ। নারীদের ভোগ ও বিলাসের মাধ্যম হিসেবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এটিকে নিজস্ব স্টাইলে ব্যবহার করতে পারলেও এতে ভারসাম্য হারিয়ে মারাত¦কভাবে প্রভাবিত হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে অপরাধ ক্রমেই বাড়ছে।

অপরদিকে, সামাজিক এসব বীভৎসতার সাথে আপাত:দৃষ্টিতে রাজনীতির কোন সম্পর্ক দৃশ্যমান না হলেও পরোক্ষভাবে রাজনীতির সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায়না। সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জান, মাল এবং ইজ্জতের সুরক্ষা করবে; এটা তার দায়িত্ব। কোন বেআইনি ঘটনা সংঘটিত হলে রাষ্ট্র তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে,দোষীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। দল-মত-পথ-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্য বিচার ও আইন হবে সমান ও ইনসাফপূর্ণ। নাগরিকরা এজন্য রাষ্ট্রকে কর প্রদান করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই অপরাধের ক্ষেত্রে  বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ ওঠে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং মানুষের জান-মান রক্ষার কাজের চেয়ে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তাদের কাজের দক্ষতা ও নৈতিক মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচারের ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের  অভিযোগ তুলছে।বেকারত্ব, প্রযুক্তির প্রতি অনিয়ন্ত্রিত মনোনিবেশ, প্রযুক্তির অপব্যবহার,নৈতিক অবক্ষয়, যৌন বিকৃতি, মাদকের প্রভাবসহ আরও অনেক কারণ রয়েছে নৃশংসতার নেপথ্যে যেখানে রাষ্ট্র অনেক কিছু করতে পারে ।

 আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র অনেক অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে পারে। রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে এসব হত্যাকাণ্ড কি কারণে বেড়ে গেছে এবং কারা কেন করছে- তার গভীর অনুসন্ধান করা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং তা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এসব ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারেনা।নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য শিক্ষার সকল স্তরে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি এক ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক ধরণের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী জীবন ও অভ্যাস বর্জন এবং পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনধারায় মানুষ ক্রমশ: নিজেদের যুক্ত করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির আছর জীবনের সর্বদিক স্পর্শ ও প্রভাবিত করছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল দিক আজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্পোরেট সংস্থার আওতায়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। তরুণ-তরুণীদের লোভনীয় বিজ্ঞাপন ও অফারের মাধ্যমে ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করা হচ্ছে। ‘একুশ শতকের জীবনধারা’ নামে পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনধারায় মানুষদের অভ্যস্থকরণে মিডিয়াও ভূমিকা পালন করছে। বাঙালিত্ব ও আধুনিকতার নামে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নব্য সংস্কৃতিকে সবার উপর চাপানো হচ্ছে।এতে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মধ্যে তৈরি হচ্ছে যোজন যোজন ফারাক যা মানুষদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাতারাতি স্বপ্ন পূরণে অস্থির হয়ে অনৈতিকতার পথে পা বাড়াচ্ছে উঠতি তরুণ-তরুণীরা। এছাড়া বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী সমাজ মানসে ‘ডিজিটাল বিপ্লব’ এর জন্য অপ্রস্তুত রেখেই প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটানো হয়েছে। এতে অনভ্যস্ত মানুষ হঠাৎ প্রাপ্ত সুবিধা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছেনা এবং প্রায় ক্ষেত্রেই এর অপব্যবহার শিকার হচ্ছে। পরিবর্তনের জোয়ারের সাথে মানুষজন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ফলে সামাজিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতার।    
   
ইউরোপের আলোচিত লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচি’র সবচেয়ে বিখ্যাত বইগুলোর একটি বই হচ্ছে- ‘লেটার টু এ ডটার নেভার বর্ন’ । অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ  বইটির বাংলা তরজমা করেছেন ‘হাত বাড়িয়ে দাও’ নামে। নিজের মাঝে অস্তিত্ব নেওয়া জন্ম না নেওয়া একজন শিশুর সাথে মায়ের কথোপকথনের ছন্দে দিনপঞ্জির আদলে লেখা বইটিতে উঠে এসেছে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতার কথা। মেয়েটি নিজের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানের সাথে প্রতিটি মুহূর্ত কথা বলে।

নিজের সন্তানকে প্রতি মুহূর্তে বোঝাতে থাকে পৃথিবীটা কত কঠিন! আর সে জানে  জীবন মানেই যুদ্ধ, যেখানে প্রতি বিন্দু আনন্দের জন্য জীবন কে কঠোর মূল্য দিতে হয়! তাই তার ভয় হয়, এরকম নির্মম এক পৃথিবীতে তার সন্তানের জন্ম দেওয়া কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত! যেখানে স্বাধীনতা কেবল একটা নাম, কারণ জন্মের পর থেকে নিজের অনিচ্ছায় করতে হয় অনেক কিছু, পূরণ করতে হয় প্রভুদের ভুল চাওয়া; যেখানে ভালবাসা হল এক ধরনের তামাশা আর প্রতারণা, যা মানুষকে সবসময় বিভ্রান্ত করে; যেখানে মানুষের আগামী কখনোই আসে না; যেখানে মেয়েদের জন্ম দেওয়াকে অনেক বাবা মা অভিশাপ মনে করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের কোণঠাসা করে রাখে, যেখানে মেয়েদের বেড়ে উঠতে হয় ধর্ষণের ভয় নিয়ে; যেখানে ভালবাসার শাস্তি মৃত্যু; যেখানে গরীবের সন্তান একটা চকলেট পায় না; যেখানে নিষ্ঠুর, সবল, হৃদয়হীন মানুষেরাই সর্বত্র জয়ী হয়। এমন একটা পৃথিবীতে তার সন্তানের জন্ম দেওয়া টা কি ঠিক হবে? অনেক বাঁধা পেরিয়ে, অনেক কষ্ট সহ্য করে জন্ম দিতে চাওয়া সন্তানই যদি কোনদিন তাঁকে প্রশ্ন করে বসে-‘কেন তুমি আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে? কেন? কে বলেছিল তোমাকে?’ তখন সে কি করবে? শেষ পর্যন্ত গর্ভস্থ সেই শিশুর পৃথিবীর আলো না দেখার কাহিনীই  এতে মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেছেন লেখক। বাংলাদেশের মাগুরার  নাজমা বেগমও পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা জানতেন, চিনতেন একটি জীবনের কঠিন সংগ্রামের কথা। দারিদ্র, অনাচার, অবিচার, খুন,ধর্ষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য আর শোষণের পৃথিবীতে নতুন এক জীবন যে কত চ্যালেঞ্জের, তা-ও তার অজানা ছিলনা। কিন্তু তারপরও তিনি নিজের মাঝে অস্তিত্ব নেওয়া শিশুকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।অটল ছিলেন নিজের সন্তানকে তিনি পৃথিবীতে আনবেন।এজন্য তিনি তিলে তিলে তাকে বড় হতে দিচ্ছিলেন, পৃথিবীর উপযোগী করে তুলছিলেন নিজের জঠরে। আশাবাদী নাজমা নিজেকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, দিন বদলাবে; অনাগত শিশুর জীবন হবে আরও সুন্দর, অনেক বেশি সুখের। বর্তমান পৃথিবীর কদর্যতা স্পর্শ করবেনা তার অনাগত নিষ্পাপ শিশুকে। কিন্তু মাতৃজঠরে অবস্থানরত সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মানুষরূপী অমানুষদের বুলেটের অঘাতে জর্জরিত হলো।

সময়ের আগেই আহত সন্তানকে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হলো, বড় বেদনায় চিকিৎসকের মাধ্যমেই পৃথিবীতে তার পদার্পণ ঘটলো । মানব জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও সে জন্ম নিতে পারলো না।চিকিৎসার জন্যই তার সময়ের আগেই পৃথিবীতে তাকে আনা হলো। সন্তানের সাথে মা ও বুলেটবিদ্ধ হলেন।নিজের সাথে করা বোঝাপড়া মিথ্যা প্রমাণিত হলো মায়ের। অনাগত সন্তানের কাছে লজ্জিত হলেন তিনি। অনেক বাঁধা পেরিয়ে, অনেক কষ্ট সহ্য করে জন্ম দেওয়া সন্তানই হয়তো একদিন ওরিয়ানা ফাল্লাচির সে মায়ের মতো তাঁকে প্রশ্ন করবে-‘কেন তুমি আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে? কেন? কে বলেছিল তোমাকে?’  লেটার টু এ ডটার নেভার বর্ণ গল্পের সেই সন্তান মরে গেছে, হয়ত মা-ও মরে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের নাজমা বেগম বেঁচে গেছেন, বেঁচে গেছে তার আদরের সন্তান সুরাইয়াও। কিন্তু আপাত: যাত্রায় বেঁচে গেলেও দীর্ঘমেয়াদী তারা মরে গেছেন।  পৃথিবীর যে ভয়ংকর নৃশংসতা তিনি ও তার সন্তান দেখলেন-তা কী কোনদিন তিনি ভুলতে পারবেন; পৃথিবীর আলো দেখা সুরাইয়াও কী কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে তার জন্মদাতা মা-বাবাকে। নিষ্ঠুর পৃথিবীর কেউ হয়তো কিছুদিন পর তার দিকে হাত বাড়াবে না, জন্মের আগেই বুলেটবিদ্ধ সন্তান ও হয়তো একদিন তার থেকে হাত গুটিয়ে নেবে!  

বাংলাদেশের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবনে যে অরাজকতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতার উল্লাস প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে আমরা বিচলিত ও হতাশ।সুরাইয়া তার এক ছোট্র উদাহরণ মাত্র।আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার আছে, আছে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, ধর্মীয় নেতা,আছে শিক্ষিতজন। সব থাকা স্বত্বেও আমরা কিছুই করতে পারছিনা।কবির ভাষায় ’জল্লাদের উল্লাস মঞ্চে’ আমরা সবাই যেন আত্মমগ্ন, সবাই ব্যস্ত যে যার স্বার্থ নিয়ে। এই কিছু করতে না পারার বেদনা আমাদের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে, প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায় আমাদের।আত্মমগ্ন ও স্বার্থপর অসহায় এই আমরা তাই আশা করি কোন এক মহামানবের, কোন এক পূনার্থ্য পবিত্র স্পর্শে মুক্ত হবে বাংলার নিপীড়িত মানুষ। কবি সুকান্তের ভাষায় তাই আহবান জানাই ’

হে মহামানব, একবার এসো ফিরে/শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,/এখানে মৃত্যু হানা দেয বারবার;/লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।/এই যে আকাশ, দিগন্ত মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি,/নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি’।

আব্দুল হাই আল-হাদী, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত