আলমগীর শাহরিয়ার

০৬ নভেম্বর, ২০১৬ ১৯:৩৩

‘মালাউন’ ও মৌলবাদের মোহন মিছিল

সাতচল্লিশে উপমহাদেশে দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে মর্মস্পর্শী দাঙ্গার গল্পের অন্যতম প্রধান লেখক কৃষণ চন্দর। এমনই এক প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর ‘গাদ্দার’ উপন্যাসে র্যাশডক্লিফের লাইন আর ধর্মে বিভক্ত এক পরিবারের মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে যাওয়া, পদে পদে, পথে পথে বিপর্যস্ত, জীবন সংহারে সন্ত্রস্ত এক পরিবারের করুণ বর্ণনা আছে। তাদের সঙ্গী হয়েছিল বিশ্বস্ত অবোধ এক প্রাণী - কুকুর। কুকুরটির নাম ছিল রুমি। অনিশ্চিত গন্তব্যযাত্রায় পরিবারটির সঙ্গী হয়েছিল গাভীন পশুটিও। রক্তের হোলিখেলায় মত্ত সময়ের সাক্ষী উপন্যাসটির নায়ক বৈজনাথ সঙ্গী হওয়া প্রাণীটিকে উদ্দেশ্য করে বলছিল, তুই কুকুর - তোর কোন ভয় নেই। তুই কি মানুষ যে প্রাণের ভয় করছিস। এসব তো উঁচু সম্প্রদায়ের বর্ণের বিভেদ। এই তলোয়ার তো বিরাট সভ্যতা রক্ষার জন্য বানানো হয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দে এ অস্ত্রে তোর গলা কাটা হবে না – তুই তো সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণের জীব না। শোকর কর তুই। তুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্পৃশ্য জীব। কৃতজ্ঞতা জানা ঈশ্বরকে যে তুই মজহাবের মানে জানিস না। তুই কখনো সন্ধ্যা আহ্নিক করিসনি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িসনি। গির্জায়, মন্দিরে, মসজিদে যাসনি, তুই স্বাধীনতার প্রয়োজন বুঝিসনি। রাজনীতি করা নেতার বক্তৃতা শুনিসনি।"

ইতিহাসের গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত দাঙ্গার সেই করুণ বীভৎস দিন নেই। তবু আমাদের মানসে এখনো বীভৎস ঘৃণার বিষবৃক্ষ অনঙ্কুরিত হয়ে আছে। লুকিয়ে আছে ঘাপটি মেরে আধুনিক খুব সুরত সভ্যতার লেবাসে। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় বুনো উল্লাসে একরৈখিকভাবে, নগ্নভাবে বেরিয়ে পড়ে। হালআমলে বগুড়া, গাইবান্ধা, কক্সবাজারের রামু ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তার উত্তরাধিকারদের দেখতে পাই। না চাইলেও শুনতে পাই রাজনীতি করা নির্বোধ নেতার বক্তৃতা। বিপন্ন, আহত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে, নিরাপত্তা না দিতে পারার ব্যর্থতার দায় নিয়ে ক্ষমার চাওয়ার পরিবর্তে, অভিযোগ উঠে ক্ষমতার মসনদে বসে আগুনে ঘি ঢালার মত আমাদের মন্ত্রীমশাই বলে উঠেন, ‘মালাউন’। মারহাবা! কুকুর না শুনলেও মানুষ হিসেবে আমাদের শুনতে হয়। সভ্যতার লেবাস খসিয়ে তখন আমরা দিগম্বর হয়ে পড়ি।

আমরা জানি, মালাউন শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে আছে ধর্মবিদ্বেষ আর কুৎসা। উপনিবেশিক আমলে বপন করা উত্তর উপনিবেশিক ঘৃণার বিষবাষ্প। সাম্প্রদায়িক ভাবনার সাগরেদেরা আসলে সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় ধর্মের জিগিরে সংগঠিত দাঙ্গার অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। মানুষের বসতিতে এখনো এদের সরব উপস্থিতি দেখে মানুষ হিসেবে তাই আঁতকে উঠি। যেভাবে আঁতকে উঠি উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গরু খাওয়ার অপরাধে আখলাক নামে এক মুসলমান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুকে নৃশংসভাবে উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা যখন হত্যা করে উল্লাস করে।

পাকিস্তানেও একই অবস্থা। ওখানে এখনও দেখি ধর্মের নামে হত্যার বিরামহীন উৎসবে এখনো মেতে আছে তারা। এই দাঙ্গাবাজদের, ধর্মসন্ত্রাসীদের কোন দেশ নাই, শ্রেণিচরিত্র নাই, সীমানা নাই, বুকের ভেতর একই ছাইচাপা ঘৃণার ধিকিধিকি আগুন এরা পুষে রাখে। সুযোগ পেলেই জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। দেশ কালের ঊর্ধ্বে আদিম অন্ধ বিশ্বাসের অলৌকিক সুতোয় এরা বাঁধা থাকে চিরকাল। সভ্যতার আলোয় অবিকশিত, অনালোকিত অন্ধকারাচ্ছন্ন এসব অন্তরে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বার্নার্ড শ বলেছেন, এদের ঈশ্বর থাকেন আকাশে। আর যাদের ঈশ্বর আকাশে থাকেন তাদের থেকে সাবধান থাকা জরুরী।

মনে পড়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সপ্তপদী' উপন্যাসের মূলচরিত্র কৃষ্ণেন্দু বলেছিল,

‘‘জীবন সে ত ঈশ্বরের অংশ। সৃষ্টির মধ্যে মানুষের জীবনেই ভগবান কথা কন, হাসেন, কাঁদেন, ভালোবাসেন, নিজেকে নিজে বলি দেন, বিশ্বের কাছে বিলিয়ে দেন, মানুষের মধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ। মানুষের মধ্যে জীবন, সে যেখান থেকেই উদ্ভূত হোক, সে সমান পবিত্র। ব্রাহ্মণ নেই, চণ্ডাল নেই, ক্রিশ্চান নেই, হিদেন নেই, ধনী নেই, দরিদ্র নেই। গোত্রকুল ইতিহাস পরিচয় থাক না - থাক, মানুষ সমান পবিত্র, এরমধ্যে ঈশ্বর সমান মহিমায় আত্মপ্রকাশের জন্য ব্যাকুল।’’

মানুষ হিসেবে জগতে আমরা তো এই ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবানের খোঁজ করি। তাঁর ইবাদত করি, উপসনালয়ে প্রার্থনা করি। সুন্দর সুমহান সৃষ্টির গুণকীর্তন করি। তিনি তো আকাশে থাকেন না, থাকেন আমাদের বিশ্বাসী মননের গভীরে, অন্তরে অন্তরে।

একাত্তরে জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুগভীর বেদনায়, সহস্র বছরের পরাধীন শৃঙ্খল মুক্তির প্রেরণায় আমরা তো এক সুমহান সংগ্রামের রক্তনদী পেরিয়ে এসেছি। পশ্চাৎপদ চিন্তার কবর রচনা করেছি। অবিরাম অগ্রগামী স্বপ্ন দেখেছি। অজস্র ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে আমাদের সাহসী পূর্ব-প্রজন্ম যে সুচিন্তিত সংবিধান রচনা করেছিলেন তাঁর প্রস্তাবনায় লেখা আছে এ রাষ্ট্রের পরিচয়। ঠিকুজি। বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়েছিল। আমারা তো সে বাংলাদেশকেই বুকে লালন করি। যেখানে ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, অন্য কোন বিভেদের রেখা নয় মানুষের পরিচয় হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নিরিখে।

সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় নীতি বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে, (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে। এগুলো রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। এগুলোর ব্যত্যয় ঘটানোর কোন সুযোগ নেই। সরকার প্রশাসন তাদের উপর সাংবিধানিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

চলমান সাম্প্রদায়িক এ উত্তেজনায় দলদাস দু'একজনকে এও বলতে শোনা গেছে, “মালাউন” শব্দটি নিয়ে যারা মিডিয়া ট্রায়াল করছেন তারা শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ ও উন্নয়নের শত্রু।" এ কথা বলার জন্য বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই যে বিএনপি বা কোন বিরোধী দল নয়, এ মুহূর্তে বা আগামী দিনে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার আদর্শিক অবস্থান, সর্বোপরি সেক্যুলার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু ঘুমিয়ে থাকা মৌলবাদ। ঘুমিয়ে থাকা এই মৌলবাদের যেকোনো সময় ফুঁসে উঠতে পারে। প্রায় সবারই জানা সাতশ বছর আগের প্রাসঙ্গিক একটি গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। জার্মানির হানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর ছিল হ্যামিলন। ইঁদুরে বিপর্যস্ত নগর জীবন। নগরপিতা, সভাসদ সবাই অসহায়। নগরে এক জাদুর বাঁশিওয়ালা হাজির হন। তিনি পুরস্কারের বিনিময়ে ইঁদুর তাড়িয়ে দেন। কিন্তু বাঁশিওয়ালা তার প্রাপ্য না পাওয়ায় নাখোশ হন। একদিন বড়োরা গির্জায় প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকার সময় শহরের সব শিশুদের বাঁশিতে মোহন সুর তুলে শহর থেকে নিয়ে যান। চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় সেইসব শিশুরা।

গল্পের মত মানুষের জীবন বিপন্নকারী প্রাণীরা ধ্বংস হোক এ কামনা আমরা করতে পারি। কিন্তু কোন অলৌকিক জাদুর বাঁশিওয়ালারা যেন মানুষদের নিয়ে হারিয়ে না যায়। মনে রাখতে হবে ধর্ম অবমাননার নামে যারা হুজুগ তৈরি করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে রামু থেকে নাসিরনগর মসজিদের মাইক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হুইসল ব্যবহার করে সহিংস ডাক দিয়ে যায় - সেই বিখ্যাত গল্প হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার চেয়ে এই মৌলবাদের মোহন মিছিল কোন অংশে কম নয়। এ সত্য আমাদের চোখের সামনে। এ থেকে সতর্ক হতে হবে, শুধু নগরে নয়, গ্রামে গঞ্জে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত দেশপ্রেমী জনগণকে সজাগ করতে হবে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে এ লেখার ইতি টানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল রতন, সুবীর, উবাপ্রু, কাজল বা মিহির। এদেরকে কখনো আমার 'মালাউন' মনে হয়নি। কাজলকে একটু বেশি আপন করে ডাকতাম, কাজল বন্ধু দাস। এদেরকে আমার ভাই বন্ধু প্রিয়জনই মনে হয়। ধর্মের বিভেদ রেখা কোনদিন আমাদের মনে জাগেনি। হৃদয়ের উষ্ণতাকে এতোটুকু ম্লান করেনি। আমরা একসাথে জীবনের অসংখ্য দিবারাত্রির গল্প ভাগ করেছি। জীবনের আনন্দ বেদনার কাব্য আজো আমারা কোরাসে গাই। সুরে কোনদিন ছন্দপতন ঘটেনি। বিশ্বাস করি কোনদিন ঘটবেও না। এই হলো বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, এই হলো বাংলাদেশ। আমাদের শিয়রে অহর্নিশি অসাম্প্রদায়িক, মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত গর্বিত এক বাংলাদেশের লাল সবুজের স্বপ্ন জেগে থাকে। জেগে থাকবে চিরদিন।

  • আলমগীর শাহরিয়ার : কবি ও প্রাবন্ধিক।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত