মীর মোনাজ হক

০৬ অক্টোবর, ২০১৮ ১০:১৪

মণিপুরিদের নিয়ে সিনহা ভুল বলেন নি

সম্প্রতি বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার লিখিত বই "এ ব্রোকেন ড্রিম" এ লিখিত ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মনিপুরী সম্প্রদায়ের মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এই মানববন্ধন এর আয়োজন কে করেছে তা স্পষ্টই বোঝা যায়, মনিপুরী সম্প্রদায় এর লোকজনকে দিয়ে হয়তো স্বার্থান্বেষী মহল, এই মানববন্ধনের আয়োজন করিয়েছে, কারণ তারা প্রাক্তন বিচারপতি এস কে সিনহাকে তার সম্প্রদায়ের মানুষ দেরকে দিয়ে হিউমিলেট করতে আধাজল খেয়ে লেগে পড়েছে।

এসকে সিনহা তার বইতে সত্য ঘটনা লিখেছেন, অন্তত মুক্তিযুদ্ধর সময়ের ঘটনা সমূহ, কারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি নিজেও জানি যে, ১৯৭১ সালে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সম্প্রদায়, যার নেতৃত্ব দেয় রাজা মং শোয়ে প্রু চৌধুরী, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দেন, তেমনি মনিপুরী সম্প্রদায় পাকিস্তানিদের পক্ষে ১৯৭১ সালে সমর্থন দেয়, মৈতৈ মণিপুরিরা অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিলো, একথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়।

সনাতনধর্মী মণিপুরিরা সাধারণত সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে উদারপন্থী। তাদের নারী-পুরুষদের মধ্যে মানববন্ধনে যুবক-যুবতী/নারী-পুরুষ একসঙ্গে খেলাধুলা, গান-বাজনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক চলাফেরা ও মেলামেশায় অভ্যস্ত। তাদের ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সবাই নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করে।

পাঙান সম্প্রদায়ের মেয়ে-ছেলে ইসলামিক শরিয়ত অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবিধ কারণে মণিপুরিরা মণিপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৭৬৪-১৭৮৯) সময়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য যে অভিবাসন শুরু হয়, তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় মণিপুর-মায়ানমার যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫)। মায়ানমার বা বর্মি দখলদার শক্তি প্রায় সাত বছর মণিপুরে রাজত্ব করে। ওই সময় মণিপুর রাজা চৌরাজিত সিংহ ও তার দুই ভাই ধনসম্পদ সহকারে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং মির্জাজাঙ্গালে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর ও ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মণিপুরিদের উপনিবেশ (মণিপুরি পাড়া) গড়ে ওঠে। বর্তমানে তাদের প্রধান বাসস্থান বৃহত্তর সিলেটের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ছাতক অঞ্চলে। বিশেষ করে মনিপুরী মৈথৈ সম্প্রদায় এর মানুষ দের মধ্যে অনেক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদেরকে সমর্থন করে।

ঐতিহ্যগতভাবে মণিপুরিদের সাতটি ইয়েক বা সালাইসে বিভক্ত। পরবর্তী সময়ে ইয়েক বা সালাইস বৈষ্ণ সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয়ে নতুন নামে পরিচিত হয়। তারা বর্তমানে শাণ্ডিল্য, মৌদ্গল্য, আত্রেয়, অঙ্গীরাশ্ব, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ ও নৈমিষ্য নামে অভিহিত হয়।

মণিপুরে তিন গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস: বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙান। মৈতৈ মণিপুরিরা বিষ্ণুর উপাসক বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈরা সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলে পেঁয়াজ, রসুন ও মাংস খায় না। কথিত আছে যে, মণিপুর রাজ্যে ভারতবর্ষের কোনো এক অঞ্চলের পাঠান মুসলিম ব্যবসা-বাণিজ্য করতে মণিপুর গেছেন। তাদের একজন এক মৈতৈ মণিপুরি মেয়ের সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হন এবং তাকে বিবাহ করে সন্তানাদিসহ সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। মা মৈতৈই ও পিতা পাঠান মুসলিম বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়কে পাঙান জাতি বলে। তাদেরকে মণিপুরি মুসলিমও বলা হয়। তারা মায়ের ভাষায় কথা বলে এবং পিতার ইসলাম ধর্ম পালন করে। তারা পেঁয়াজ, রসুন ও মাংসভোজী। তাদের মেয়েরাও বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈই মেয়েদের মতো নিজস্ব উৎপাদিত পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে। এসব কারণেই মৈতৈ মণিপুরিরা পাকিস্তানিদের পক্ষে সমর্থন দেয়। তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের মণিপুরি সম্প্রদায়- লেখক, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

  • মীর মোনাজ হক: মুক্তিযোদ্ধা ও জার্মান প্রবাসী লেখক।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত