ফারজানা মৃদুলা

১৮ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ২১:০৩

শিশুশ্রমের কাছে ম্লান সভ্যতা

একটি সাজানো বিশাল বড় ফুলের বাগানের এক-একটি ফুল হচ্ছে শিশুরা যারা কি না আমাদেরর আগামীর সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। কিন্তু আমরা কি পারছি তাদের সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিতে? না, কেননা আজও শিশুশ্রম কথাটি বিলীন হয়ে যায়নি, বরং তা আরও বেড়ে চলছে।

শিশু শ্রম নিরসনে ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত একটি লক্ষ্যমাত্রা ছিল, এক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোন ইতিবাচক সাড়া চোখে পড়েনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে পৃথিবীতে আনুমানিক ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছ। যারা লড়াই করছে; দরিদ্রতার কাছে পরাজিত হয়ে নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, ঠিকমত পারিশ্রমিক, খাদ্য পাচ্ছে না। কাজে শিশুশ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেননা কম মজুরিতে তাদের দিয়ে কাজ আদায় করা যায়। মালিকপক্ষ তাদের মুনাফা আদায় করতে গিয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে আগামীর এই সুন্দর ভবিষ্যৎগুলোকে। আর এই কারণে কোমলমতি শিশুগুলোর সোনালী শৈশব, কৈশোর হারিয়ে যায় বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের মাঝে কারো নেই বাবা কিংবা মা নতুবা এতিম। আবার কারোর সব থেকেও পরিস্থিতির শিকার।

মা, বাবার স্বল্প শিক্ষাও অসচেতনতা কারণে শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। ১০/১২ বছর হলেই লেখাপড়ার খরচ চালাতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। অভিভাবকদের উদাসীনতা শিশুশ্রমকে আরও তীব্র করে তোলে।

বাস্তবতার কাছে হার মেনে তারা মনের অজান্তেই তাদের সব মৌলিক অধিকারগুলো থেকে চলে যায় বহুদূরে। এই শিশুদের স্বপ্ন হারিয়ে যায়। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসাতো পরের কথা তাদের বেঁচে থাকাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়, ঝরে পড়া শিশুদের তালিকায় নিজেদের নাম নিবন্ধন করায়। এই শিশুশ্রম দরিদ্রতার ফসল। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে, কিছু দুষ্টচক্র অপরাধ জগতে প্রবেশ করাচ্ছে খুব সহজে। ভিক্ষাবৃত্তিতেও তাদের আগ্রহ বেড়ে চলছে। ফ্যাক্টরিতে অনেক ঝুঁকি নিয়েও বিষাক্ত তামাকপাতা হাতে নিয়ে কাজ করে। কিছু শিশু ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কেউ হয় বাসের বা লেগুনার হেলপার। ইদানীং তারা অটোরিকশা চালাচ্ছে যা কিনা মোটেও নিরাপদ নয়।

এই রিকশার মালিকগুলো যদি তাদের চালানোর জন্য দেওয়া বন্ধ করে দিতো, কিংবা এ জাতীয় রিকশা মালিকদের কঠোর শাস্তির বিধান করা হতো, এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি রাখতে অনুরোধ করছি। তাহলে কিছুটা হলেও শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হতে সরে পড়তো।

নিলসেন কোম্পানির বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুশ্রমিকদের ৫৭ ভাগই কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার তারা ১০-১১ বছর বয়স থেকেই নিজেদের বিভিন্ন পেশায় জড়িত করে নেয়, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ও নিয়োজিত হয় বেশিরভাগ শিশু। তাদের মাঝে ৭৯ ভাগই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ না করে ছিটকে পড়ে। বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু “শিশুশ্রম পরিস্থিতি“ শীর্ষক গবেষণার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

আমরা জানি বা মানি এই শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, অথচ শিশুশ্রম বন্ধের জন্য এত আইন, নিয়ম-কানুন করে ও আমরা ঠেকাতে পারছিনা। আধুনিক সভ্য সমাজে পা রেখে দাস প্রথা নামক শব্দটি পালালেও আজও জ্বলজ্বল করছে যে কালিমা তা হলো শিশুশ্রম। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সকল ছেলে-মেয়েকে শিশু বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও শিশুরা তাদের নিয়োজিত করছে বিভিন্ন খাতে, যে সময়ে হাতে থাকবে খাতা, কলম, বই সেই সময় নিষ্ঠুর পরিস্থিতি বাধ্য করে তাদের জীবিকার সন্ধানে ছুটতে। টেক্সটাইল মিল/প্রিন্ট/এমব্রয়ডারি/চামড়া ও পোশাক শিল্প/ইটভাটা/কলকারখানা/ হোটেল/রেস্টুরেন্ট/ওয়েল্ডিং/ওয়ার্কশপে/রিকসা/ভ্যান/গৃহকর্মে এ জাতীয় পেশায় তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেয়। শৈশব কী তা বোঝার আগেই বেঁচে থাকার যুদ্ধ শুরু হয়, প্রতিদিন এ সংগ্রাম চলমান হয়ে পড়ে এ শিশুগুলোর জীবনে।

এ ব্যর্থতা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না, তাদের মৌলিক অধিকারগুলোও পারছি না পূরণ করতে এমন কি শিশুশ্রম বন্ধের যে আইন বিদ্যমান আছে তার প্রয়োগ ও ঢিলেঢালা। শিশুশ্রম এর ঘটনা খুব সাধারণ বিশ্বের প্রতিটি দেশে, তাদের বঞ্চনার কথা চোখের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে। শিশুশ্রম নিরসনে আমাদের সরকার জাতিসংঘের প্রণীত সব সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে তার বাস্তবায়নে কতটা শক্তিশালী তা আমাদের সকলের জানা। তবে কিছুটা প্রয়োগ ঘটছে কমপ্লায়েন্স মেনে চলা কারখানাগুলোতে তাদের কোন শিশুশ্রম নেই। ছোট ছোট কারখানাগুলোতে তা মানা হয় না, তারা বেশি বেতনের ভয়ে বড়দের কাজে নিতে নারাজ।

২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসনে নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে এই নীতি বাস্তবায়নে ২০১২ সালে ৫ বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ছিল ২০১২-২০১৬র ভেতর শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিরসন করা হবে। এসজিডির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৫ সালকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়। আশা করা যায় ২০২৫ সালে এ অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশ। শিশুশ্রম এক কথায় এক প্রকার শিশু নির্যাতন।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ, সরকারের নানা রকম পদক্ষেপ এর কারণে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু তার পরও সব সার্থকতা ভাটা পড়ে শিশুশ্রমের কাছে। তবে আশার আলো শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, দরিদ্র পিতা মাতাকে তার সন্তানদের বিদ্যালয়মুখি করছে। শিশুরা জাতির কর্ণধার প্রতিটি শিশুই একেকে জন প্রদীপের আলো আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের মাঝেই বিরাজমান আগামীর সম্ভাবনা, মানব শক্তি শিশুশ্রম বন্ধে আরও কঠোর ভূমিকা রাখা জরুরি; না হয় এর দায় সরকারের, রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, আপনি, আমি সকলকেই নিতে হবে।

সরকার, এনজিওসহ সকলের সমন্বয়হীনতার দূর করে মানসিকতার পরিবর্তন এনে এক হয়ে আমাদের বন্ধ করতে হবে শিশুশ্রম। আজ যারা শিশু আগামী দিন তাদের ওপর দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব আরোপ হবে। আসুন সকলে মিলে এ সুন্দর সম্ভাবনাময় স্বপ্ন গুলোর মানুষগুলোকে তাদের দুরন্তপনা শৈশবগুলো ফিরিয়ে দেই। মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রমকে না বলি। সম্ভাবনার মৃত্যু ঠেকাতে বন্ধ হোক শিশুশ্রম।

তাই হয়ত কবি সুকান্ত বলে গিয়েছিলেন- “এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান/ এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত