ফয়সাল তিতুমীর

১৩ এপ্রিল, ২০২০ ২২:২৮

ভালো থাকো মানবজাতি

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের ❛এপিসেন্টার❜ যে ঢাকা হবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে! এমনিতেই তো শহরটা সবকিছুর সেন্টার। তবে আশ্চর্য হচ্ছি আমার রাজশাহী বিভাগ এখনো করোনাভাইরাসে রানের খাতা খুলতে পারেনি। কিন্তু স্ট্রাইকিং অ্যান্ডে অন্যরা যেভাবে এগুচ্ছে তাতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। তারপরও এই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বিশুদ্ধ রাজশাহীর বাতাস এখনো যে কোভিড-১৯ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে সেটাই বড় কথা।

এই বিশুদ্ধতার কথা, সবুজের কথা, আমরা তো আসলে বলতে গেলে ভুলতেই বসেছিলাম। প্রাপ্য ভেবে নিয়ে ভালোই তো চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এই আচমকা লকডাউন আমাদের কত কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে। সকালে পাখির ডাক, জানালা দিয়ে তাকালে নিচের সবুজ, বেশিরভাগ সময় পরিস্কার আকাশ, হর্নহীন শব্দহীন নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতি, ঝকঝকে অচেনা রাস্তা, খানিকটা নিস্তরঙ্গ জীবন, পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময়... সবই যেন করোনা সঙ্কটে মুদ্রার উল্টোপিঠ!

জি উল্টা পিঠই বটে। এটাকে প্রাপ্য ভাবার কোন কারণ নেই, বড়জোর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যেতে পারে। বরং প্রতিনিয়ত যেসব খবর আসছে ডাক্তারদের নিয়ে, যারা চিকিৎসা দিতে অপারগতা জানাচ্ছেন কিংবা সেসব রোগী, যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বা রোগ গোপন করে হাসপাতালে সেবা নেবার চেষ্টা করছেন, অথবা যে সমস্ত প্রতিনিধি সরকারি ত্রাণ নিজের মনে করে গচ্ছিত রাখছেন, আবার যারা নিয়ম না মেনে সোশ্যাল ডিসটান্সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাইরে ঘুরছেন, আবার কোথাও করোনা হাসপাতাল তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে, কোয়ারেন্টিন সেন্টার সরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হচ্ছে...এরা কারা? চিনতে পারছেন? এটাই আমি, আপনি, আমি, আমরা। আমাদের পরিচিত ভয়ংকর স্বার্থপরতার চেহারা। শুধু মুখোশটা একটু আলগা হয়েছে।

এসবে অবাক হবার তো কোন কারণ নেই। হয়তো এতদিন স্বাস্থ্য বিভাগের উলঙ্গ চেহারাটা সবার সামনে সেভাবে আসেনি। অথচ এই সমস্যাগুলো কিন্তু বছরের পর বছর এরকমই থেকেছে। বরং এখনো যেসব ডাক্তার প্রচণ্ড সংকট সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে আতঙ্কিত থেকেও দায়িত্ব পালন করছেন আমি বলবো তারাই ব্যতিক্রম। যেসব স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে আসছেন এই মহামারিতে তারাই অন্যরকম। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আমরা পিঠ বাঁচানো, মাটিতে মুখ গুজে থাকা অমানুষ। আমরাই মসজিদে নামাজ পড়া না পড়া নিয়ে গোপালগঞ্জে কাউকে খুন করে ফেলি, আমরাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মারামারিতে নামি, আরেকজনের পা কেটে উল্লাস করি!

একদমই ভাবার কোন কারণ নেই করোনা পরবর্তী সময়ে একটা পরিবর্তন আসবেই। বরং চোখের সামনে প্রচণ্ড জ্যাম আর ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতি, হর্ন, ময়লা, দুর্গন্ধ, একে অন্যকে মাড়িয়ে চলা, থুতু, পিক ফেলা, চায়ের আড্ডা, প্লাস্টিকের কাপ, ঘামে জবজবে দৃশ্যগুলোই শুধু ভাসতে থাকে।

তাই এ অপ্রত্যাশিত অবসরকে বরং উপভোগই করছি। প্রতিদিনের কিছু চিন্তা তো কমেছে! সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাণখোলা চ্যালেঞ্জ জানানো যাচ্ছে, কোথাও কিছু ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে কঠোর সমালোচনা করা যাচ্ছে। আর মনে মনে শুধু পৃথিবীকে বলছি ব্যাটা কয়দিন যাক। এরপর দেখবি সব আগের মতো। অনেক দম নিছো, অনেক আরাম করছো। তুমি আর কয়দিন। আসলে সবকিছু তো আমার। ষাট বছরের একটা প্যাকেজে সমস্ত অধিকার তো কেবলমাত্র আমারই হে!

ভালো থাকো মানবজাতি।

ফয়সাল তিতুমীর: সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত