দিলীপ রায়

১৪ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:২৭

নববর্ষ : আশায় বাঁচি

পহেলা বৈশাখ মানেই এমসি কলেজে প্রাণের উচ্ছ্বাস। তারণ্যের বাঁধভাঙ্গা ঢল। অথচ এবার পহেলা বৈশাখে ফাঁকা এমসি কলেজ ক্যাম্পাস

করোনাকে করে দিয়ে ম্লান
নববর্ষে নবরূপে জেগে উঠুক প্রাণ।

আজ পয়লা বৈশাখ। বাঙালির ভালোবাসাময় এই দিনটি নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করার জন্যই মূলত এই লেখা।

সর্বাগ্রে জেনে নেয়া যাক একটু ইতিহাস।

কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর।
পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটগণ হিজরী পঞ্জিকা মতে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে তা মিলত না। ফলে খাজনা আদায়ে বিবিধ সমস্যা দেখা দেয়। তাই খাজনা আদায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবার লক্ষ্যে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের নির্দেশে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌরসন ও আরবী হিজরী সনের সমন্বয়ে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১০ বা ১১ মার্চ, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। এবং গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট  আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে।

মূলত সেই সময় থেকেই পয়লা বৈশাখ একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। তখন প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকগণ অধিবাসীদের মিষ্টিমুখ করাত এবং এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের  আয়োজন করত। সেই থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পয়লা বৈশাখ সর্বজনীন লোক উৎসব অর্থাৎ বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
[তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া]

বাংলার শতবর্ষী কলেজ হিসেবে বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে ফি বছর পয়লা বৈশাখ আড়ম্বরে উদযাপিত হয়। অগুন্তি মানুষ, শিক্ষার্থী- শিক্ষক বছরের প্রথম দিনটিতে তাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে আনন্দ উদযাপনে মিলিত হয়।

শিশু, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, দম্পতি, বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, ভবঘুরে সবার পদস্পর্শে কলেজ ক্যাম্পাসে  এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয়।

খোঁপায় ফুল গেঁথে তরুণীরা অকারণেই হেসে লুটুপুটি খায়। আর তা দেখে তারুণ্যদীপ্ত তরুণেরা ছন্দে আনন্দে কবিতা আওড়ায়। যুবক-যুবতীরা আল্পনার রঙে নিজেকে রাঙায়।  মুক্ত মনে ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে জীবন সাজায় নববিবাহিত দম্পতি। ক্যাম্পাস জোরে কত শত বিচিত্র ধরনের মানুষ। রাস্তায় রাস্তায়,  জারুল তলায়, অফিসের সম্মুখে, কলাভবনের পিছনে, টিনশেড, অডিটোরিয়াম, সাইফুর রহমান ভবন, অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর নীচে, পুকুরের পাড়ে পাড়ে, টিলার উপরে, বাংলোর আনাচে-কানাচে, লাইব্রেরির চিপা গলিতে, শহীদমিনারের পাদদেশে, ব্রিজের উপরে, গোলচত্তর, পদার্থ, রসায়ন, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং একাডেমিক ভবনের আশেপাশে উৎসবে মাতোয়ারা শুধুই মানুষ আর মানুষ।

কী আবেগঘন সে দৃশ্য!
আহা! কী ভালোবাসাময়, অপরূপ প্রতিটা মুহূর্ত।

অথচ এবার অদৃশ্য এক করোনার করাল গ্রাসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড। এলোমেলো।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভাষায়,

'নববর্ষ এল আজি
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
দেবে না সে করুণ পশ্রয়;'

প্রিয় কলেজের চিরচেনা দৃশ্যপটে আজ যেন কেবলি সুনসান নিরবতা।
প্রাণের অভাবে শুধুই ব্যাকুলতা।

বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায়,

'এবার মহা-নিশার শেষে
আসবে ঊষা অরুণ হেসে,
করুণ বেশে।'

বাঁশিঅলার বাঁশিতে সুর নেই। বাদামঅলার বাদাম খেতে খেতে নেই উচ্ছ্বাসভরা কথামালা। আইসক্রীমঅলার নেই কোনো হাসিমাখা হাঁকডাক। বোশেখের সাজে ছোট্ট বালকটির বাবার হাত ধরে হেঁটে যাবার মনোমুগ্ধকর মুহূর্তটির বড়ই অভাব।

চিবুকে ফুলকি এঁকে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলা অবুঝ বালিকাটির মায়ের কাছে নেই কোনো বায়না।

কলেজ প্রশাসন কিংবা পুলিশের পক্ষ থেকে নেই কোনো বাড়তি সতর্কতা।
ছাত্র সংগঠনগুলোর অফুরন্ত অবসর।

মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদের নেই কোনো বোশেখি ব্যস্ততা। দখিনা হাওয়া গায়ে মেখে উদাস করা বাউলের সুর,

'কেন পিড়িতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছাইড়া যাইবা যদি... '
তা-ও নেই।

কর্মক্লান্ত সারাটি দিন শেষে হাতছানি দিচ্ছে সন্ধ্যার অন্ধকার অথচ ঘরে ফেরার তাড়া নেই কারোর।

যে যুবকটি বহুরাত জেগে লেখেছিল যৌবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাখানি; যে মেয়েটির শাড়ির সাথে চুড়ি মিলিয়ে পরবার পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘ দিনের, যে জুটিটির এইবারের বৈশাখ উদযাপন ছিল ক্যাম্পাসের অানুষ্ঠানিক সমাপ্তি,  তাদের সেই স্বপ্নময় প্রত্যাশা আজ গৃহবন্দী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত নতজানু সময়ের কাছে।

অথচ আজকের এই দিনকে বরণ করবে বলে, রুগ্ন পাতা ঝেড়ে ফেলে পত্র পল্লবে ক্যাম্পাসের বৃক্ষরাজি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে বেশ। পাখিসব প্রাণ খোলে গাইছে শেষ বসন্তের বিদায়ী গান। লাজহীনভাবে ফোটেছে কতক সুগন্ধি পুষ্প। আপন খেয়ালে সেজেছে প্রকৃতি তার।

ক্যাম্পাসের এতসব সৌন্দর্যকে অবলোকন করে ধন্য হতো যেই মানুষ, তার অনুপস্থিতি আজ বড়ই বেমানান।

কী আর করা? প্রকৃতি না কি মাঝে মাঝে শোধ নেয় বেবাক মানুষের উপর। এখনই কি সেই শোধ নেবার পালা? কে জানে?

আমরা আশাবাদী। আসছে বছর আবার জাগবে ক্যাম্পাস। আলোর রোশনাই নিয়ে প্রাণের স্পন্দনে হবে চিরজাগরুক।ততোদিনে আমরা নতুন করে প্রস্তুতি নিই। আশায়ে বাঁচি।

শেষ করি কবিগুরু দিয়ে-

'বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও
ক্ষমা করো আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।'

দিলীপ রায়: প্রভাষক, গণিত বিভাগ, এমসি কলেজ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত