আব্দুল মতিন

১৪ এপ্রিল, ২০২০ ১৯:৪৫

করোনাযুদ্ধে সমাজবিজ্ঞান

করোনা। নতুন ভাইরাস জনিত রোগ। মৃত্যুদূত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত 'প্যানডেমিক'। 'বৈশ্বিক মহামারি'। বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন সংখ্যা। নতুন নতুন নাম। বহমান নদী যেমন সাগরের সাথে মিলনে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যু বরন করে।মানুষ বাঁচতে না পারলে মৃত্যুর মতো সত্যের সাথে আলিঙ্গনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের অপেক্ষায় যেন! দাপুটে মানুষ ও রাষ্ট্র গুলোও আজ অসহায়,কাবু।লজ্জায়,মৃত্যু ভয়ে। অনুশোচনায় এক একটি নিঃসঙ্গ দ্বীপ।সংসার পাততে যে নারী করেছিল পণ,আজ সেই সংসার তাঁর কাছে মনে হয় সহমরণ। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াইয়ে করতে হচ্ছে আনন্দের ভাব।তবু,মানুষের বাঁচার কি সম্মিলিত আকুতি!

অদৃশ্য ঘাতকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হতে চায় মানুষ।কোথায় যেন পিছনে ফেলে এসেছে এক তরুণ কে।যে পিতা হওয়ার সময় পায়নি,আজ তাঁর অস্তিত্ব জানান দিবে প্রতিভাবান পুত্র হিসেবে।আমরা সংকটকাল পার করবোই। মহাপ্রলয়ের ধ্বংস থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের উত্তরসূরি আমরা। আমরা জয় করবোই। সব রাষ্ট্র যুদ্ধ ভুলে গেছে।ঘোষণা করেছে,সবাই মিলে রুখবে বিপদ।

ক্যান্সারে আক্রান্ত পৃথিবীর ফুসফুসের সুস্থতায় সমুদ্রে প্রার্থনা করছে ডলফিন। আমাজন পুড়ে গেলে কী ক্ষতি হয় বুঝতে চেষ্টা করবে বেঁচে যাওয়া মানুষ। ভীত মানুষ, গৃহবন্দি। ইনসোমনিয়ায়। মানুষের বিষাক্ত কোলাহলের উত্তাপ বিতরণ করছে মরণঘাতী ভাইরাস। করোনা। অদৃশ্য মরণ বাঁশি। কার কানে বাঁজে!

করোনা যুদ্ধে উচ্চারিত স্লোগান 'সামাজিক দূরত্ব' প্রত্যয়টি সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট পার্ক, আর্নেস্ট বার্গেস ও ইমোরি বোগার্ডাস সমাজ গবেষণায় ব্যবহার করেছিলেন। সেই ১৯২০,১৯৩০এর দশকে। আজ ২০২০ সালে 'সামাজিক দূরত্ব' ব্যবহার হচ্ছে করোনা প্যানডেমিকে। ঔষধের বিকল্প এবং ভিন্ন প্রেক্ষিতে।

মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট, ডাক্তারদের পাশাপাশি সমাজ বিজ্ঞানীদের জন্য করোনা যুদ্ধ একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। শ্রমবিভাজনের ভিত্তিতে মিথস্ক্রিয়ারত চিকিৎসা বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান দু'টো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। উন্নত দেশগুলোতে করোনা প্যানডেমিক মোকাবিলায় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাথে সমাজবিজ্ঞানীদের করণীয় নির্ধারনে তহবিল প্রদান করা হয়েছে। সে ভাবে সমন্বিত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহন করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এভাবে নীতি নির্ধারকেরা ভাবছেন বলে জানা নেই। সমাজ বিশেষজ্ঞরা করোনা প্রতিরোধে কলম ধরলে, গবেষণা করলে সেটা রাষ্ট্রের অনেক কাজে লাগবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ায় এই সংকটে সমাজবিজ্ঞানী সি.রাইট মিল এর'সোসিও লজিক্যাল ইমাজিনেশন' প্রত্যয়টি বেশ কানে বাজে। ইনট্রসপেকশনে দেখি করোনার থিওলজিকাল ওয়েভ আমাদের কমিউনিটি পর্যায়ে পৌছেছে। করোনায় মানুষের যৌক্তিক বিশ্বাসকে বিষিয়ে তুলেছে মগজে জ্ঞান, দেশ ধারণ না করা মানুষেরা। মহাদূর্যোগ সামনে! সমাজবিজ্ঞানী হার্বাট জে গ্যানস ১৯৬০ এর দশকে বলেছিলেন 'আরবান ভিলেজারস'-এর কথা। যারা নগরে বসবাস করে, নাগরিক হয়ে উঠতে পারে না। কথাটি আমাদের দেশের জন্য আরো বেশী প্রযোজ্য।আ মাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত দাবি করা লোকদের মধ্যেও চিন্তাচেতনা অবৈজ্ঞানিক ও প্রাগৈতিহাসিক! অগাস্ট কোঁৎ এর মতো নতুন চিন্তা, দর্শন নিয়ে কেউ আসবে। এই উত্তরাধূনিক সংকটে।

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিচ বেক এর 'রিস্ক সোসাইটি' তত্ত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর আধুনিক সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লাগামহীন পাগলা ঘোড়া আচরনে প্রকৃতিকে অতিষ্ট করার আত্মঘাতি প্রচেষ্টার খেসারত আজ বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী এ্যান্থনী গিডেন্স তাঁর 'ইন ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড মডার্ণ সোস্যাল থিওরী'গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবার, এমিল ডুর্খেইম এবং কাল মার্ক্স এর সমাজতাত্ত্বিক কাজ গুলো পরিবীক্ষণ করে যুক্তি দেখান যে, তাঁদের মধ্যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও তাঁরা পুঁজিবাদ ও সামাজিক জীবনের মধ্যে গভীর সাদৃশ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।মিশেল ফুকোর উত্তরাধুনিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল সেই আধুনিকতার বিরোধীতা করা।আজ সেই উদ্বেগ প্রকাশ্যে এলো।

সোসিওলজি অব প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারির সমাজবিজ্ঞান নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণা দৃশ্যমান নয়। ইউরোপে ১৯৮০ দশকে এইচআইভি প্যানডেমিক এবং ১৪০০ শতকের প্ল্যাগ প্যানডেমিক বা কালো মত্যুর মহামারি নিয়ে গবেষণা করেন সমাজ বিজ্ঞানী পি.এম.স্ট্রং।১৯৯০ সালে তাঁর গবেষণাটি প্রকাশিত হয় 'সোসিওলজি অব হেল্থ অ্যান্ড ইলনেস' জার্নালে। স্ট্রং বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন এজন্য যে সংক্রামিত রোগগুলো সমাজ, রাষ্ট্রের, বিশ্বের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। জনস্বাস্থ্য হুমকিতে ফেলে। মানুষের মধ্যে ভয়, স্টিগমা তৈরী করে এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন ভাবনা স্থবির করে দেয়। এসব অবস্থায় মানুষের প্রতিক্রিয়াগুলো জানা থাকলে তা মহামারিতে মোকাবিলায় কাজে লাগবে। পি.এম.স্টং ফ্রান্সের সমাজবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল টার্ডে(১৯০১) এর মনস্তাত্ত্বিক ধারণাটি সংক্রমিত রোগে কিভাবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বে ছড়ায় তাঁর প্যানডেমিকে গবেষণায় টেনে আনেন। স্ট্রং এর বৈশ্বিক মহামারির গবেষণায় প্রাপ্ত বিষয় গুলো আমাদের আলোচনায় স্মর্তব্য। তিনি বৈশ্বিক মহামারি বা প্যানডেমিক এর ক্ষেত্রে তিনটি মনো-সামাজিক প্যানডেমিকের কথা বলেন। ১. ভয়ের প্যানডেমিক ২. স্টিগমা ও নৈতিকতার প্যানডেমিক ৩. ক্রিয়া ও উপযোজনের প্রতিক্রিয়ার প্যানডেমিক।

ভয়ের প্যানডেমিকে আবেগ, আচরণ মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্তির মধ্যে হুমকি তৈরী করে। তাই রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন অনেকটা মানতে শুরু করে। স্টিগমা ও নৈতিকার মনো-সামাজিক প্যানডেমিকে ভয়ের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠীর প্রতি মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণ সৃষ্টি করে যেমন উহানের মানুষের প্রতি অথবা বিদেশীদের প্রতি, গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতি আমাদের বর্তমান মনোভাব। ক্রিয়ার ও উপযোজনের মনো-সামাজিক প্যানডেমিক আগের দু'টো অবস্থাকে অতিক্রম করে। মানুষের মধ্যে মৃত্যু ভীতি প্রবল হয়। অযৌক্তিক ভয়ে পুরো পরিবেশকে তাঁরা সন্দেহ করে। খাদ্য সংকট, চলাচলে বাঁধা, বিনা চিকিৎসায় অগুণিত মানুষের মৃত্যু। এমন মনস্তাত্ত্বিক অবস্থায় ভয় ও সন্দেহ কে ভিন্ন রূপ দেয় গুজব। ফলে খাদ্যলুট, দাঙ্গাসহ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রে চরম নৈরাজ্য তৈরী হয়। ঠিক এই পরিস্থিতিটি প্যানডেমিক এর চূড়ান্ত পর্যায়। মানুষের যৌক্তিক চিন্তাকে আদিম চিন্তা তখন দখল করে। সমাজসৃষ্ট প্যানডেমিক রোগেসৃষ্ট প্যানডেমিকের থেকেও মারাত্মক। অবস্থা জটিল হলে আমাদের দেশে তা ঘটতে পারে।রাষ্ট্রকে যেকোন মূল্যে তা প্রতিহত করতে হবে।মানতে ও মানাতে হবে করোনার বাস্তবতা।

লেখক: অধ্যক্ষ, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত