নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ অক্টোবর, ২০১৯ ১৭:৩৭

‘ফুলগাছ লাগানো হবে’ তাই কেটে ফেলা হলো অর্ধশত ফলজ ও ওষধি গাছ

গাছ কাটছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন

বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে যখন বিভিন্ন স্থানে তাল গাছ রোপণ করা হচ্ছে, তখন সিলেট নগরীতে কেটে ফেলা হয়েছে ২২টি তাল গাছ। ২২ টি তাল গাছসহ মোট ৪৮ টি গাছ কেটে ফেলেছে খোদ সিলেট সিটি কর্পোরেশন। গত সোমবার সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাঠানটুলার সড়ক বিভাজকের এই গাছগুলো কাটা হয়।

সিটি কর্পোরেশন বলছে, নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুল গাছ রোপণ করতে এই গাছগুলো কাটা হয়েছে। তবে ফুলগাছ লাগানোর জন্য ওষধি ও ফলজ গাছ কেটে ফেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ কর্মীরা।

এরআগে গত ৫ আগস্ট ফুলগাছ লাগানোর জন্য সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের সুবিদবাজার সড়কের আলী সেন্টার পয়েন্ট থেকে সাগরদিঘিরপাড় পয়েন্টের সড়ক বিভাজকের শোভা বর্ধনকারী ২২টি উইপিং গাছ কেটে ফেলে সিলেট সিটি কর্পোরেশন।

পাঠানটুলা এলাকার স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে সড়ক বিভাজক তৈরি করার পরই সেখানে ফল, ফুল ওষধিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগান পাঠানটুলার বাসিন্দা মৃত নায়েক মো. আব্দুল বাতেন। তাল, রেইনটি, নিম, আখন্দ, পেয়ারা, জাম, বড়ইসহ বিভিন্ন জাতের প্রায় ৫০টি গাছ লাগান তিনি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই গাছগুলোকে তিন পরিচর্যা করতেন। গত সোমবার গাছগুলো কাটার সময় স্থানীয়রা বাঁধা দেন । তখন সরকারি নির্দেশে গাছ কাটা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের জানানো হয়।

মৃত মো. আব্দুল বাতেনের ছেলে মো. আবুল হাসান নেওয়াজ বলেন, আমার বাবা এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। আমাদের মতই অনেক যত্ন করতেন এই গাছগুলোকে। বাবা বলতেন গাছের ছায়ায় যখন মানুষ বসবে তখন আমাদেরকে দোয়া দিবে। হুট করে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন গাছগুলো কেটে ফেললো। আমরা বাধা দেওয়ায় বলে গাছ কাটার অনুমতি আছে। এই জায়গাটা সবুজ ছিল এখন উজাড় হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানে ২২টি তাল গাছ ছিল। যে গাছগুলো এই এলাকার মানুষদের বজ্রপাত থেকে বাঁচাত। সেই তালগাছগুলোও কাটা হয়েছে।

পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা আলীউল বলেন, গতবছরও এই ডিভাইডারের গাছের জাম, বড়ই খেয়েছি। এখানে নিমের গাছও ছিল। সব কাটা হয়ে গেছে। আশপাশের অনেক এলাকা থেকে এই গাছের নিমপাতা নেওয়ার জন্য মানুষজন আসতেন। কোরবানি ঈদে যখন মানুষজন গরু নিয়ে হাটে যায় তখন এই তালগাছের ছায়ার নিছে বসে একটু বিশ্রাম নিতেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী হোসেন বলেন, মো. আব্দুল বাতেন অনেক কষ্ট করেছেন এই গাছগুলো বড় করতে। এইখানের আখন্দি, নিমগাছের পাতা নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষজনকে আসতে দেখেছি। গাছগুলো কাটা অন্যায় হয়েছে। এখন আমরা সাধারণ মানুষ। বাঁধা দিয়েছি গাছ কাটতে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

পাঠানটুলা এলাকার আরেক বাসিন্দা ব্যবসায়ী রাজু হোসেন বলেন, দিনের বেলা গাছ কেটে রাতে ঠেলা গাড়িতে করে নিয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় এসব গাছ কেটে ফুলগাছ রোপণের কোনো যুক্তি নেই।

সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের নগরীর ভেতরের অংশের বিভাজকের সংস্কার কাজ চলছে। এই কাজের ঠিকাদার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, এই লাইনের ডিভাইডারের কাজ শুরু হয়েছে ১ মাস যাবত। আমরা শুধু ডিভাইডারের কাজ করছি। গাছ কে কাটছে কেন কাটছে আমরা জানি না।

এ ব্যাপারে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দেবনাথ বলেন, একটি তাল গাছের বীজ থেকে চারা হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে। এই গাছ অনেক উপকারী। ফল, ছায়া, বাতাসের পাশাপাশি এই গাছ আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। তাই এই গাছের যতœ করা দরকার। অথচ সিলেট নগরীতে ২২টি তাল গাছ কাটা হলো। এটা অনেক বড় অন্যায় করা হয়েছে। এই গাছগুলো স্থানান্তর করা যেত।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ইসমালুর রহমান বলেন, অফিসের নির্দেশে গাছ কাটা হয়েছে।

সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহাব উদ্দিন শিহাব বলেন, এখানের গাছগুলো অনেক বড় ছিল। এগুলো ডিভাইডারের উপযোগী গাছ না। পথচারীদের গায়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়তো। তাই গাছগুলো কাটা হয়েছে। এখানে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া গাছ লাগানো হবে।

গাছ কাটার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিসিকের উদ্যোগে এত সংখ্যক উপকারী গাছ কাটা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। তার উপর ২২টি তালগাছ। এটা অন্যায়। ফুলগাছ লাগানোর জন্য তাল গাছ কাটার কোনো যুক্তি নেই। সৌন্দর্যবর্ধন করতে হলে সিসিকের প্রকৌশলীরা পরিকল্পনা করে ফুলগাছ লাগাবেন। কিন্তু এতগুলো উপকারী গাছ কেন কাটবেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানোর জন্য ২০১৭ সালে দেশব্যাপী তালগাছ লাগানো ও তাল বীজ রোপণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের পক্ষে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় তাল গাছ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত দুই বছরে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তালের আঁটি (বীজ) রোপণ করা হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী সরকার ২০১৬-২০১৭ সালে ১০ লাখ তাল চারা রোপণ ও ২০১৭ সালে ডিএই ২ লাখ তাল বীজ/চারা সারা দেশে রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত