এমদাদুল হক তুহিন

১৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০১:১৬

বাম দলেই ইমরানের আবির্ভাব!

শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে ব্যক্তি আমি ইমরানের ডাকে যুক্ত হই নি। শুধু আমি নই, আমার মতো প্রতিটি আন্দোলনকারীই। যেদিন প্রথম ‘শাহবাগে সাইবার যুদ্ধ’ নামক পেইজের স্টলে গিয়ে বসলাম সেদিনও আমি ব্যক্তি ইমরানকে চিনি না। এমনকি চিনতাম না পূর্ববর্তী সময়েও। বিবর্তিত সময়ে মঞ্চ নামে অধিকতর পরিচিত হয়ে উঠে শাহবাগের আন্দোলন। সামনে থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও মিডিয়ায় কথা বলার জন্যে একজন মুখপাত্র খোঁজা হচ্ছিল। ইমরান এইচ সরকার ছিলেন আওয়ামীমনা। আওয়ামী লীগের তিন নম্বর অফিসেও বসতেন। শুধু তাই নয় যে সংগঠনের ব্যানারে শাহবাগে প্রথম গণমানুষের জামায়েত শুরু হয় সেই সংগঠন ব্লগার এন্ড অন লাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (বোয়ান) প্রথম সারির স্বঘোষিত নেতাও সে। তাই মুখপাত্র হিসাবে সে যোগ্যও ছিল এবং সবার পছন্দেরও বটে। ৫ তারিখ বিকেলে থেকেই যারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং দীর্ঘ সময় বিশেষত ব্লগে জামায়াত-শিবির বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য তারাই ইমরানের নাম প্রস্তাব করেন। এবং সিদ্ধান্তও হয় সেভাবেই। আন্দোলনের প্রথম দিকে ভালোই চলছিল।

কিন্তু না! বাঁধা আসে একাধিক। শত বিপত্তি। আইন সংশোধন হওয়ার পর অনেকেই আন্দোলন বন্ধ করার কথা বলছিলেন। কেউ কেউ রায় ঘোষণার পূর্ববর্তী দিনেই গ্রোগ্রাম রাখার বিষয়ে অনুরোধ রাখছিলেন। কিন্তু তার পূর্বে যে রাতে রাজীব হায়দারকে মিরপুরে মারা যান সেইরাতেই তিনি আন্দোলনের সময় সংক্ষিপ্ত করেন। সকাল-বিকেল আন্দোলন। কিন্তু একটি শ্রেণী শাহবাগ থেকে সরে যাওয়ার পক্ষে নয়। ইমরানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে শাহবাগের সাইবার যুদ্ধ পেইজ একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে মতামত জানতে। কিন্তু ইমরান পেইজের এডমিনে কয়েকজন জামাতী যুক্ত এমন অভিযোগ দিয়ে বসে। এবং এক সময় পেইজটিকে ছলেবলে কৌশলে নিজের দখলে নিয়ে যায়।

ঘটনা প্রবাহ চলতেই থাকে। শুরু হয় নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। একসময় স্পষ্ট হয়ে উঠে নিজেদের দুটি পক্ষ। মুখপাত্রকে অব্যাহতি দিয়েও সংবাদ সম্মেলন করা হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষেও ইমরান বিরোধী একাধিক সংবাদ সম্মেলন হয় মধুর ক্যান্টিনে। ইমরানকে শাহবাগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। ইমরানের বিরোধিতার সঙ্গে জড়িয়ে যায় ছাত্রলীগ ট্যাগধারী সব নেতারাই। শেখ আসমানের নামে মামলা হয়। মামলা হয় নাসিম রুপকের নামেও। তখন ইমরান বিরোধী একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি অংশ ইমরানকে নিজেদের পোষ্যই মনে করছিল! বারবার বলা সত্ত্বেও তার অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে কেউ কথা বলে নি। উপযুক্ত তথ্যাদি পেতে তাকে ডাকাও হয় নি কোন সংস্থা থেকে। কারণ তাকে তখনও সরাসরি সাহায্য করে যাচ্ছেন কয়েকজন মন্ত্রী। বাস দেওয়া হচ্ছে লংমার্চ করার জন্য। প্রয়োজনীয় অর্থও। আর প্রোটেকশনসহ অস্ত্রের কথা সকলেরই জানা।

বিতর্ক কোন দিক দিয়েই থেমে নেই। একটি অংশের ইচ্ছে ছিল ইমরান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাক। খবর প্রকাশ হয়েছিল, ইমরান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যদিও তার সত্যতা মেলে নি। তবে এমনও খবর পাওয়া যায়, আন্দোলন পরবর্তী সময়েই তিনি তার বাড়িতে ঘর উঠানোর জন্য মোটা অঙ্কের বাজেট করেন। ইট কেনা হয়। বেশ কয়েকজনের জানাজানি হলে সেই ইট তার বাড়ি থেকেও সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ রয়েছে।

শুধু তাই নয়, নিজ গ্রামেও প্রভাব খাটাতে শুরু করে তথাকথিত এই মুখপাত্র। নিজের চাচাতো ভাইকেও আক্রমণ করে। বিষয়টি নিয়ে ইমরানের দুলাভাই তার তৎকালীন সহযোদ্ধাদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানার আগ্রহ হারানোয় বাদ বাকি আর স্মরণ করতে পারছি না।

তবে মঞ্চের একাংশ নামে পরিচিতি পাওয়া বোয়ান, ছাত্র মৈত্রী, কামাল পাশার অংশ মিলে এই প্রমাণ করতে পেরেছিল যে মঞ্চ নয়, মানুষ জড়ো হয়েছিল শাহবাগের আন্দোলনে। বোয়ানের সভাপতি অনিমেষ রহমান, ছাত্র মৈত্রীর প্রাক্তন সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, কামাল পাশা চৌধুরী, এফ এম শাহীন এও প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভব হয়েছিল যে ইমরান একাধিক কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত এবং একক সিদ্ধান্তে চলমান। সহযোদ্ধাদের কোন সিদ্ধান্তেই তিনি আর কর্ণপাত করছেন না বরং সিদ্ধান্ত আসছে এনজিও সংস্থা খুশি কবিরদের মতো ব্যক্তিত্বের নীল নকশায়।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে গড়ে উঠা আন্দোলন রঙ হারায়। তবে রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যানারে তা রঙিন হয়ে উঠে। সব কিছুতেই প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু। সময়ের পরিক্রমায় প্রকৃত সহযোদ্ধারা যেমন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঠিক তেমনি সেও। একই স্থানে সভা সমাবেশ। শাহবাগে ১০ হাতের মধ্যে দুটি মাইক। মানুষ লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে একাংশ নামে খ্যাতি পাওয়া অংশটি তাদের আন্দোলন একেবারেই বন্ধ করে দেয়। মূলত তারাই সঠিক ছিল। যেখানে ক্রমাগত যুদ্ধাপরাধের ফাঁসি হচ্ছেÑসব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাকা চৌধুরীর মতো ব্যক্তিকেও ফাঁসিতে ঝুলানো হয় সেখানে আন্দোলন চালিয়ে রাখার মতো বিন্দুমাত্র যৌক্তিকতা নেই।

আর যুদ্ধাপরাধ ইস্যু যখন প্রায় সমাপ্তির পথে তখন তথাকথিত ওই মুখপাত্র রাজনৈতিক দলের মতো সব বিষয়েই অনেকটা প্রেস রিলিজের মতো বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। যদিও এক সময় তার রাজনৈতিক দল খোলার গুপ্ত আশা প্রকাশ্যে রূপ পায়। কয়েকজন আন্দোলনকারী প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়, গণজাগরণ মঞ্চের কোন একটি শব্দও যদি কোন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ব্যবহৃত হয় তাহলে একদিকে যেমন মামলা হবে ঠিক তেমনি রাজপথেও ইমরানকে প্রতিহত করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে বলেও ঘোষণা আসে। ঠিক সে সময়ই সে থমকে যায়। সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে।

কিন্তু দীর্ঘদিন লুপ্ত থাকে নি তার গুপ্ত সখ। যখন তাকে আর কেউ পাত্তাই দিচ্ছিল না তখন সে ইস্যু পেয়ে বসে। কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে। সে যেদিন থেকে রিজার্ভ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো সেদিন থেকেই অনলাইন থেকে রিজার্ভ ইস্যু উধাও। এবার তার ভাগ্যে জুটে তনু ইস্যু। বাংলার প্রতিটি মানুষ যখন তনু হত্যার প্রতিবাদে কথা বলছে মিডিয়ায় ফোকাস হওয়ার জন্য সে একধাপ এগিয়ে কুমিল্লা অভিমুখে ঘোষণা করলো রোডমার্চ। শুধু তাই নয় সেদিনকার বক্তব্যে আকার ইঙ্গিতে তাকে যাতে আওয়ামী লীগ প্রতিহত করে সেই আহ্বান জানালো। কিন্তু আওয়ামী লীগ হয়তোবা তার মতো মূর্খ নয়। সে মিডিয়ায় ফোকাস হলো ঠিকই তবে কাজের কাজ শূন্য। উদ্যত আকাশে ভাসমান তনু ইস্যুর ফলাফলও এবার শূন্যে মিলিয়ে গেলো।

কিন্তু না- বরাবরের মতোই এবার তার চেহারা প্রকাশ্যে আসলো। সাংবাদিক না হয়েও নির্দিষ্ট প্রমাণে গ্রেফতার হওয়া প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালো। বিষয়টি সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় তিনিও প্রতিক্রিয়া দেখালেন। বিষয়টি নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে ইমরান লাভবান মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে চিরতরেই তার জন্যে আওয়ামী লীগের দরজা বন্ধ হলো বলেই মনে হচ্ছে। যে কয়েকজন মন্ত্রী তাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন, তারা এবার চোখ সরিয়ে নেবেন। যে বাসায় থাকতেন, সে বাসাও হাতছাড়াও হবে। এমনকি যে মন্ত্রীর মেয়েকে ফুসলিয়ে তালাক দিতে উৎসাহিত করেছিলেন হয়তো সেই মেয়েটিও সরে যাবে। প্রকৃতপক্ষে সরে যেতে বাধ্য হবে। যেতে হয় বলেও কথা আছে। প্রকৃতপক্ষে জয়ের স্ট্যাটাসের মাধ্যমেই জয় এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ইমরানকে বয়কট করলো। ইমরানও এই বার্তা দিয়েছিলে যে যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কথা বলা এখন শুধুই তার রক্ষাকবচ, প্রকৃতপক্ষে এখন তিনি বিএনপি এবং জামাতের পক্ষে কথা বলতেও প্রস্তুত। এবং এও স্পষ্ট হলো খুব শীঘ্রই সম্পূর্ণ বাম আঙ্গিকে কোন রাজনৈতিক দল নিয়েই ইমরানের আবির্ভাব ঘটছে।

লেখাটি এমদাদুল হক তুহিনের ফেসবুক টাইমলাইনেও প্রকাশিত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত