প্রকাশিত: ২০১৭-০৩-০২ ১৪:০৬:৫৭
এমদাদুল হক তুহিন:
বইমেলা মানে লম্বা লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশ। অত:পর নজরুল মঞ্চ। অন্য প্রকাশ বা অন্বেষার স্টল। হাতে নিয়ে যাওয়া তালিকা। হৈ-হুল্লোড় করে স্টলের কাছে যাওয়া। টাকা ভাঙতি করেই নির্দিষ্ট কিছু বই কেনা। এটা কয়েক বছর আগের স্মৃতি।
হ্যাঁ, বছর ছয়েক পূর্বের। তখন আমি সদ্য অনার্সের ছাত্র। হুমায়ুন প্রীতি মাত্রাতিরিক্ত। সেইসময়ে ছোট ভাই নাসিফ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার মেলায় গিয়েছি। নজরুল মঞ্চের আশেপাশে দাঁড়িয়ে হয়ে উঠেছি অটোগ্রাফ শিকারি। তবে প্রথমবার কার সঙ্গে মেলায় গিয়েছি সে স্মৃতি ঠাহর করতে পারছি না। মনে পড়ে সালমা আন্টির কথা। সঙ্গে খালুকে নিয়ে এসেছেন। টিএসসির সামনে থেকেই লাইন। খুব সম্ভবত একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন আমি ফার্মগেটে থাকি। পাশ্ববর্তী মেসের অপর এক বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় যাই। লাইনে দাঁড়াই। ঠিক লাইনেই। শেষ পর্যন্ত সেদিন আমাদের আর মেলায় ঢুকা হয়নি। আন্টি খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন আমার সঙ্গে থাকা ওই ভাইটির প্রতি।
এইযে একটা অনুভূতি, এই অনুভূতিই হচ্ছে বইমেলা। এটি প্রাণের, হৃদয়ের স্পন্দনের।
বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নে থেকে ব্যবহারিক বাংলা অভিধান সংগ্রহের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে হুমায়ুন আহমেদের বলপয়েন্ট সংগ্রহের কথা। আরও মনে পড়ে মেলায় বিভিন্ন ব্লগের স্টল। স্মৃতি শক্তি খুবই খারাপ। তারপরও মনে পড়ে, আমাদের সেই লিটল ম্যাগ। স্বপ্নের সেই লিটল ম্যাগ চত্বর। লিটল ম্যাগ চত্বরের কথা মনে পড়লেই, স্মৃতিতে ভাসে উঠে লাল রঙের গাড়িতে বসে সেই মেয়েটির ঠোঁটে জ্বলতে থাকা সিগারেট। আর আমাদের ওই আড্ডা। লেখক, কবি, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী, সাংবাদিক আরও কতো পেশা। নেশাও কতো। সিগারেট টানছে, পঙক্তি আঁকছে। চিত্রশিল্পীর নিখুঁত ক্লিকে হৃদয় ছোঁয়া সেই আলোকচিত্র। আর মুহূর্তেই হারিয়ে যাওয়া ভিন্ন এক জগত। আচমকা বুকে বুক মিশে গিয়ে কুশল বিনিময় আর পরিচয়। এ যেন আমাদের বাংলার প্রাণ, প্রাণের টান।
বইমেলার সময় ছবির হাঁটে বসে সেই সব আড্ডার কথাও মনে পড়ে। শিমুল ভাই, আসমান ভাই, সিন্দাবাদ ভাই ও শুভ কামাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। আমাদের অনিমেষ রহমান (অনি দা), দুরন্ত দুরা। সিলেট থেকে আসলেন কবির ভাই। একসঙ্গে আড্ডা হলো। মনে পড়ে ১৩’ পরবর্তী সেইসব কথাও। বইমেলা মানেই যে শত শত আড্ডার সম্মিলিত আবেগ।
কবি আড্ডার কথা না বললেই নয়। কবিদের সঙ্গে আড্ডা বলতে কবি চৌধুরী ফাহাদ, রাকিবুল হায়দার ও সোয়েব মাহমুদ ভাইদের সঙ্গে আড্ডাকেই জানি। যাদের কয়েকজনের সঙ্গে ২০১৬ সালের বইমেলায়-ই প্রথম পরিচয়। অথচ এই সম্পর্ক এখন আত্মিক। কবিরা বলেন, কবিতা একটা মিছিল। এ মিছিল একটা সংগ্রামের। এ মিছিল কবিতার। আজকাল কবি আড্ডায় হৃদয় খুলে যতোটা কথা বলতে পারি, ততোটা অন্য কোথাও নয়। তরুণ কবিদের বিনয়, লেখার মান ও সর্বোপরি তাদের ব্যবহারেও আমি মুগ্ধ। মন্দিরের পাশে, পুকুরের পাড়ে, চায়ের কাপে, সিগারেট মুখে; আমাদের মধ্যে যে গল্প খেলে যেতো সেই গল্পের নাম বইমেলা। আর আমি সেই গল্পকে বলি, বইয়ের গল্প।
বইমেলায় ঢুকতে এখন আর লাইন ধরতে হয় না। এবার আমাকে একদিনও লাইন ধরতে হয়নি। মূলত এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মেলা সংযুক্ত করার সুফল। তবে এবারের মেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদারে কথা বলা হলেও, আর্চওয়ে পার হয়ে মেলায় প্রবেশপথে যে চেকিং সিস্টেম ছিল; তা মোটেও পছন্দ হয়নি। সবাইকে চেক করছিলো না। পছন্দমত কাউকে কাউকে। আর আমাকেও ঠিকঠাকভাবে চেক করা হয়নি। অর্থাৎ এবারের মেলায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা পুরো সফল তা বলা যাবে না।
সঙ্গত কারণে, এবারের বইমেলাটি ছিল আমার জন্যে হাহাকারের এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের। দূর থেকে শুনতে পেয়েছি বহু কথা। একবার বই প্রকাশ করে; দ্বিতীয়বারের মথায় বই প্রকাশ করতে না পারায় হাসতেও দেখেছি একজনকে। তবে অধিকাংশের সুরেই ছিল আক্ষেপ। কিন্তু আমি জানি, আমার জানা দরকার ছিল। আমি, জানছি।
বলে রাখা ভালো, কবিতার বই বের করতে চাইলে করা যেতো। বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই করবো কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার এক প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন। আমি হ্যাঁ, না- কিচ্ছুটি না বলায় তিনি বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন। তবে আমার প্রথম বইটি বের করা হয়েছে ঠিকই, কোন শর্ত ছিল না। চুক্তি ছিল না। নেশায় ছিলো বই করতে হবে। সে লক্ষ্যে আমি সফল। বই করতে আমার টাকা লাগেনি। বরং আমি প্রকাশককে বলতে পারি, তিনি ঠিকঠাক হিসাব দিতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন তেমনি মেলা চলাকালীন এক সঙ্গে ১০০ বই একজন কিনতে চাইলেও তিনি তা পাঠাতে পারেন নি। আর এবার মেলায় দেখেছি স্টলে বইটি তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছিলো না। কারণ ঠিকভাবে প্রদর্শন করা হয়নি। আর স্টলে দেখেছি, মাত্র ২ কপি বই আছে।
যার এক কপি কোন না কোনভাবে ব্যবহার যোগ্য নয়। বিষয়গুলো এ কারণে বলা, প্রকাশক শুধু প্রকাশক নন, বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়াও তার নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বহু প্রকাশকই ব্যর্থ। তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন। আর এমন শত শত বই প্রকাশের গল্পানুভূতিই হচ্ছে বইমেলা।
বইমেলায় লেখকদের আড্ডার স্থান রয়েছে। ছোট বেলায় সেটি খুব বেশি চোখে পড়তো। এবার পড়ে নি। অবশ্য এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢু দেয়া হয়নি। বলতে গেলে ইচ্ছেই হয়নি। কেন হয়নি তা কারণ ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। বাংলা একাডেমির প্রতি একটি চাপা ক্ষোভ আর অভিমান সবারই। সব শেষে একটাই প্রত্যাশা, বাংলা একাডেমি আমাদের এই চাপা ক্ষোভ আর অভিমান ভাঙিয়ে অন্ধকার থেকে আলোতে আসুক।
আপনার মন্তব্য