নিজস্ব প্রতিবেদক

১৮ জুন, ২০১৬ ১৪:২৩

নেপথ্যের হোতাদের আড়াল করতেই কি ফাহিমের ক্রসফায়ার?

মাদারীপুরের কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় দায়ের মামলায় গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন  হিযবুত তাহরিরের সদস্য গোলাম ফায়জুল্লাহ ফাহিম পুলিশের রিমান্ড চলাকালীন অবস্থায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নিহত হবার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকরা। এই ঘটনাকে আরেকটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের 'খারাপ দৃষ্টান্ত' হিসেবে দেখছেন অনেকে।

শুক্রবার (১৭ জুন) মাদারীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ফাহিমের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তার কাছ থেকে টার্গেট কিলিং সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে রিমান্ডের প্রথম দিনের মধ্যরাতেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে তার নিহত হবার খবর দেয় পুলিশ।

অন্য বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনার মত এক্ষেত্রেও পুলিশের ভাষ্য ছিল অভিন্ন। পুলিশ সুপার সারওয়ার হোসেন বলেন, সদর থানার মিয়ারচর এলাকায় পুলিশ ফয়জুল্লাহকে নিয়ে অভিযানে যায়। ফয়জুল্লাহর সহযোগীরা সেখানে অবস্থান করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা গুলি ছোড়ে। পুলিশের গাড়িতে গুলি লাগে। এ সময় ফয়জুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।


তবে এই ঘটনাকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখছেন সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর।

তিনি লিখেছেন:

একজন ব্লগারকে খুন করে পালিয়ে যাবার সময় তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন কাউকে কাউকে হাতে নাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো। তাদের নাগালের মধ্যে পেয়েও পুলিশ চাপাতি হত্যার নেপথ্য নায়কদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেনি।
একজন শিক্ষককে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টার অভিযোগে ফাহিমকে ধরে ফেলেছিলো জনতা। ফাহিমের কাছ থেকে তার পেছনে কারা আছে তাদের চিহ্নিত করার আগেই পুলিশের তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ তাকে মেরে ফেলা হলো।
চাপাতি খুনিদের আমাদের পুলিশ গোয়েন্দারা ধরতে পারে না। অথচ জনতা যখন একজনকে ধরিয়ে দিলো, তাকেও কনিা দ্রুততম সময়ে ‘মেরে’ ফেলতে হলো!
তার কারণ কি? আমরা কি চাপাতি হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই না? চাপাতি খুনকে নিষ্কণ্টক রাখতে চাই?


এমনটি ঘটতে পারে আগেই আশঙ্কা করেছিলেন জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ লিখেছেন:

এই আশংকাটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম, কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে হাতে নাতে ধরে। পুরোটা না পারলেও ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে তাদের পক্ষে এরকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না।


ব্লগার ও লেখক মাহবুব লীলেন ফাহিমের আটকের পর তার ১৫ তারিখে দেয়া পোস্ট শেয়ার করে লিখছেন- "যা ভাবছিলাম তাই হইল। ক্রস ফায়ারের পুরানা গপ্প দিয়া পুলিশ নিজেগো কৃতিত্ব উদ্ধার করল।"  ফাহিম আটকের পর ১৫ জুন তিনি লিখেছিলেন, "পুলিশ নামল যৌথ অভিযানে আর পাব্লিকে ধইরা ফালাইল জঙ্গী। এখন নিজেগো কৃতিত্ব উদ্ধারে পুলিশ আবার এরে ক্রস ফায়ার দিয়া ফাইল ক্লোজ করব না তো?


ফাহিমের কাছ থেকে বের হওয়া তথ্য জনগণকে না জানাতেই কি এই বন্দুকযুদ্ধ প্রশ্ন রেখে সংগঠক গাজী জয়িতা মাহিদ লিখেছেন:

কলেজ শিক্ষক রিপন হত্যা চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত ফাহিম পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত। ধরে দিল জনগণ, তারপর নিহত হল বন্দুকযুদ্ধে। নিশ্চয় জঙ্গি ধরতে এমন কোন অভিযান হয়েছিল, যেখানে এই বন্দুক যুদ্ধ হয়েছে!
খুবই ভাল কথা। ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদে কি এমন কোন তথ্য বের হয়ে আসতো- যেটা জনগণের না জানাই ভালো?
সকল প্রকার বিচার বহির্ভূত হত্যা  বন্ধ হোক।




সরকার জঙ্গি নির্মূলে আন্তরিক নয় উল্লেখ করে লেখক কুলদা রায় লিখেছেন:

এটা স্পষ্ট যে সরকার জঙ্গী সমস্যা নির্মূল করতে চায় না। নির্মূল করতে চাইলে ফাহিমকে ক্রস ফায়ার করত না। বাঁচিয়ে রেখে তার কাছ থেকে জঙ্গিদের সম্পর্কে তথ্য বের করতে পারত। তাতে জঙ্গিবাদীরা নতুন করে বিপদে পড়ে যেতো।



অনলাইন এক্টিভিষ্ট দেবজ্যোতি দেবুর মত একই। তিনি লিখেছেন: 

অনেকেরই ধারণা ছিল ফাহিমের কাছ থেকে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য পাবে পুলিশ। আমিও ধারণা করেছিলাম এই টার্গেট কিলিং, জঙ্গিদের হত্যা পরিকল্পনা, জঙ্গি সংগ্রহের পন্থা সম্পর্কে এই যাত্রায় কিছুটা হলেও তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগেই ফাহিম নাই। এই বন্দুকযুদ্ধের কল্যাণে আড়ালেই থেকে গেল সেইসব মাস্টারমাইন্ড।

ফাহিমের মৃত্যুতে তার নিয়োগদাতা এখন স্বস্তিতে ইংগিত করে আসিফুজ্জামান পৃথিল লিখেছেন:

ফাহিমকে অন্ততপক্ষে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা খুব জরুরী ছিলো। ফাহিমের নিয়োগদাতারা অন্তত এখন শান্তিতে "ঘুমাতে" পারবেন।



প্রসঙ্গত গত ১৫ জুন মাদারীপুরের সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের সামনে কলেজের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর নিজ ভাড়া বাসায় হামলা চালায় ৩ জন দুর্বৃত্ত। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ফায়জুল্লাহ ফাহিমকে স্থানীয়রা আটক করে থানায় সোর্পাদ করে।

এ ঘটনায় গত  বৃহস্পতিবার রাতে ফাহিমসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন সদর থানার এসআই আইয়ুব আলী।

তিনি জানান, ঘটনার সময় আটক ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া আরও পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়। তারা হলেন- সালমান তাসকিন, শাহরিয়ার হাসান, জাহিন, রায়হান ও মেজবাহ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত