রাজু আহমেদ

০৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:২৪

ফেসবুকে সবকিছু প্রকাশ করে দিচ্ছেন?

ডিনামাইটের ইতিহাস জানা আছে? আলফ্রেড নোবেল মানবজাতির কাজের সুবিধা তথা কল্যাণকামীতার লক্ষ্যে ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অতটুকুই। তারপরে কালে কালে যারাই ডিনামাইট ব্যবহার করেছে তারাই এটাকে মানবতার ধ্বংসের জন্য কাজে লাগিয়েছে।

আলফ্রেড নোবেলের আবিষ্কার অসৎ উদ্দেশ্যে ছিল না বটে কিন্তু মানুষ এর ব্যবহারে বিপরীতে অপব্যবহার করেছে তুমুলভাবে। ডিনামাইট ব্যবহারে মানুষের এহেন অপতৎপরতা দেখে আলফ্রেড নোবেল অনুশোচনা করেন এবং আফসোস করে বলেন, আমি যদি কোনভাবেই বুঝতে পারতাম মানুষ ডিনামাইট দিয়ে মানবতা ধ্বংস করবে তবে এটা আমি আবিষ্কার করতাম না। শেষমেশ আলফ্রেড নোবেল অনুশোচনা করে ডিনামাইট আবিষ্কারের জন্য প্রাপ্ত পুরস্কৃত সমুদয় অর্থ দান করে গেলেন মানুষের কল্যাণ সাধনে। প্রবর্তন করলেন নোবেল পুরস্কারের।

মার্ক জুকারবার্গের ফেসবুক চেনা-অচেনা মানুষকে বন্ধনের রজ্জুতে বেঁধেছে শক্তভাবে। অবসরে দিয়েছে বিনোদন। যান্ত্রিক জীবন পালন করতে গিয়ে যখন মানুষ তিক্তভাবে হাঁপিয়ে ওঠে তখন এটা মানসিক প্রবণতাকে দেয় খানিকটা বিশ্রাম। দূরকে এনেছে কাছে, বিশ্ব এসেছে দ্বারে।

জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ত্র-য়ের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ ছিল। কিন্তু আমরা যখন এর ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেই, তখন সে দায় কোনভাবেই এর প্রতিষ্ঠাতাদের ওপর চাপাতে পারি না।
 
বিশ্বের প্রায় ৩৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে ফেসবুক ব্যবহার করে। ১৬ কোটির বাংলাদেশেও প্রায় ৬ কোটি মানুষ ফেসবুককে কেন্দ্র করে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ বজায় রাখে। দিনে দিনে ফেসবুক শক্তিশালী নিউজ এজেন্সিতে পরিণত হচ্ছে।

সবার আগে সর্বশেষ খবর জানাতে ফেসবুক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিনোদনের এমন কোন শাখা অবশিষ্ট নাই যা ফেসবুকের সাথে যুক্ত নয়। এটা মানুষকে সাহায্য করে ঘর বাঁধাতে কিন্তু কেউ যদি এর অপব্যবহার করে ঘর ভাঙ্গে, তবে সে দায় একান্তই ব্যবহারকারীর ওপর বর্তায়। পৃথিবীর সকল বস্তুর ভালো-মন্দ দু’টো দিক থাকে। সমভালো-সমমন্দের ওপর দাঁড়িয়ে তারাই উপকৃত হয় যারা এর ভালো দিকটাকে গ্রহণ করে কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের অবসরের প্রায় সবটুকু দখল করেছে ফেসবুক। মনে রাখা উচিত, ফেসবুক জীবনের ক্ষুদ্রাংশ হতে পারে কিন্তু দীর্ঘজীবন ফেসবুকের অংশ নয়। ফেসবুকের বাইরে আমাদের এক স্বতন্ত্র জগত রয়েছে, যেটা বাস্তব জগত হিসেবে বিশ্বাস করি।

বাস্তবের কিছু মানুষ, কতিপয় সম্পর্কের ভিত্তি এখানে রচিত হয়। মোহাবিষ্ট হয়ে বাস্তব আর ভার্চুয়ালের পার্থক্যকরণের ক্ষমতা যদি কেউ হারিয়ে ফেলে তবে তাকে অবশ্যম্ভাবীভাবে খেসারত দিতে হবে। জীবনের প্রয়োজনের মানুষের কিছু ব্যক্তিগত, পারস্পরিক এবং যৌথ গোপনীয়তা থাকা প্রয়োজন।

ঘুম থেকে জেগে ঘুমের অতলে গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত-সবটুকু সময়ের কর্মকাণ্ড যারা ফেসবুকে তুলে দেয় তারা নিশ্চিতভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের এ রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল বটে কিন্তু উন্নত বিশ্ব অনেক মরণঘাতী ব্যাধির থেকেও মানসিক বিকারগ্রস্থতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে তা সারানোর চেষ্টা করা হয়।  

বাথরুমে গিয়ে কি করি, স্বামী-স্ত্রীর সাথে কি সম্পর্ক, একান্ত মুহূর্ত জনসম্মুখে উপস্থিত করা, সস্তা আবেগ প্রকাশ, হুট-হাট করে গোপনীয়তা ভেঙ্গে দিয়ে আপনি হয়ত ভাবছেন মহৎ কিছু করে ফেললেন কিন্তু আপনার সাথে এমন কিছু মানুষ সংযুক্ত থাকে বা থাকতে পারে যারা আপনাকে সর্বদা অনুসরণ করে। আপনার এমন বোধহীন কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে আপনাকে অস্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ভার্চুয়াল সর্বদা ভার্চুয়াল বটে কিন্তু সেটা কখনো কখনো বাস্তবতার অংশ হয়ে যায়। আপনার অবয়ব প্রকাশের ভঙ্গি, কথা বলা, মন্তব্য করা, ভদ্রতা-বিশ্বাস মানুষের কাছে মানুষ হিসেবে আপনার স্তর প্রকাশ করে।

ফেসবুক দ্বারা একজন মানুষের মুনষ্যত্ব মাপা যায়না বটে কিন্তু মানুষ হিসেবে আপনার বোধ-বুদ্ধি কতটা গভীর সেটা অনায়াসেই প্রমাণ করা যায়। কাজেই ভার্চুয়াল হোক কিংবা বাস্তব-এমন কোন আচরণ করা আদৌ কাম্য নয়, যা আপনাকে হাসির খোরাক, তিরস্কারের পাত্র সর্বোপরি মানুষ হিসেবে অবমূল্যায়িত হতে সাহায্য করে।  

রাজু আহমেদ : কলামনিস্ট।
fb.com/rajucolumnist/

আপনার মন্তব্য

আলোচিত