দেবজ্যোতি দেবু

০৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০২:১১

ধর্মানুভূতির নামে ‘দুই চোখা’ নীতি!

নাসিরনগরে আক্রান্ত এ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাড়ি এভাবেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি : ফেসবুক থেকে

রসরাজ দাস। পেশায় জেলে এবং হরিপুর মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। উনার একটি মোবাইল ফোন আছে। সেই মোবাইলে উনি ফেইসবুক ব্যবহার করেন। ফেইসবুক জিনিসটা কি সেটা এখন বাংলাদেশের প্রতিটি বাচ্চাও জানে। হাতে মোবাইল থাকা মানেই তাতে ফেইসবুক ব্যবহারের সুবিধা রাখার একটা আপ্রাণ চেষ্টা থাকে প্রায় সকল মোবাইল ব্যবহারকারীর। তাই রসরাজ মোবাইলে ফেইসবুক ব্যবহার করেন সেটা দোষের কিছু না।

সম্প্রতি রসরাজ দাসের নামে অভিযোগ উঠে তিনি ফেইসবুকে তার আইডিতে একটি ছবি আপলোড করেছেন যাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। কি এমন ছবি ছিল সেটা যে ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে? ছবিতে দেখা যায় কাবা শরিফের উপর শিবের মূর্তি বসানো! হুম, অনুভূতিতে আঘাত লাগারই কথা! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটাও কি সম্ভব! কারণ বাস্তবে তো এই ছবির কোন অস্তিত্ব নেই। তারমানে এই ছবিটা ফটোশপ করে তৈরি করা হয়েছে, তাই না?

আচ্ছা একটু কষ্ট করে ভেবে বলুন তো আপনারা কতজন ফটোশপের কাজ জানেন? মানে একটা ছবির মধ্যে এডিট করে আরেকটা ছবি বসিয়ে সেটাকে ভিন্ন রূপ দেয়ার কাজটা কতজন পারেন একটু বলুন তো! আমি মোবাইল এবং কম্পিউটার দু'টোই অপারেট করতে পারি। কিন্তু আজ অবধি ফটোশপের কাজ শিখতে পারিনি। শুনেছি তার জন্য অনেক খরচাপাতি করতে হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই একজন অল্প শিক্ষিত জেলের দ্বারা ফটোশপ করে একটা ছবি তৈরি করতে পারার দক্ষতা নিয়ে আমার সংশয় জেগেছে। আদৌ কি তিনি তা করতে পারেন? বলতে পারেন, সেটা অন্য কাউকে দিয়ে তিনি করিয়েও নিতে পারেন। হ্যাঁ, সেক্ষেত্রে দোষী তো দুইজন। তাহলে একা রসরাজকে দোষী বানানো হচ্ছে কেন?

সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, রসরাজের ফেইসবুক আইডি থেকে ছবিটি প্রকাশ হবার পরে ফারুক মিয়া নামের একজন রসরাজকে বেধড়ক পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। এই ফারুক মিয়ার পরিচয় জানতে গেলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশ্বাসঘাতক রাজাকার তাইজুদ্দীনের ছেলে হচ্ছে এই ফারুক মিয়া। সে হরিপুর মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি হবার পাশাপাশি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। রাজাকারের ছেলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি! যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে নিজেদের দাবি করে।

থাক, সেদিকে না হয় না যাই। মূল বিষয় হচ্ছে, রসরাজকে পুলিশে সোপর্দ করার পরপরই তাকে আদালতের সামনে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়। দু'দিন পরে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন জানালে আদালত তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অথচ রসরাজ বারবার বলছেন তিনি এটা করেননি, এ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু পুলিশ এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করেই তাকে রিমান্ড পর্যন্ত নিয়ে গেছে! রিমান্ডে রসরাজের অবস্থাটা এখন কেমন তা শুধু রসরাজই জানেন। আপাতত রসরাজের ভাগ্যটা আদালতের উপরই ছেড়ে দিলাম।

অন্যদিকে এই ছবিকে কেন্দ্র করে ঐ এলাকায় হিন্দুদের শত শত ঘরবাড়ী এবং মন্দির ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার দাবিকারী একটা গোষ্ঠী!

ঠিক একই সময়ের একই রকম ঘটনায় অভিযুক্ত এক স্কুল শিক্ষকের কথা বলি। তার নাম মো. জাহুরুল ইসলাম বুলবুল। তিনি পাবনার মির্জাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার ফেইসবুক আইডিতে হিন্দুদের দেব-দেবীদের নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে একটি পোস্ট দিয়েছেন! এক্ষেত্রে অবশ্য ফটোশপের কোন সুযোগ নাই। কারণ এটা ফেইসবুকে লিখে পোস্ট দেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ প্রথম বলেছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নেয়া হয়েছে। এই পোস্ট তিনি লিখেছেন নাকি অন্যকেউ তার আইডি হ্যাক করে এমন পোস্ট দিয়েছে সেটা তারা তদন্ত করে দেখবেন। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলেই বরং বুলবুলকে গ্রেফতার করা হবে। পরেরদিন খবর প্রকাশ হয়, বুলবুলকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। ছেড়ে দেয়ার কারণ হিসেবে পুলিশের দাবি, বুলবুলের আইডি হ্যাক করে অন্যকেউ এটা পোস্ট করেছে এবং এরসাথে বুলবুল জড়িত না। এজন্য বুলবুল নাকি দু:খ প্রকাশ করে আরেকটি পোস্ট দিয়েছে! পুলিশ নাকি আইডি হ্যাক হবার প্রমাণও পেয়েছে! তাই বুলবুলকে সসম্মানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে! পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হবে।

নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের কথা মনে আছে? কয়েকমাস আগে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে স্যারকে কিভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল মনে আছে? মিথ্যা বলছি কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এরপরও স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন কিভাবে তাঁর সাথে ব্যবহার করেছিল তা মনে আছে নিশ্চয়ই?

মাত্র ১০ দিন আগে চট্টগ্রামের শিক্ষক স্বপন বাবুকে কিভাবে কথিত ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা লাঞ্ছিত করতে করতে স্থানীয় মফিজ মেম্বারের বাসায় নিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল সেটা জেনেছেন কেউ? কোন প্রকার সত্যতা যাচাই না করেই শুধুমাত্র শোনা কথার উপর ভিত্তি করে স্যারের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয় এবং স্কুল কমিটির মিটিং ডেকে স্যারকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়। স্যার আজ জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।

একই রকম অপরাধের অভিযোগ উঠেছিল চারজনের নামে। কিন্তু রসরাজকে পাঠানো হলো রিমান্ডে, দুইজন শিক্ষকের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হলো আর একজনকে শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক করা হলো! কেন তার ক্ষেত্রে আইডি হ্যাক করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধোয়া তোলা হলো? কেন তাকে আদালতের সামনে হাজির না করেই ছেড়ে দেয়া হলো? সবই কি তাহলে নামের খেলা? ধর্মানুভূতি কি তবে শুধুই নামের উপর নির্ভরশীল?

একজন সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অমানুষকে এভাবে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়া, সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় না এনে উলটো ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা, নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় গাফিলতি থাকার অভিযোগ ওঠা ইউএনও এবং ওসিকে মন্ত্রীর ক্ষমতা খাটিয়ে বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা কি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমর্থন যোগাচ্ছে না? একটা অপরাধ করে বেঁচে যাওয়া মানে আরেকটা অপরাধ করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পাওয়া। তাহলে আমরা কেন সেই সুযোগ করে দিচ্ছি?

স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যতোগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে তার কতোগুলোর বিচার হয়েছে? কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোন এক অজানা কারণে হামলাকারীদের কোন পরিচয় পুলিশের কাছে থাকে না! অজ্ঞাতনামা পরিচয় দিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। কেন, কোন হামলাতেই কি কাউকে চিনতে পারা যায়নি? যদি একজনকেও চিনতে পারা গিয়ে থাকে তাহলে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা হয়না কেন?

ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ফেইসবুকে কিছু না লিখার আহ্বান জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেই লিখার কারণে যাকে গ্রেফতার করা হয় তাকে আবার ভিন্ন কথা বলে থানা থেকেই ছেড়ে দেয়া হয় কেন? একই অপরাধে একজনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়, মামলা করা হয়। আর আরেকজনকে থানা থেকেই ছেড়ে দেয়া হয় কেন? কেন তাকে আদালতে নেয়া হয় না, রিমান্ডে নেয়া হয় না? এমন দু'চোখা নীতি কেন? ফেইসবুকে কিছু লিখে কারো অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যদি অপরাধ হয় তাহলে রসরাজের মত বুলবুলও অপরাধী। বুলবুলকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে আমি রসরাজেরও মুক্তি দাবি করছি। শিক্ষক স্বপন বাবুর জন্যও ন্যায় বিচার দাবি করছি। উনার হারানো সম্মান এবং চাকরি ফেরত দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।

অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা আবেদন রেখে যাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের মানুষ আজ ধর্মানুভূতি এবং সাম্প্রদায়িক হামলা নামক দুটি দানবের জন্য আতংকে আছে। দয়া করে তাদের এই দুটি দানব থেকে মুক্তি দিন। শক্ত হাতে এদের মোকাবেলা করুন। দেশের মানুষ আজ সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কিত। তাদের পাশে দাঁড়ান। ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ করতে আপনার শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করুন। ধর্মানুভূতির নামে এমন দুই-চোখা নীতি মানুষের মনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছে। মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে। আপনি কি সেই সুর শুনতে পাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো মানুষের মধ্যে আর সহ্য করার ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকবে না। তখন তারা হয়তো নিজেরাই নিজেদের বাঁচাতে অস্ত্র হাতে তুলে নিবে। এতে করে দেশে আইনের শাসন নষ্ট হয়ে যাবে। দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগবে, সম্প্রীতি নষ্ট হবে। এমন ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবার আগেই পরিস্থিতি সামলান। এমন দুই-চোখা নীতি ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে শক্ত হাতে সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবেলা করুন। না হলে একদিন হয়তো এমনও আসবে যেদিন দেশে কোন মানুষ থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি এতো বেশি শক্তিশালী হবে যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো দূরের কথা, তাঁর নামটাও আর অবশিষ্ট থাকবে না।

  • দেবজ্যোতি দেবু : সংস্কৃতিকর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত