ফরিদ আহমেদ

২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০২:৩৫

প্রীতি

২০০৫ সাল।

রাজশাহী শিশু একাডেমীতে মন্ত্রী আসবেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী।

প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার দেওয়া হবে। সেটারই প্রধান অতিথি তিনি।

মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানানো হবে। মঞ্চের পাশেই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর এক বাচ্চা মেয়ে। সবেমাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। খুবই সপ্রতিভ, দুর্দান্ত সাহসী এবং দারুণ চটপটে সে।

যে কোনো মন্ত্রী, সাংসদ বা বিদেশী অতিথি এলে, ফুলের তোড়া উপহার দেবার জন্য সবসময়ই ডাক পড়ে তার। এই ভূমিকা আগে অসংখ্যবার করেছে বলে তেমন কোনো বিকার নেই তার মধ্যে।

হঠাৎ করে লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। মন্ত্রী এসে গেছেন। বাচ্চা মেয়েটাও সামান্য নড়েচড়ে প্রস্তুত হয়। তার কাজ শুরু হবে এখনই যে।

মাইকে ভেসে আসে উপস্থাপকের কণ্ঠ। সম্মানিত সুধী, আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী মান্যবর আলী আহসান মুজাহিদ। তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানাবে ছোট্ট মণি প্রীতি।

ঘোষণা কানে যেতেই বাচ্চা মেয়েটা স্থির হয়ে যায়। পাশে দাঁড়ানো শিশু একাডেমীর পরিচালক সুখেন মুখার্জী আস্তে করে তাকে বলেন, 'যাও।'

যেনো কোনো কথা শোনে নি এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সুখেন মুখার্জী এবার তাড়া দেন, 'কই যাচ্ছো না কেনো?'

মন্ত্রী এসেছেন। এতো বড় একটা অনুষ্ঠান। গভীর উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন তিনি।

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' কঠোর স্বরে বলে প্রীতি।

বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে চোয়াল হা হয়ে যায় সুখেন মুখার্জীর। প্রীতির কথাটা ঠিকমতো শুনেছেন কিনা, সেটা নিয়েই নিজের মধ্যে সন্দেহ জাগে তাঁর। প্রবল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কী বললে?'

'এই রাজাকারটাকে ফুল দেবো না আমি।' টেনে টেনে কঠিন গলায় বলে প্রীতি।

পড়তে শেখার পর থেকেই বইয়ের পোকা সে। রাজাকার কী, সেটা খুব ভালো ভাবেই জানে। মুজাহিদ কী ছিলো একাত্তরে, সেটাও খুব ভালো করে জানা আছে তার।

প্রীতিকে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালান সুখেন মুখার্জী। কোনো কাজ হয় না তাতে। একরোখা ভঙ্গিতে ঘাড় গোঁজ করে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে সে।

প্রীতিকে পটাতে ব্যর্থ হয়ে সুখেন মুখার্জী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান অন্য কোনো বাচ্চার খোঁজে। এই একগুঁয়ে এবং অমিত তেজি মেয়েটা যে মন্ত্রীকে ফুল দেবে না, সেটা তিনি তার ভাব দেখেই বুঝে গিয়েছেন।

তিনি নিজেও এই রাজাকারটাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। ফুল দিয়ে একে স্বাগত জানাতে না হলে, নিজেই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু, কিছু করার নেই। চাকরি তো বাঁচাতে হবে। বউ, বাচ্চা আছে তাঁর। চাকরিটা গেলে যে, না খেয়ে মরতে হবে।

সুখেন মুখার্জী চোখের আড়াল হতেই, খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমন এক জায়গায় ফুলের তোড়াটাকে লুকিয়ে ফেলে প্রীতি তড়িৎ গতিতে।


ফুলের মালা নয়, গলায় ফাঁসির দড়ি প্রাপ্য এই সব রাজাকারদের।

ফরিদ আহমেদ: প্রবাসী লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত