রাজু আহমেদ

১৫ আগস্ট, ২০১৬ ০১:৩০

১৫ আগস্ট : রক্তক্ষরণের দিন

আগস্ট এলেই মনের গহীনে হু হু করে কান্নার রব ওঠে, বেদনার রঙ জাগে। আগস্টে আমাদের দেশ এমন কিছু মহীরুহকে হারিয়েছে যাদের শূন্যস্থান কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়।  তাদের মৃত্যু অগণিত মানুষকে নিভৃতে কাঁদিয়েছে এবং আজও কাঁদায়।

অতীতের বিভিন্ন বছরের আগস্টে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের সকলের কথা উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও অন্তত ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাঙালি জাতির আত্মছবি অঙ্কিত করার নিপুণ কারিগর তথা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান, ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বাঙালীদের প্রাণের কবি তথা সাম্য, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ, ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট আধুনিক বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যু, ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির রজ্জুতে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যু স্মরণযোগ্য।

তবে সকল মৃত্যুর দুঃখকে ছাপিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি বাংলাদেশীদের কাছে এক বিভীষিকার দিন। প্রতি বছরের এ দিনটিতে বাংলাদেশীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ১৫ আগস্টের বুকে চাপা কষ্টগুলো যখন জেগে ওঠে তখন প্রত্যেক বাংলাদেশীকে মৃত্যুসম যন্ত্রণা দেয়, জাতি হিসেবে আমাদের গাদ্দারীর চিত্র সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদের অথর্বতা প্রমাণ করে। সাহিত্যে সমৃদ্ধির জন্য যেমন নজরুল, রবীন্দ্রনাথদের প্রয়োজন ছিল তেমনি পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অস্বীকার করা বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধকে উপেক্ষা করার নামান্তর।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার শক্তি-সামর্থ্য দেশের কোটি মানুষের ছিল কিন্তু সকল যোদ্ধাকে সমন্বয়-সংগঠিত করে প্রেরণা এবং কৌশল দেয়ার নেতৃত্বের গুণাবলী কেবল শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল। সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে যে মানুষটিকে স্থান দেয়ার কথা ছিল তাকে কেন্দ্র করেই আমরা রাজনীতির মাঠে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করেছি। এত বঙ্গবন্ধুর লাভ-ক্ষতি কতটুকু হয়েছে তা জানিনা তবে আমরা যে হীনমন্যতা দেখিয়েছি, তাতে সন্দেহ নাই।

১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি। পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠী যে মানুষটিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আগরতলা মামলার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন সেই বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশীদের নয়নের মনিতে পরিণত হয়। জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কামাল আতাতুর্ক ছাড়া যেমন আধুনিক তুরস্ক, নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছাড়া যেমন ভারতের ইতিহাস পূর্ণতা পায়না তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু একটি নাম একটি অসমাপ্ত ইতিহাস।

১৯৪৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর আমৃত্যু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশীদের মুক্তি ও অধিকার ফিরিয়ে আনতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত তিনি এ জাতির পক্ষে ত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন। পাকিস্তানে বর্বর শাসকগোষ্ঠী যখন সর্বত্র থেকে বাংলা নামক শব্দটি উচ্ছেদে ব্যস্ত তখন তিনি বুক চিতিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় সংকল্প। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরণসভায় উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এক সময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে, একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোন কিছুর সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। আজ আমি ঘোষণা করছি এটা পূর্ব পাকিস্তান নয় শুধু বাংলাদেশ’।

দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পর ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর স্থান করে নেয় আরেকটি রাষ্ট্রের নাম। আর সেটা আমাদের লাল-সবুজ পতাকাখচিত বাংলাদেশ। যে দেশের ইতিহাস পাঠ করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর নাম অবশ্যই বারবার উচ্চারিত হবে। যে মানুষটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের জন্য তার জীবন-যৌবন উৎসর্গ করলেন তাকে আমরা কতটুকু ভালোবাসতে পেরেছি ? বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় কিছু কিছু দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিরা আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী, আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি ও কিং মার্টিন লুথার এবং লেবাননের কামাল জুমলাত উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালোরাতের শেষ প্রহরে কয়েকজন বিপথগামী সেনা অফিসার ও সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিহত হন। নিহতের তালিকায় যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্র্মীনি, পুত্র-পুত্রবধূ তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা এবং তার গর্ভবতী স্ত্রীসহ ছিল আরও অনেক।  দুর্বৃত্তদের নির্মম বুলেটে শেখ মুজিবুর রহমানের ৪ বছরের নিষ্পাপ শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে যেমন রেহাই দেয়নি তেমনি আব্দুল্লাহ সেরনিয়াবাতের ৪ বছরের নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবুও রক্ষা পায়নি। পড়াশুনার জন্য জার্মানিতে অবস্থান করায় বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানা সেদিনের নৃশংসতা থেকে প্রাণে বেঁচেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ৪১তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ, তার ত্যাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন, দেশপ্রেমের মনোভাব জাগ্রত করুন। ঘাতকরা ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পেরেছে কিন্তু তার আদর্শ, দর্শন কিংবা শিক্ষাকে কি কোনদিন দমিয়ে রাখতে পারবে? ’৭১ সালের মার্কিন সাপ্তাহিকী ‘নিউজ উইকে’ লোরেন জেঙ্কিসের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল বিবিসি বাংলার জরিপে তাকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় ভূষিত করেছে।

সবশেষে শুধু এটুকুই বলবো-
ভুলি নাই বাবা, ভুলি নাই তোমায়, ভুলি নাই তোমার নাম,
বুকের রক্ত দিয়ে হলেও রেখে যাব তোমার মান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত