১৮ জুন, ২০২০ ১২:৫০
সেই শৈশবে ১৯৮৯-১৯৯০ সালের কোন একদিন প্রথম দেখেছিলাম সফেদ পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামা পরা টগবগে যুবক, তাঁর নিজ এলাকার খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলা উদ্বোধন করতে এসেছেন। পৌরসভার ৩ নং তোপখানা ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার ছিলেন তখন, খেলায় পাড়ার ছেলেদের উৎসাহ দিতে ব্যাট হাঁকাতেও কার্পণ্য করলেন না। ছেলেবুড়ো সবাই খুবই সমীহ করতো তখনও, করার কথাও কারণ এই ছেলেই কিনা তাদের মান রেখেছে মাত্র ২২/২৩ বছর বয়সে সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হয়ে। ঝানু রাজনীতিবিদ কাষ্টঘরের ঝর্ণা বাবুর মতো ব্যক্তি যিনি কিনা মিউনিসিপালিটি হওয়ার আগেও বেসিক ডেমোক্রেসি মেম্বার ছিলেন, সেই ঝর্ণা বাবু ও বদর উদ্দিন কামরান সেইবার ভোটযুদ্ধ জয় করে কমিশনার হলেন।
থিয়েটার ও গান-বাজনা করা সেই কামরান ছাত্রজীবনেও ভাল ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সেশনে এমসি কলেজে করেছেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নানা নাটকীয়তা ছিল তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে, প্রথম কম বয়সে কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা সিলেটের প্রবীণ জননেতা প্রয়াত ফরিদ গাজীর হাতে ছেলেকে সপে দিয়েছিলেন। একদশক পর আবারও নির্বাচনী মাঠে তিনি, কমিশনার নির্বাচনে প্রথমে ভোটকেন্দ্র থেকে খবর আসে কামরান ১৮ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। কমিশনার ঝর্ণা বাবুর ছেলে রাম বাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ফোন করে রাম বাবুকে অভিনন্দিতও করেন। যদিও সেইবার একেবারে শেষ মুহূর্তে মাত্র ৭ ভোটে কামরানকে জয়ী ঘোষণা করেন দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার।
পরপর ৩ বার পৌরসভার কমিশনার হয়ে আরও চমকের অপেক্ষা, চেয়ারম্যান বাবুলের পর কেউই দলের মান রাখতে পারছিলেন না। ইফতেখার হোসেন শামীমের মতো মার্কা মারা নেতাও পরাজিত অপেক্ষাকৃত সৎ ও জনপ্রিয় বিএনপি দলীয় প্রার্থী আ.ফ.ম কামালের কাছে। সিলেটে আওয়ামী লীগ চলে যাদের ইশারায় সেই দুই জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ও দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবকে নিজের ব্যাপারে ইতিবাচক করে কারিশমা দেখান সেইবার। ১৯৯৫ সালে একজন ওয়ার্ড কমিশনার থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে নাটকীয় ভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। একই বছর সিলেট কোর্ট পয়েন্টে ক্ষমতাসীন বিএনপি আওয়ামী লীগ এর সভার হামলা চালায় আহত হন বদর উদ্দিন কামরানসহ বেশকিছু নেতাকর্মী। এর আগে ১৯৮৯ সাল থেকে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান, বর্ষীয়ান জননেতা শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইরশাদ আলী তখনও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
২০০২ সালে সিলেট পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়, কামরান সিসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মনোনীত হন। ২০০৩ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জিতে সিসিকের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে আবারও চমক সৃষ্টি করেন তিনি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে আরও অনেক রাজনীতিবিদের মত কামরানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা কামরান কারাগারে থেকে নির্বাচন করেও বিপুল ভোটে জয়ী হন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন কামরান। সেই দায়িত্ব তিনি সামলেছেন প্রায় দেড় যুগ।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ পাওয়া কামরান বর্তমান কমিটিতেও একই পদে ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাদামাটা চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলেন, আমি অনেক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সম্ভবত মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান ইলিয়াসের বিয়েতে তিনি একটু দেরি করে পৌঁছায় তিনি অতিথিদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসার জায়গা না পেয়ে তিনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘বাবা দেখো আমি কিন্তু রান্নাঘরে বসে খানেওয়ালা লোক’। যেই কথা সেই কাজ, চোখের পলকে তিনি কমিউনিটি সেন্টারের ডাইনিং পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। সেখানে দুইটি চেয়ার একসাথে করে একটিতে বসে পড়লেন, অন্যটিতে থালা রেখে খেতে শুরু করলেন। জনতার নেতা তো এমন হওয়াই চাই, কোন ভাবসাব থাকবে না। আসলে ডায়াবেটিস রোগ তাঁর শরীরে বাসা বাঁধায় বিয়েশাদিতে খুব একটা খাওয়াদাওয়া করতেন না, ইনসুলিনের সূচে শরীরে অসংখ্য ক্ষত। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় তাঁর মতো নিপাট ভদ্রলোক জনতার ‘কামরান’ আরও পাঁচ দশকেও সিলেটের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
২০১৭ সালের কথা, বৃহত্তর সিলেট কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক সংগঠনের অভিষেক হবে জেদ্দা শহরে, সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ ও আমি নিজে অনুষ্ঠানে অতিথি। অনুষ্ঠানের পূর্বে পবিত্র ওমরাহ পালন করতে আমরা তখন পবিত্র নগরী মক্কাতে অবস্থান করছি। এটাই ছিল তাঁর জীবনে শেষবারের মতো আল্লাহপাকের পবিত্র ঘর তাওয়াফ করার ঘটনা। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন তাঁর পক্ষে আমাদের কেন্দ্রে বেশ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করায় কোনরকমে কেন্দ্রে তাঁর বিজয় নিশ্চিত হলেও তিনি পরাজয় বরণ করেন। পরেরদিন রাতে তাঁর বাসায় গিয়ে বিমর্ষ অবস্থায় দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ি, আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেন। কামরান চাচা জীবনে আরও কতো হাসি কান্নার ইতিহাসের সাক্ষী তা বলে শেষ করা যাবে না। ২০১৬ সালের মে মাসে আমার বিয়ের পরদিন সকালবেলা আমার ফোনে ফোন করে অনেক সময় নিয়ে কথা বললেন, আমার সাথে কথা বলে আমার স্ত্রীর সাথেও কথা বললেন। ওর কাছে করলেন আমার প্রশংসা আর আমার কাছে ওর প্রশংসা, যেন পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস আর ভালবাসার অদৃশ্য গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। তাইতো তাঁর মৃত্যু সংবাদে বেশ বিচলিত দেখলাম নিজ সহধর্মিণীকে।
করোনার বেশ কয়েকটি উপসর্গ নিয়ে আমি নিজেও আইসোলেশনে আছি নিজ বাসায়। কামরান চাচার মৃত্যুর একদিন আগে স্যাম্পল দিয়ে আসলেও আজ পর্যন্ত করোনার রিপোর্ট হাতে এসে পৌঁছায়নি। তাই বাসা ও জানাজার স্থান খুব নিকটে হওয়ার পরও তাঁর জানাজা নসীব হয়নি। শারীরিক আইসোলেশন সম্ভবপর হলেও মানসিক আইসোলেশন কখনো যে সম্ভব নয় সেটি বাসায় বসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। একটি নির্ঘুম রাতের পর শোকার্ত দিনের দৈর্ঘ্য যে কতো দীর্ঘ হতে পারে তা কামরান চাচার মৃত্যুর পরই প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছি। মহামারীতে মৃত্যুবরণকারীর প্রতি মৃত্যুর পর শহীদী দরজা উন্মুক্ত হয়। আপনি নিঃসন্দেহে জান্নাতের মেহমান, অসীম সময় ধরে ভাল থাকুন।
রাহাত তরফদার: সাবেক সভাপতি, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগ।
আপনার মন্তব্য