ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ

০৮ এপ্রিল, ২০২০ ০২:০৬

চিকিৎসকদের ঝুঁকিভাতা, সিদ্ধান্তের মালিক আপনিই

আমি কখনোই ঝুঁকিভাতা চাইনি। ❛ঝুঁকি ভাতা না দিলে রোগীসেবা দেবো না❜- এমন শর্ত দেওয়ার তো প্রশ্নই আসেনা। আমাদের সহকর্মীদের কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝুঁকিভাতার এ্যাপিল জানালেও আমি হলফ করে বলতে পারি কেউই কোন শর্ত দেয়নি, কেউই বলেনি যে ঝুঁকিভাতা না দিলে তারা রোগীসেবা দেবে না।

আমি আগের এক লেখায় লিখেছিলাম আমি ঝুঁকিভাতা চাই না। আমি স্পষ্ট করে বলেছিলাম রোগীর সেবা দিতে গিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না করোনাক্রান্ত হচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত রাজকোষ থেকে এক পয়সায়ও অনুদান বা ভাতা চাই না। আমি শুধু বলেছিলাম, রোগীর সেবা দিতে গিয়ে নিজে যদি করোনাক্রান্ত হই তাহলে রাষ্ট্র যেন আমার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে, আর যদি করোনাক্রান্ত হয়ে এই পৃথিবীর আলো বাতাসে আর ফিরে না আসি তাহলে রাষ্ট্র যেন আমার পরিবারের জন্য একটা বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করে।

আজ আমার মোহভঙ্গ হয়েছে। যে রাষ্ট্রের শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত প্রতিটা পরতে পরতে চরম মাত্রায় চিকিৎসক বিদ্বেষ সেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমি আর কিছুই চাই না, কিছুই আশা করি না। না কোন বীমা চাই না, কোন ভাতা চাই না, কোন অনুদান চাই না। আমি চাই না আমার নাম কোন বীমার লিস্টে উঠুক।

রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে যদি করোনাক্রান্ত হই, যদি তখন চিকিৎসা না করাতে পারি হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেবো। আমার পরিবারের জন্যও কোন অনুদান চাই না। আর দশটা পরিবারের ক্ষেত্রে যা ঘটে আমার পরিবারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে, চিন্তা কী? আর দশটা অতি সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতটা যেমন হতে পারে আমার মাসুম সন্তানটির ভবিষ্যতও তেমনি হবে, ক্ষতি কী?

খুব বেশিদিন আগে নয় এইতো মাত্র গতবছরই আমার ১৫ জন চিকিৎসক সহকর্মী এই রাষ্ট্রেরই নাগরিকদেরকে ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদেরকে মৃত্যুর হাতে সপে দিয়েছিলো! কী পেয়েছে তারা? কী পেয়েছে তাদের পরিবার? এই রাষ্ট্র কি তাদের আত্মত্যাগকে কোন স্বীকৃতি-স্যালুট জানিয়েছে? এই রাষ্ট্র এই একবছরে একবারও তাদের পরিবারের খোঁজ নিয়েছে?

আমার সেই সহকর্মীর পরিবার ও সন্তানেরা যেভাবে বেঁচে আছে আমার পরিবার ও সন্তানেরাও সেইভাবে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নেবে, ইনশাল্লাহ।

জানিনা কোন চিকিৎসক বা কয়জন চিকিৎসক করোনার ভয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছে! কখনো কি শুনেছেন কোন সেনাপতি তার সৈন্যদলকে কোনরকম যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিয়েছেন? যদিও আপনারা সেই শুরু থেকেই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে আসছেন যে আপনাদের শতভাগ প্রস্তুতি আছে কিন্তু আমরা দেখলাম বাস্তবতা একেবারে শতভাগ উল্টো। আমরা দেখলাম করোনা যখন প্রথম আঘাতটা হানলো তখনও আমাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই, কোন বর্ম (পিপিই) নেই! সেই পরিস্থিতিতে কোন চিকিৎসক যদি ভয় পেয়ে থাকেন তবে সেটা কি অন্যায়? হয়তো কেউ কেউ ভয় পেয়েছেন ঠিকই তবে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কেউ পালাননি।

আঘাত হানার প্রায় দশদিন পর যে বর্ম (পিপিই) আমাদেরকে দিলেন তাও নিছকই অপ্রতুল, সেই অপ্রতুল বর্ম গায়ে চড়িয়েই যুদ্ধের ময়দানে থেকেই আমরা জান লড়িয়ে যাচ্ছি। আপনারা অবশ্য ফাঁকা বুলি এখনও আউরে যাচ্ছেন- আপনাদের হাতে লাখ লাখ বর্ম (পিপিই) আছে। যেসব উপজেলায় ন্যূনতম ১৫ জন চিকিৎসক পোস্টেড সেখানে দিচ্ছেন মাত্র ৪টি করে বর্ম (পিপিই)। তারপরেও আপনাদের গলাবাজি এখনো থামেনি!

অনেক মোড়ল হয়তো ছুটে এসে বলবেন ব্রিটেনে চিকিৎসকরা ময়লা ফেলার পলিথিন পরে রোগী সামলাচ্ছে আর তোমরা পিপিই-পিপিই করে গলা ফাটাচ্ছো! তাদেরকে বলতে চাই যুদ্ধের তিনমাস পরে এসে ব্রিটেনের এই অবস্থা। আপনার কেন যুদ্ধের শুরুতেই এই অপ্রতুলতা যেখানে আপনারা তিনমাস আগে থেকেই বলে আসছেন আপনারা শতভাগ প্রস্তুত!

এতো অব্যবস্থাপনা এতো অপ্রতুলতাকে মেনে নিয়েই আমরা জান লড়িয়ে যাচ্ছি তবুও আজ পর্যন্ত কারো হাসিমুখের একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত পেলাম না! প্রতিদিন হাজার হাজার লাখ লাখ রোগী সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে তাদের কথা কেউ বলছে না! একটা দুটো অনিয়ম হলেই পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! এমনকি যে রোগীটি সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে সেই রোগীটিও কখনো কখনো চিকিৎসকের চৌকাঠটা পেরিয়েই চিকিৎসককে ❛কসাই❜ বলে গালি দিচ্ছে!

আজ (মঙ্গলবার) প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর দেশের প্রায় শতভাগ চিকিৎসকের মতো আমিও কষ্ট পেয়েছি। সেই কষ্ট থেকেই এই লেখা! তবে এই বিষয় নিয়ে এটাই শেষলেখা আর লিখবো না।

প্রিয় চিকিৎসক ভাইয়েরা, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, অনেকেই অনেককে দুষছেন, আমিও হয়তো দুষছি। অনেকেই বলেছেন আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে আমাদের পেশার মর্যাদাহানি হয়েছে। যদি সত্যিকার অর্থেই তাই মনে করেন তাহলে আপনিও প্রতিজ্ঞা করেন যে কোন ঝুঁকিভাতা বা বীমা সুবিধা না নিয়েই আপনি রোগীসেবা দেবেন তাতে যা হয় হোক। প্রতিজ্ঞা করেন বীমার লিস্টে নাম তুলার জন্য লাইন না দিয়েই রোগীসেবায় মনোযোগ দেবেন।
জীবনই যদি না থাকে কী করবেন এই পাঁচ লাখ, দশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ কিংবা কোটি টাকা দিয়ে! যদি পেশার মর্যাদা নিয়ে এতটুকু খেদ থাকে তাহলে এই গাটসটুকু দেখান আর তা যদি না পারেন তাহলে পেশার মর্যাদার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে হাহুতাশ করার বা অন্যকোন নেতাকে দোষারোপের কোন অধিকারই আপনার নেই।

আপনিই আপনার সিদ্ধান্তের মালিক। আপনার আপনার করে একেকজনের সিদ্ধান্ত মিলেই হাজার জনের সিদ্ধান্ত। হাজার জনের সিদ্ধান্তই পারবে পেশার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে, কোন নেতা এককভাবে পারবে না!

  • ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ: সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ); সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত