
০২ অক্টোবর, ২০২৫ ০০:৫৫
নিজ ভূমি ছেড়ে বিদেশে বসবাসের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের। নানা বয়স ও শিক্ষার মানুষ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়। এক অংশ শিক্ষার জন্য ও আরেকটি অংশ কী করে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে নাগরিকত্ব পাবে এবং ইউরোপ বা আমেরিকায় বাস করবে, সেই স্বপ্নে মশগুল থাকে। এই শেষের দলটার গলায় কোপ মেরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
সম্প্রতি, বাংলাদেশসহ সাতটি দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন 'নিরাপদ' হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই প্রথম এমন বিপত্তি বাধিয়েছে ওরা। কী করে ঘটল? ইতালি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদর দপ্তরে জানিয়েছে, তারা আর বাংলাদেশের লোককে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি না। বলছে, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ। ইউরোপীয় কমিশনের ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশ, কসোভো, কম্বোডিয়া, মিশর, ভারত, মরক্কো ও তিউনিশিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত। অন্য দেশের বিষয়ে কিছু বলা মুশকিল, কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশকে নিরাপদ ঘোষণা দিয়ে এটা কি একটা রাজনৈতিক সার্টিফিকেট? মনে হয় না।
মূলত, ইতালির লোকজন ও প্রশাসন বাংলাদেশের মানুষদের নানবিধ নেতিবাচক আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে ইতালির রাজধানী রোমে প্রবেশ করে সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। আসলে আমাদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই এই পথ তারা বেছে নিয়েছে। তবে যে কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুক, যারা এরই মধ্যে সেখানে পাড়ি দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ জটিল আবর্তে পড়ল।
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে এরা কী করে? যখনি দেশে সরকার বদল হয় বা সরকার বদলে একটা রাজনৈতিক দল আরেকটা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ওপর অত্যাচার করে, তখন সেই অত্যাচারিত দলের সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই ফর্মুলায় বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার লোক নাগরিকত্ব পেয়েছে। কিন্তু নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশসহ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে এবং যেহেতু তাদের আবেদন প্রক্রিয়া দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আসবে। এর আগে এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দশ, বারো বছরও লাগত। এখন এই দীর্ঘসূত্রিতা থেকে অনেক সময় কমে যাবে। তবে ভাবার কারণ নেই, এসব মামলার নিষ্পত্তি কয়েক মাসেই করে ফেলবে। এই নতুন পরিস্থিতিতে যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে, এদের অনেকেই বিপাকে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই নীতিমালা কি তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করবে? তাদের বিদেশে থাকা সম্পদ ও অর্থের নিরাপত্তা কীভাবে হবে?
রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রক্রিয়াটি কী? একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী ইউরোপে ঢুকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে সেই দেশে আবেদন করে। সেই আবেদনটিকে মামলা হিসেবে ঐ দেশ বিবেচনায় নেয়। এই চিত্রের ওপর এবার শোনা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কঠোর সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, প্রতিটি আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন তার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করা উচিত; কোনো দেশকে 'নিরাপদ' বা 'অসম্পূর্ণ নিরাপদ' হিসেবে বিবেচনা করে সেই ব্যক্তির আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ করা ঠিক নয়।
ঐ দেশগুলো তাদের মাটিতে অনেক অপরাধীর কারণে বিরক্ত। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিচিত্র। ১৭ বছর ঢাকার জার্মান দূতাবাসে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি, সময় ছিল ১৯৯৭ থেকে ২০১৩। সেই সময় আমি বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া প্রার্থীদের ফাইল পরীক্ষা ও অনুমোদনের চূড়ান্ত দায়িত্বে ছিলাম। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক আবেদন বাংলাদেশে আইনজীবীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই হয়ে দূতাবাসে যেত এবং এরপর সেগুলো পুনরায় পরীক্ষা করা ছিল আমার কাজ। বিস্ময়কর হলো, এই প্রার্থীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই জাল দলিল ব্যবহার করে দাবি করত, তারা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য এবং দেশে সহিংসতার শিকার!
রাজনৈতিক আশ্রয়সংক্রান্ত এই দৃশ্যের উলটোদিকে ইউরোপের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলছে, এর ফলে তালিকাভুক্ত দেশগুলো থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন দ্রুত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ পাবে ইইউ দেশগুলো। ইইউর অভিবাসন বিষয়ক কমিশনার মাগনুস ব্রুনার বলেন, 'আশ্রয় আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জটের মুখে পড়েছে অনেক সদস্য দেশ। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইউরোপীয় কমিউনিটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে পুরোপুরি বিবেচনায় নেয়নি। তবু বলব, বাংলাদেশের ভেতর চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা, ভঙ্গুর মানবাধিকার পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেওয়া এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অনেক মানুষের কপাল পুড়িয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য আশ্রয় প্রাপ্তির ভবিষ্যৎ ইউরোপে সংকীর্ণ হচ্ছে। যারা ইতিমধ্যেই ইউরোপে আছে, তাদের জন্য আইনি এখন যা করতে পারি, সেটা হলো আশ্রয় ইস্যুতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থন জানানো, যেটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।' উল্লেখ্য, ইউরোপের দেশগুলোতে অতি-ডানপন্থি ও অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বেড়েই চলেছে। নির্বাচনেও তারা ভালো ফল করছে বলে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ঠেকাতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়াদের ডিপোর্টেশন বা ফেরত পাঠানোর চাপে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এখন প্রশ্ন উঠছে, যারা ইতিমধ্যেই ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তালিকাভুক্ত 'নিরাপদ' দেশের কারণে তাদের আবেদন প্রক্রিয়া কঠোরভাবে যাচাইয়ের মুখে পড়বে যেমন, তেমনি এটি সব সময় সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক নয়। ইউরোপীয় কমিশন প্রত্যেক আবেদন ব্যক্তিগতভাবে যাচাই করার কথা বলছে। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ইউরোপের সদস্য দেশে প্রবেশ করেছে, তারা রাজনৈতিক আশ্রয়কে একমাত্র পথ হিসেবে ব্যবহার করেনি। তাদের মধ্যে বড় অংশ ইতিমধ্যেই বিদেশে ব্যবসা বা লগ্নির মাধ্যমে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে। তাই অভিবাসীদের রাজনৈতিক আশ্রয় না দেওয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নিয়ম তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে ধারণা করি, কেননা, সহজেই অন্য উপায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে তারা। সব দেখে মনে হচ্ছে, এই প্রক্রিয়া কঠোর হবে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে দেশেও ফেরত পাঠানো হবে। এর ফলে ঐ দেশে তাদের জমাকৃত অর্থ ও সম্পদের জন্য বিশেষ ঝুঁকি তৈরি হতেই পারে।
তবে এই নীতির আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো, বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ যারা বিদেশে প্রবেশ করতে দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিচ্ছিল, তারা এবার সতর্ক হবে। হাজার হাজার তরুণ উন্নত জীবনের আশায় বিপুল অর্থ খরচ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে কেউ জেলে, কেউ কেউ বছরের পর বছর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার সুরাহায় থেকে সেই দেশে মানবেতর জীবন যাপন করে।
সর্বশেষে বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের 'নিরাপদ' দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, এ দেশের অনেক নাগরিকের রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া থেকে দূরে সরিয়ে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই বাস্তবতায়, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং নিরাপত্তার ধরনকে তারা নতুন করে হিসাব করবে। ফলে, যারা যথার্থই সহিংসতার শিকার, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি, দেশের সম্পদ লুট করা লোকজন রূঢ় বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে এবার বাধ্য হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য