নিজস্ব প্রতিবেদক

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:৫৭

সিলেটের পর্যটন বিকাশে যত বাধা

পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, হাওর, অরণ্য, চা বাগান কিংবা জলারবন- কী নেই সিলেটে! প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সিলেট। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য আর বৈচিত্রতার কারণে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান সিলেট। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে কমছে পর্যটকদের আগমন।

করোনার প্রকোপের পর কয়েদফা বন্যা- প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকার কারণে সিলেটে আশানুরুপ পর্যটক সমাগম হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিস্টরা।

ভাঙাচোরা সড়ক, অনুন্নত অবকাঠামো, নিরাপত্তাহীনতা, পরিকল্পনা ও প্রচারের অভাব, দক্ষ জনশক্তি না থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পর্যটন বিকাশে অন্যতম বাধা বলে করেন এই খাতের সংশ্লিস্টরা। এছাড়া অবাধে বালু ও পাথর লুটপাটে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্যহানির কারণেও কমছে পর্যটক।

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

ভাঙাচোরা সড়ক

২০২২ ও ২৪ সালে কয়েকদফা বন্যা হয় সিলেট। সেই বন্যার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে সিলেটের বেশিরভাগ সড়কে। নগরসহ সিলেটের পর্যটনকেন্দগুলোর বেশিরভাগ সড়কই ভাঙাচোরা।

সিলেটের অন্য দুটি পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দি ও রাতারগুল জলারবন। এই দুই স্থানে যাওয়ার সড়কই ভাঙাচোরা। ফলে এসব স্থানে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকেরা।

পর্যটন স্পট বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এ দূরত্বের গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বন্যায় সড়কের পিচ উঠে বড় বড় গর্তেও সৃষ্টি হলেও তা এখন পর্যন্ত সংস্কার হয়নি।

জলারবন খ্যাত রাতারগুলের দুরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশই ভাঙাচোরা। এ ছাড়া ওই সড়কের চানুপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। এতে বৃষ্টির দিনে পর্যটকদের যাতায়াতে চরম সমস্যা হয়। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর লেগুনা ছাড়া কোনো গাড়িই যেতে চায় না রাতারগুল ও বিছনাকান্দিতে।

চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের বিছানাকান্দিতে বেড়াতে আসা সাদমান সাকিব বলেন, সিলেটের প্রকৃতি খুবই সুন্দর। পাহাড়, নদী, হাওর, ঝর্ণা, বন- সবই আছে এখানে। কিন্তু নগর থেকে পর্যটনস্পটগুলোতে আসার সড়কগুলো ভয়াবহ রকমের খারাপ। এই সড়কগুলোই সিলেটের পর্যটনের ‘পথের কাটা’ হয়ে আছে। এসব সড়ক দিয়ে কেউ একবার আসলে আর কোনোদিন আসতে চাইবে না।

নেই অবকাঠামো
সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ। এখানকার সাদাপাথরের পাথুরে নদীতে গা এলিয়ে দিতে প্রচুর পর্যটক আসেন। সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কও অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে সাদাপাথরে পর্যটকদের জন্য ওয়াশ রুম, চেঞ্জ রুমসহ অবকাঠামোগত কোন সুবিধা। বিছানাকান্দি, রাতারগুলসহ সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্রে নেই এমন সুবিধা।

সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালি বিভাগের প্রভাষক মো. আব্দুল হালিম বলেন, সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রে কোন বিশ্রামাগার ও ওয়াশরুম নেই। এতে পর্যটকরা এসব স্থানে এসে বিপাকে পড়েন। কেবল পর্যটন এলাকায় নয়, ওইসব স্থানে যাওয়ার পথেও ওয়াশরুম নির্মাণ করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। ফলে পর্যটকরা অনেক সময় পর্যটন এলাকা নোংরা করে ফেলেন। পর্যটন শিল্পের বিকাশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরী।

তবে অবকাঠামো গড়ে তোলার নামে যাতে পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করা না হয় সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সহ-সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুর ইসলাম শাহীন।

তিনি বলেন, রাতারগুল জলারবন একটি বিশেষ প্রকৃতির বন। অথচ এই বনের ভেতরে বনবিভাগ পর্যটক আকর্ষের নামে ওয়াচ টাওয়ার নির্মণ করেছে। যা কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, বনের চরিত্রবিরোধীও। বন, হাওরের উন্নয়ন হবে স্থাপনাবিহীন।

তিনি বলেন, বন ও হাওরের মধ্যে ইঞ্জিন নৌকা চলাচলও বন্ধ করা দরকার। সিলেট অঞ্চলে বারকি নৌকা নামে হাতে টানা একধরণের বিশেষ নৌকা রয়েছে। এটা সিলেটের ঐতিহ্যও। পর্যটক চলাচলে এসব নৌকা ব্যবহার করা যেতে পারে।

পরিবহনখাতে অব্যস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতা
সিলেটে পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেও পর্যটকদের দুর্ভোগে পরতে হয়। এপসভিত্তিক পরিবহন সেবা এখানে জনপ্রিয় না হওয়ায় পর্যটকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমত ভাড়া হাকান চালকরা। পর্যটকদের কাছ থেকে মাঝিরা নৌকা ভাড়াও বাড়তি রাখেন বলে অভিযোগ আছে।

হাওর পর্যটন নিয়ে গবেষণা করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমদাদুল হক বলেন, সিলেটে পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এখানকার চালকরা সিলেটে মানুষ না হলে ভাড়া বেশি রাখেন। এছাড়া ভাড়া গাড়ি নেওয়ার মতো কোন কাউন্টার বা টিকিটের ব্যবস্থা নেই। ফলে যাত্রীদের যেমন বাড়তি ভাড়া গুণতে হয় তেমনি নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয়।

সিলেটের বিভিন্ন পর্যটকনকেন্দ্রে পর্যটকদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া বাড়তি রাখা হয় জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, বিভিন্ন এলাকার নৌকাভাড়া প্রশাসন থেকে নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। ওইসব এলাকায় চলাচলকারী নৌকাগুলিকেও নিবন্ধন ও নজরদারির আওতায় আনা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, প্রতিবছর জাফলং ও লালাখালে পানিতেডুবে অনেক পর্যটক মারা যান। প্রতিবছর এমন ঘটনা ঘটলেও পর্যটকদের নিরাপত্তায় তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। পর্যটন পুলিশ বলে পুলিশেষর একটি বিশেষ ইউনিট থাকলেও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তাদের তেমন কার্যক্রম চোখে পরে না।

লুটপাটে মলিন পর্যটনকেন্দ্র
সিলেটে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান দুটি আকর্ষনীয় স্থান গোয়াইনঘাটের জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর। অথচ এ দুটি জায়গাই এখন লুটপাটকারীদের অভয়রান্য। গত বছর ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে পাথর লুটে নিয়ে মরুভূমিতে পরিণত করা হয় সাদাপাথরকে। একই অবস্থা জাফলংয়েরও। এই দুই স্থানেই চলছে অবাধে বালি লুট। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে লুটপাট কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি।

লুটপাটের কারণে সৌন্দর্য হারিয়েছে এসব পর্যটন এলাকা। ফলে কমেছে পর্যটক

প্রচারের অভাব, তথ্যের দুস্প্রাপ্যতা
পর্যটকদের জন্য সিলেট অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান হলেও তার তেমন প্রচার বা ব্র্যান্ডিং নেই বলে মনে করেন সংশ্লিস্টরা। এছাড়া সিলেটে এলে কোথায় কিভাবে ঘুরে বেড়ানো যবে এনিয়ে সঠিক তথ্যও একস্থান থেকে পাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই।

ধর্মীয় পর্যটন বিশ্বজুড়েই সমাদৃত। সিলেটে এর বড় সুযোগ রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে হবে। প্রত্মততত্ত্ব রক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সহ-সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুর ইসলাম শাহীন বলেন, ধর্মীয় পর্যটন সারাবিশ্বেই পর্যটনের অন্যতম একটি শাখা। সিলেটেও এর সুযোগ ছিলো। কিন্তু প্রচারের অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এখানে শাহজালাল (র.) শাহপরান (র.) সহ ৩৬০ আওলিয়ার মাজার রয়েছে। শ্রীচৈতন্যের পিতৃভ’মি রয়েছে। কিন্তু এগুলো কোথায় অবস্থিত, কোনটি কি বৈশিষ্ট তা নিয়ে কোন প্রচারণা নেই।

তিনি বলেন, নগরের চাষনী পীর এলাকার মাজারে প্রচুর সংখ্যক বানর রয়েছে। এটি ভালোভাবে প্রচার করা হলে সিলেটে আসা পর্যটকরা বানর দেখার জন্য সেখানে যেতেন।

শাহীন বলেন, সিলেটে অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশন রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণ ও ভালোভাবে ব্র্যান্ডিং করা গেলেও অনেক পর্যটক আসতেন। সিলেটে এর বড় সুযোগ রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে হবে। প্রত্মততত্ত্ব রক্ষা করতে হবে।

পর্যটকদের জন্য আলাদা একটি তথ্য বাতায়ন গড়ে তোলা প্রয়োজন জানিয়ে সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য ট্রাস্টের সভাপতি ডা. শাহ জামান মোস্তফা বাহার বলেন, সিলেটে যারা বেড়াতে আসেন তারা কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, এখানে ঘুরে দেখার মতো কি কি আছে এসব ব্যাপারে একজায়গা থেকে তথ্য পাওয়ঢার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে পর্যটকদের বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞেস করে ঘরে বেড়াতে হয়। এতে তারা অনেক সময় বিপত্তিতে পরেন। সরকারি তরফ থেকে পর্যটকদের তথ্য প্রদানের একটি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

দক্ষ জনশক্তির অভাবও সিলেটের পর্যটন বিকাশের অন্যতম বাধা বলে মনে করেন সিলেট ক্যটারার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবলু। তিনি বলেন, এখানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হসপিটালিটি, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর অপারেটর বা ট্যুর গাইড হিসেবে দক্ষ মানুষজন পাওয়া যায় না। এসবখাতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত