স্বকৃত নোমান

০৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ২১:৫৬

ভাস্কর্য ‘হারাম’ হলে রোবট সোফিয়া কি ‘হালাল’?

সকালে ঘুম থেকে উঠে দৈনিক প্রথম আলোতে যখন যন্ত্রমানবী সোফিয়ার সাক্ষাৎকারটি পড়ছিলাম এবং বিকেলে ফেসবুকে ভাসন্ত একটি ভিডিও ক্লিপে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সোফিয়ার কথোপকথন দেখছিলাম, তখন বারবারই মনে পড়ছিল হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত গ্রীকদেবী থেমিসের ভাস্কর্যটির কথা। কিছুদিন আগে কী কাণ্ডই না ঘটে গেল ঐ ভাস্কর্যটি নিয়ে!

পাথর-সিমেন্টে নির্মিত থেমিসের ভাস্কর্যটির সঙ্গে লৌহনির্মিত সোফিয়ার কি খুব ফারাক আছে? না, নেই। ভাস্কর্যটি কথা বলতে পারে না, সোফিয়া পারে- ফারাক শুধু এটুকুই। দুটোই মানবসৃষ্ট। দুটোই মানুষের মেধার পরিচায়ক।

মানবসৃষ্ট ভাস্কর্যটিকে মেনে নিতে পারেনি জ্ঞানকাণ্ড থেকে দূরে পড়ে থাকা হেফাজতে ইসলামসহ বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর অনুসারীরা। কিন্তু মানবসৃষ্ট সোফিয়াকে মেনে না নিয়ে কি উপায় আছে? মনে হয় না। কারণ ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির দেশ, গোঁড়া রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরব সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। মানবসৃষ্ট একটি রোবটকে নাগরিকত্ব প্রদানের ঘটনাটিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দেখছি।

কেন এটি ঐতিহাসিক ঘটনা? আগেই বলেছি, সৌদি আরবে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি। এই ধর্মের বিধান অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর ছবি তোলা বা আঁকা হারাম বা নিষিদ্ধ। মুসলমানরা এই বিধানকে মান্য করে চলত। কিন্তু কালের ব্যবধানে সেই বিধানে তারা স্থির থাকতে পারেনি। সেই বিধান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। কালের দাবির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

বর্তমানে এমন কোনো মুসলমান আছে কিনা সন্দেহ, যে কোনোদিন স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলেনি। অর্থাৎ তারা ধর্মীয় বিধানের সংস্কার করেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এখন মানুষ শুধু মানুষের ছবিই তুলছে না, দেখতে অবিকল মানুষের মতো যন্ত্রও তৈরি করছে। সেই যন্ত্র কথা বলছে। সেই যন্ত্র মানুষের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। ইসলামি বিধান মোতাবেক কিন্তু এই ধরনের যন্ত্র তৈরি বিলকুল হারাম। ভাস্কর্য হারাম হলে সোফিয়ার মতো রোবট কি হালাল? মোটেই না।

তার মানে সৌদি আরব কর্তৃক সোফিয়ার নাগরিকত্ব প্রদানের ঘটনায় রক্ষণশীল মুসলমানরা বিরাট একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেল। তারা এখন কীভাবে ইসলামের এই বিধানকে মানুষের প্রতিমূর্তি তৈরি হারাম প্রতিষ্ঠা করবে? তারা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে ভাস্কর্য তৈরি ও স্থাপন হারাম? পারবে না। তাদেরকে মেনে নিতে হবে প্রযুক্তির এই উৎকর্ষকে। মেনে নিতে হবে মানুষের এই অভূতপূর্ব ক্ষমতাকে। ভবিষ্যতে হয়ত আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে। বিশ্বের বহু দেশে তো এখনই সেক্সডল পাওয়া যাচ্ছে। হয়ত একদিন রোবটকেই শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করবে পুরুষেরা, রোবটকেই শয্যাসঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করবে নারীরা। প্রযুক্তি যেভাবে উৎকর্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেদিন হয়ত আর বেশি দূরে নয়।

তখন রক্ষণশীল মুসলমানদের কী উপায় হবে? হয় তারা মানুষের এই বিপুল ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে, নয় রক্ষণশীলতাকে ধারণ করে পৃথিবীতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। মনে হয় না তারা রক্ষণশীলতার মধ্যে পড়ে থাকবে। মনে হয়, তখন তারা নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে যন্ত্রমানবের পক্ষে একটা ফতোয়া দিয়ে মানুষের এই বিপুল ক্ষমতাকে স্বীকার করে নেবে। তাতে যে ধর্মকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মান্য করত, বিশ্বাস করত, তাদের হাতেই সাধিত হবে সেই ধর্মের পরিবর্তন, সেই ধর্মের সংস্কার।

জানি, এসব যন্ত্রমানব মানুষের শ্রমকে হয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে, মানুষের শ্রমকে হয়ত মূল্যহীন করে দিচ্ছে। তবু মানুষের এই যে বিপুল ক্ষমতা,  মানুষ তার মতো অবিকল মানুষ তৈরি করছে, তার মুখ দিয়ে মানুষের মতো কথা বলাচ্ছে- সাময়িকভাবে এই ক্ষমতার উদযাপন তো করাই যায়। সোফিয়ার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে একবার তো বলাই যায়, মানুষ তুমি মহান। তুমিই সকল জ্ঞানের আধার। তুমিই পারো এই পৃথিবীতে শাস্ত্রপ্রোক্ত স্বর্গ নামিয়ে আনতে, আবার তুমিই পারো নরক নামিয়ে আনতে।

  • স্বকৃত নোমান: কথাসাহিত্যিক।

[ফেসবুক থেকে]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত