মুজিবুর রহমান মুজিব

১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ১৭:৩৫

এম. সাইফুর রহমানের কর্ম ও জীবনদর্শন

সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম মহা পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক রুহ এর জগত-আলমে আরওয়া-থেকে হাশরের ময়দান পর্যন্ত মানবাত্মার ক্রম বিকাশের ধারার মধ্যে মায়াময় মাটির পৃথিবীর সময়টুকু ক্ষণস্থায়ী ও অনির্ধারিত। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে মৃত্যুর জন্যই জন্ম গ্রহণ করতে হয়। মানব জীবনে মৃত্যু অবধারিত-চিরন্তন ও শাশ্বত সত্য। বিধির এই বিধান অলঙ্ঘনীয়। আমাদের মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক দোজাহানের খালিক-মালিক সর্ব শক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাব আল কোরআনে ঘোষণা করেছেন-“কুল্লুন নাফসিন জ্যায়িকাতুল মউত”জগতের সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। আত্ম সমর্পণ করতে হবে। মানুষ মরণ শীল হলে ও একজন কর্ম বীর-একজন কাজের মানুষ বেঁচে থাকেন তাঁর কাজের মাঝে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই বলে- আকুতি প্রকাশ করলেও তিনি পরবর্তী পর্যায়ে বলেছেন- মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান। কবিও দার্শনিক বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন তা শারীরিক ছিল না, ছিল কাব্যি। একজন সৃজনশীল কাজের মানুষ তাঁর কর্ম ও জীবন দর্শনের কারণে অনেক দিন বেঁচে থাকেন। মানুষের মৃত্যু হলেও মানুষের সৃজনশীল গণমুখী কর্মকাণ্ডের ক্ষয় নেই মৃত্যু নেই। কথার মানুষ কাজের মানুষ কর্মবীর এম. সাইফুর রহমান বেঁচে আছেন তাঁর কাজের মাঝে। শুধুমাত্র আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ভাষা সৈনিক এম. সাইফুর রহমান একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব একটি বলিষ্ঠ নাম, একটি আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিভা। ফটকাবাজি কিংবা লাগামহীন বক্তব্য নয়, তাঁর মেধা ও মনন, প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য অপূর্ব কর্ম দক্ষতা ও কর্ম ক্ষমতা, কঠোর পরিশ্রম অধ্যয়ন ও অনুশীলন এবং সর্বোপরি অফুরান দেশ প্রেম ও সততা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনকে বিকশিত করেছেন। আলোকিত করেছেন।

ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাগে ১৯৩০ সালের পাঁচই অক্টোবর তৎকালীন দক্ষিণ শ্রীহট্টের সদর থানাধীন ঐতিহ্যবাহী বাহারমর্দ্দন গ্রামে একটি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এম. সাইফুর রহমান এর জন্ম। তার শিক্ষানুরাগী পিতা আব্দুল বাছির একজন পেশাদার শিক্ষক ছিলেন তাঁর শিক্ষানুরাগী মাতা তালেবুন্নেছার অনুপ্রেরণায় ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সমাজের দুর্যোগ ও দুর্দিনের মাঝে ও বাল্য কৈশোর কালেই মেধাবী ছাত্র সাইফুরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার মানসে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু দুঃখ ও দুর্ভাগ্য জনক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা কালেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এম. সাইফুর এর শিক্ষাবিদ পিতা আব্দুল বাছির ইন্তেকাল করলে তিন পুত্র সন্তানকে নিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখেন সাইফুর জননী বেগম তালেবুন্নেছা। বালক সাইফুর পরিবারের এমন কঠিন সময় ও ক্রান্তি কালে শিক্ষানুরাগী চাচা মোঃ সফি আন্তরিক ভাবে এগিয়ে এসে নিজ সন্তানের মতই তিন এতিম ভ্রাতুষ্পুত্রের শিক্ষা দীক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নিজ গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা, নিকট প্রতিবেশী গ্রাম জগৎসীতে জগৎসী জি.কে.হাই স্কুল, যা বর্তমানে জি.কে.এম. সাইফুর রহমান স্কুল এন্ড কলেজ নাম ধারণ করেছে অধ্যয়ন শেষে ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে স্কুল ফাইনাল পাশ করেন- যা তখন এন্টার্স নামে অভিহিত হত। লেখাপড়ার প্রতি অধিক উৎসাহী থাকায় চাচা মোঃ সফি ভাতিজা সাইফুরকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সিলেট মদন মোহন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। বলা বাহুল্য তখন দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমায় কোন কলেজ ছিল না। ১৯৫১ সালে ভালো ফল নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলে সাইফুর রহমানকে তাঁর চাচা মোঃ সফি তাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যুবক এম. সাইফুর রহমান নূতন জীবনের সন্ধান পান। সরাসরি কোন ছাত্র সংঘটনের নেতা-কর্মী না হলে ও এম. সাইফুর রহমান ছিলেন রাজনীতি সচেতন-গণমুখী-দেশ প্রেমিক। মিটিং-মিছিলের চাইতে তিনি লেখাপড়ায় অত্যধিক উৎসাহী হলেও ছাত্র রাজনীতির খুঁজ খবর নিতেন রাখতেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কৃতি ছাত্রদের মধ্যে শাহ.এ.এম.এস.কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মোহিত প্রমুখ তার সম-সাময়িক ছিলেন। সিলেটের এই দুই কৃতি পুরুষ সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে উচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন। দুজনেই দীর্ঘদিন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

এস.এ.এম.এস কিবরিয়া মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছেন। এ.এম.এ.মোহিত অবসর জীবন যাপন করছেন। এম. সাইফুর রহমানের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের চরম সৌভাগ্য ও পরম পাওয়া বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ ও কারা বরণ। শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের জনক ও শাসক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন- “Urdu and Urdu Shall be the state language of Pakistan” জিন্নার ঘোষণা-মানি না, মানব না- বলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ প্রতিবাদী হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেন। নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তখন ও রাজনৈতিক দল সমূহ বিকশিত হতে পারে নি-ফলত: আন্দোলনে সংগ্রামে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সেই সময় ছাত্র সমাজের দুটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন এর সংগ্রামী ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন-বাঙালি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের চেতনার উন্মেষ ঘটায়। বায়ান্নে বাঙালির ভাষার সঙ্গে জাতীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য-স্বায়ত্ত শাসন ও স্বাধিকার এর প্রশ্নটিও নিহিত ছিল। বায়ান্নের রক্তের সিঁড়ি অতিক্রম করে জাতি ধাপে ধাপে স্বায়ত্ত শাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথে এগিয়েছে। এই আন্দোলনের একক নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন, বাঙালি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের আপোষহীন নেতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে বৃহত্তর সিলেটের কৃতি পুরুষদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসের অংশ। দক্ষিণ শ্রীহট্ট অঞ্চলের ভাষা সৈনিকদের মধ্যে এম. সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ ইলিয়াস, (স্বাধীনতার সংঘটক, সাবেক সাংসদ, মরহুম), সৈয়দ আকমল হোসেন, আব্দুল মূঈদ চৌধুরী এবং সদ্য প্রয়াত বেগম রওশন আরা বাচ্চুর নাম উল্লেখযোগ্য। এম. সাইফুর রহমান ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করত: গ্রেপ্তার হয়ে কারা যাতনা ভোগ করেন। তিনি নতি স্বীকার কিংবা মুচলেকা প্রদান করত: মুক্তি চান নি কারা যাতনা শেষে আইনি লড়াইর মাধ্যমে তিনি মুক্তি লাভ করেছিলেন এ ব্যাপারে তাঁর বৃদ্ধ ও অসুস্থ চাচা মোহাম্মদ সফি’কে অনেক দৌড় ঝাপ দিতে বেগ পেতে হয়েছে। তাঁর আত্ম জীবনী হাক্কানি পাবলিশার্স প্রকাশিত কিছু কথা, কিছু স্মৃতি-গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিষদ বর্ণনা আছে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর এম. সাইফুর রহমান ব্যারিস্টারি অধ্যয়নের জন্য বিলেত গমন করেন। ৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে সি.এ.ডিগ্রি অর্জন করেন। তখন দেশে চার্টার্ড একাউন্টদের সংখ্যা হাতে গুনা কয়েকজন মাত্র। মেধাবী ছাত্র এম. সাইফুর রহমান সফল শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে উচ্চ বেতন ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সহ চাকরিতে যোগ দিয়ে বর্ণাঢ্য কর্ম জীবনের শুভ সূচনা করেন। পাকিস্তানের করাচীতে নূতন কর্মস্থলে যোগ দেন কর্মবীর এম. সাইফুর রহমান। ১৯৬০ সালের ১২ই জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বন্দর নগরী চট্টগ্রামের এক অভিজাত খান্দানি পরিবারের কৃতি কন্যা বেগম দুররে সামাদ রহমানের সাথে। এই দম্পতির সুখময় দাম্পত্য জীবনের ফসল-মহান আল্লাহর দান , চার সন্তান। তিন পুত্র এক কন্যার জনক-জননী ছিলেন সাইফুর দুররে সামাদ দম্পতি। সন্তানগণ উচ্চ শিক্ষিত। কর্ম জীবনে সু-প্রতিষ্ঠিত। প্রথম পুত্র এম.নাসের রহমান পিতার সাথে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে সাংসদ এবং জেলা বি.এন.পি-র সভাপতি হন। এখন ও সেই দায়িত্ব পালন করছেন।

ব্রিটিশ অক্সিজেনের উচ্চ বেতনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসাবে পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে অবস্থান ও উচ্চ মহলের সঙ্গে চলাফেরা উঠা বসা করে এম. সাইফুর রহমান পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বাঙালিদের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণে মন কষ্ট পান। মনঃক্ষুণ্ণ হন। বিলাসী জীবন পেছনে ফেলে বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানির উচ্চ বেতনের চাকরি ইস্তফা দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৬২ সালে তার দুইজন সহকর্মীকে নিয়ে গঠন করেন রহমান রহমান হক এন্ড কোম্পানি-আর.আর.এইচ।

পেশার প্রতি আনুগত্য ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রহমান রহমান হক এন্ড কোম্পানি সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে সর্ববৃহৎ একাউন্টেন্সী অডিট ফার্ম হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারামলে দশ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় বেতন কমিশন গঠিত হলে একজন সিএ হিসাবে বঙ্গবন্ধু তাকে মনোনীত করেন। সেই বেতন কমিশনে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি ছিলেন সেনাবাহিনীর উপ প্রধান মে. জেনারেল জিয়াউর রহমান। কমিশনে এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এম. সাইফুর রহমান ও জেনারেল জিয়াউর রহমান এর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকৃত খুনি খন্দকার মুশতাক আহমদ এর আস্কারা, আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে কতেক বিপথ গামী সেনা সদস্য বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করলে দেশে এক প্রকট রাজনৈতিক সংকট ও শূন্যতা দেখা দেয়। পঁচাত্তর উত্তর দেশীয় রাজনীতির সংকট ও শূন্যতার মাঝে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম এবং সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে এম. সাইফুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের অনুরোধ ও অণু প্রেরণায় ১৯৭৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ.এস.এম. সায়েম এর মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে যোগদান করেন। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল-প্রতিষ্ঠায় ও নবীন রাজনীতিবিদ এম. সাইফুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে তার রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন শুরু হলেও অর্থনীতিবিদ এম. সাইফুর রহমান প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রণালয় এর গুরু দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাত বরণের পর তিনি জাস্টিস আব্দুস ছাত্তার এর মন্ত্রিসভায় ও অর্থমন্ত্রী হিসাবে বহাল থাকেন। বি.এন.পি-র সকল সরকারামলে তিনি মন্ত্রিসভায় ছিলেন। তিনি দলের নীতি নির্ধারনী ফোরাম দলের স্থায়ী কমিটির চীর স্থায়ী সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ কায়েম করে সেনা প্রধান লে. জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ আর্মির কোড অব কনডাক্ট ভঙ্গ করে ক্ষমতা দখল করত: দেশ ব্যাপী সামরিক আইনজারি করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিশ্বস্ত সহচর এম. সাইফুর রহমানকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে চাপ প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব দিলে তিনি তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করত: কারা যাতনা ভোগ করেন। মিথ্যা মামলায় বেকসুর খালাস পান।

১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বি.এন.পি সরকার গঠিত হলে অর্থমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব ভার প্রাপ্ত হন তিনি। ন’বছরের সামরিক স্বৈরাচার বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে তিনি পুনর্ঘটন করেন। Value added Tax (VAT)- প্রথা চালু করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেন। শুরুতে ভ্যাট সিস্টেম সমালোচিত হলেও বর্তমানে সরকারের আয়ের বিপুল অংক যোগান দেয় এই ভ্যাট। এই আমলে এম. সাইফুর রহমান বিশ্বব্যাংক ও আই.এম.এফ. এর বোর্ড অব গভর্নর্স এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ ও ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করেন। মৌলভীবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ মহসীন আলীর (পরে সাংসদ। মন্ত্রী।মরহুম) উদ্যোগে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনা এবং জেলা যুবদলের উদ্যোগে চৌমুহনা চত্বরে গন সংবর্ধনা দেয়া হয়। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকার গঠিত হলে এম. সাইফুর রহমান অর্থের সঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব ভার ও প্রাপ্ত হন। জোট সরকারামলে তার বলিষ্ঠ উদ্যোগ ও নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিশেষত সমগ্র সিলেট বিভাগ ব্যাপী ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়। দেশীয় শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি বিদ্যালয় সমূহে ফুড কর এডুকেশন-শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী চালু করেন তিনি বলতেন Education is the foundation of Development উন্নয়নের ভিত্তিই হল শিক্ষা-সেই লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী চালু করে ছিলেন। বায়ান্নের ভাষা সৈনিক এম. সাইফুর রহমানকে জাতি এই সময় একুশের পদকে ভূষিত করেন। জেলায় একুশে পদক প্রাপ্তদের মধ্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. কাজি খলিকুজ্জামান আহমদ নিসর্গ বিদ দ্বিজেন শর্ম্মার নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এবার একুশের পদকে ভূষিত হচ্ছেন সাবেক সাংসদ বীর মুক্তি যোদ্ধা আব্দুল জব্বার। অর্থনীতিবিদ হিসাবে এম. সাইফুর রহমান ছিলেন সফল অর্থমন্ত্রী। তাঁর সময়ে শেয়ারবাজার চাঙ্গা ছিল, মুদ্রাবাজার ছিল স্থিতিশীল, মুদ্রাস্ফীতি ছিল না, সর্বোপরি ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ছিল, হলমার্ক, ইউনিপে-টু-বিসমিল্লা গ্রুপ এর লুণ্ঠন-লুট তরাজ ছিল না। তাঁর মন্ত্রণালয়ের পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত তটস্থ থাকতেন-তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল নিরঙ্কুশ, কোন প্রভাবশালীদের কাছে তিনি মস্তক অবনত করেন নি, জাতিকে হেয় হতে দেন নি। এই প্রসঙ্গে দেশের দুইজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এর উক্তি ও মতামত সমূহ একান্তই প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধান যোগ্য। সাবেক সচিব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক আবু আহমদ একজন মেধাবী অর্থমন্ত্রীর কথা নিবন্ধে বলেন-“উনার মন্ত্রিত্ব কালে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। শুধু রাজনীতির খাতিরে উনি কোন নূতন ব্যাংকের অনুমোদন দেন নি। আমি পাঁচ বছর বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এর চেয়ারম্যান ছিলাম। দীর্ঘ পাঁচ বছরে সাইফুর রহমান একদিনও আমাকে বলেন নি যে, ঐ কেইসটা দেখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.সালেহ উদ্দিন আহমদ সাইফুর রহমান একজন কিংবদন্তী পুরুষ শিরোনামের নিবন্ধে যথার্থই বলেন- ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা সুশাসন এবং দক্ষতা সেসময় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল জনাব সাইফুর রহমানের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছার জন্যই”।

পরিণত বয়সে জননেতা এম. সাইফুর রহমান ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন বার্ধক্য জনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন। ২০০৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে এই মহান ব্যক্তি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। ঢাকা, সিলেট, মৌলভীবাজারে বিশাল বিশাল নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে তার গ্রামের বাড়ি বাহার মর্দ্দানে পারিবারিক কবরস্থানে তার প্রিয় জীবন সঙ্গীনী বেগম দুররে সামাদ রহমানের কবরের পাশে দাফন করা হয়। এত দিনে তার কবরের মাটি পুরাতন হয়ে গজিয়েছে ঘাস, ফুটেছে অনেক নাম না জানা ঘাসফুল। ঘাস, ঘাসফুল তাঁর কবরস্থানকে পরম মমতায় জড়িয়ে আছে। তাঁর কবরের মাটি পুরাতন হয়ে গেলেও তিনি স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যান নি-আছেন আমাদের অন্তরে। অনুভবে।

মুজিবুর রহমান মুজিব: মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত