ভারতীয় শিল্পকলার রাজকন্যা অমৃতা শেরগিল

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-২৮ ১৯:০১:৪১

 আপডেট: ২০১৫-১১-২৮ ১৯:৩৩:৩৫

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি:

পৃথিবীতে যে তিনজন নারী চিত্রশিল্পীকে ফিমেল আইকন হিসেবে গন্য করা হয় তারা হলেন আমেরিকার জর্জিয়া ও ক্যাফে(Georgia O’Keeffe), মেক্সিকোর ফ্রিডা কাহলো (Frida Kahlo) আর তৃতীয়জন হলেন আমাদের অমৃতা শেরগিল (Amrita Sher-gil)।

ভারতীয় তথা প্রাচ্যের চিত্রকলাকে আলোড়িত ও আলোকিত করে তোলা এই শক্তিমান নারীশিল্পীকে নিয়ে যেমন রহস্যময়তা আছে তেমনি আছে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙ ও তুলির নিজস্ব ছাঁচে ভেঙে ফেলা প্রচলিত নিয়ম কানুন- সে ব্যক্তিগত বা শিল্পী উভয় জীবনেই। চলুন পাঠক, পরিচিত হই উপমহাদেশীয় চিত্রকলার প্রবাদকন্যা অমৃতা শেরগিলের সঙ্গে!

বলা হয় বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়্যার ‘Nude Maja’ ন্যুড চিত্রকলার ইতিহাসের এক বিপ্লব। প্রথমবারের মতন পেইন্টিঙয়ে গোপনীয়তা বিবর্জিত একজন নারীর পুর্ণাঙ্গ শরীর যাবতীয় মহিমা নিয়ে এসেছিল সেখানে। যেখানে ব্যক্তিগত জীবনে যৌনতাকে শক্তি এবং শিল্পের সমন্বয় হিসেবে দেখতেন অমৃতা, সেখানে তাঁর ন্যুড সিরিজ কতটা বৈচিত্র্যময় হবে তা ভাবনার অবকাশ রাখেনা।

পাঠক, যারা এই লেখার শুরুতেই অস্বস্তি বোধ করছেন তাদের আগে জানা দরকার, ন্যুড চিত্রকলা কি? সত্য কথা হল ইংরেজিতে ‘Nude’ এবং ‘Naked’একে অপরের প্রতিশব্দ হলেও শিল্পভাবনা আর চিত্রকলায় এটা সম্পূর্ণ আলাদা। ‘ন্যুড’ এবং ‘নেকড’ উভয়ের অর্থ ‘উলঙ্গ’ বা ‘নিসুতো’ হলেও চিত্রকলায় ‘ন্যুড’ হল এমন এক নগ্ন দেহ যার মাঝে কোন যৌন উত্তেজনা বা সেক্স অ্যাপিল থাকেনা। অন্যদিকে ‘নেকড’ হল এমন একধরণের নগ্নতা যা যৌন উদ্দীপক।

প্রাচীনকাল থেকে রেনেসাঁ বা চিত্রকলায় দেবদেবী বা মহান নারীপুরুষের যত নিসুতো ছবি আঁকা হয়েছে সবই ন্যুড চিত্রকলার অংশ। আর এই ন্যুড চিত্রকলায় নিজেকে স্বমহিমায় ও আপন রূপে যিনি সারা পৃথিবীকে পরিচিত করিয়েছেন উপমহাদেশীয় চিত্রকলায়, তিনি আর কেউ নন- অমৃতা শেরগিল।

ভারতসহ হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নরওয়ে, জার্মানি প্রভৃতি দেশের সেরা আর্ট গ্যালারিগুলোতে আছে অমৃতার অসংখ্য মাস্টারপিস। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি কাজ আছে দিল্লীর ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট আর ইংল্যান্ডের টেট মিউজিয়ামের গ্যালারিতে।

 

অমৃতা শেরগিলের জন্ম ১৯১৩ সালের ৩০ শে জানুয়ারি হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। এই বছরই এশীয়দের মাঝে প্রথম নোবেল পুরষ্কার পান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অমৃতার মা ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী আর বাবা ছিলেন ভারতীয় শিখ। মা মেরি আর বাবা উমরাও সিংয়ের দুইসন্তান অমৃতারা ছিলেন দুই বোন- অমৃতা আর ইন্দিরা, লেখাপড়া করেছেন বিদেশে। জন্মের পর থেকে বেড়ে উঠেছেন ভারতের বাইরে, কিন্তু অমৃতার আঁকা ছবি প্রমাণ করে যে নিজেকে তিনি কতটা ভারতীয় ভাবতেন।

১৯২১ সালে শেরগিল পরিবার চলে আসে ভারতের শিমলায়। অমৃতা সেখানের সামার হিলে বেহালা আর পিয়ানো দুটিই শেখেন সমানতালে, এমনকি শিমলার গেটি থিয়েটারে কনসার্ট শিল্পী হিসেবেও নিয়োগ পান। আর সেইসঙ্গে চলে ছবি আঁকার শিক্ষা। আট বছর বয়সেই তিনি আর্ট কম্পিটিশানে অংশ নেয়া শুরু করেন, ১৯২৪ সালে মায়ের সাথে চলে আসেন ইতালির ফ্লোরেন্সে। তাই শিল্পী হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার হয় মাত্র নয় বছর বয়সেই।

ইতালির রেনেসার শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন মাত্র এগার বছর বয়সে আর ১৬ বছরেই ভর্তি হন ফ্রান্সের প্যারিসের বিখ্যাত Ecole Des Beaux Art এ। এখানেই মাত্র বিশ বছর বয়সে অমৃতা তাঁর ‘Young Girls’ ছবির জন্য অ্যাকাডেমি পদক এবং ফ্রান্সের গ্র্যান্ড সেলনের সদস্য নির্বাচিত হন, এতো কম বয়সে গ্র্যান্ড সেলনের সদস্য হওয়া এখনো একটি অনন্য রেকর্ড এবং এই কৃতিত্বে এশীয়দের মাঝেও তিনি প্রথম ও একমাত্র। যদিও ১৯৩৪ সালে আবার তিনি একদম স্থায়ী হয়ে ফিরে আসেন শিমলায়।

দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি টান আর ব্যক্তিগত জীবনে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণা নানা বর্ণে ধরা দিয়েছে তাঁর ছবিতে। বোহেমিয়ান স্বভাবের অমৃতা ১৯৩৬ সালের দিকে ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আর পাহাড়ি এলাকাগুলি ঘুরে দেখেছেন।

একেবারে ভারতীয় পটভূমির এসময়ের ছবিগুলির মধ্যে Brahmacharis, Village scene, Three Girls, South Indian Villagers, Tribal Women, Child Bride, Resting, Bride’s Toilet বোদ্ধাদের মতে অমৃতার জীবনের সেরা মাস্টারপিস।

এরমাঝে ব্রহ্মচারী’র কথা আলাদা করে না বললেই নয়। অমৃতা শেরগিল, যার আঁকা সেরা কাজগুলি ন্যুড আর সেক্সের আভায় আভায় ব্যঞ্জনাময় তিনিই পাঁচজন কিশোর সংসারত্যাগী ব্রাহ্মণকে ব্রহ্মচারীরূপে ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন দেখে অবাক হতে হয়! আরও আছে তাঁর আঁকা Spanish Girl, Gipsy Girl, Namaskar, Hungarian Peasant, Hungarian Village church। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ চিত্রশিল্পী হলেও অমৃতার শিল্পীজীবন কেটেছে অগুরুত্বপূর্ণ এক অখ্যাত শিল্পী হিসেবে। তাঁর ভাগ্য খানিকটা ডাচ মাস্টার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ আর ফ্লেমিং জুনের শিল্পী স্যার ফ্রেড্রিক লেইটনের মতন। বেঁচে থাকতে ভ্যান গঘ যেমন দুইয়ের অধিক চিত্রকর্ম বিক্রি করতে পারেননি তেমনি অমৃতাও শিল্পী হিসেবে খুব কমই সমাদৃত হয়েছেন জীবদ্দশায়।

নগ্ন হওয়ার ব্যাপারে কোনো রাখঢাক ছিলোনা অমৃতার। সেক্সকে তিনি দেখেছেন জীবনের প্রধানতম উপাদান হিসেবে। সাংবাদিক খুশবন্ত সিং তাঁর সম্পর্কে নিজের আত্মজীবনীতে বলেছেন- Love formed very little part of Amrita’s life, Sex was what mattered to her. তাঁর বাইসেক্সুয়াল কর্মকাণ্ড এবং লিভ টুগেদারের লিস্ট ব্যাপক।

এ বিষয়ে তাঁর সরল স্বীকারোক্তি ছিল- Naked came I out of my mother’s womb and naked shall I return there; তাই, অমৃতা’র অসামান্য প্রতিভায় তাঁর আঁকা ন্যুড সিরিজ আর আত্মপ্রতিকৃতি চিত্রকলায় এক অনন্য জায়গা দখল করে থাকবে সেইই তো স্বাভাবিক!

তাঁর আঁকা Reciling Nude, Nude Group, Two girls, Sleep, Professional Model এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ন্যুড পেইন্টিংটির নাম হল ‘Sleep’, শ্বেতশুভ্র বিছানায় একজন নগ্ন যুবতী নারীর ঘুমের দৃশ্য। পৃথিবীতে অসংখ্য ন্যুড ছবি আছে, কিন্তু তারমাঝেও অনন্য একটি হল এটি।শিল্পমান বিচারে যেটি আরেক ফ্রেঞ্চ মাস্টার Amedeo Modigliani’র Red Nude এর সমতুল্য। জর্জিনো, এদুয়ার মনে, তিসিয়ান, বত্তিচেল্লি, রেমব্রান্ট থেকে শুরু করে পৃথিবীবিখ্যাত সবার আঁকা ন্যুড চিত্রের মধ্যেও এটি যেন আলাদা। জর্জিনো তাঁর স্লিপিং ভেনাসে, এদুয়ার মনের তাঁর অলিম্পিয়া’তে, বত্তিচেল্লি তাঁর বার্থ অফ ভেনাস, তিসিয়ান তাঁর রাইজিং ভেনাস, রেমব্রান্ট তাঁর বাথসেবায় চাতুর্যের সাথে লুকিয়ে রেখেছেন নারীর গোপনাঙ্গ। কিন্তু অমৃতা তাঁর স্লিপে নারীকে এঁকেছেন একদম নিজস্ব স্টাইলে, রাখঢাকহীন অকৃত্রিমভাবে- যেখানে নগ্নতার মাঝে ঘুমের সৌন্দর্য কতটা মোহনীয় ও সুখকর হতে পারে তা অনুভব করা যায়।

 

তাঁর আঁকা শায়িতাতে উজ্জ্বল লাল আর হলুদ আভা ফুটে উঠেছে শরীর থেকে প্রগাঢ়ভাবে। সম্ভবত অমৃতার প্রিয় রঙ ছিল লাল। আর তাই অমৃতা এই লালের প্রতি ভালোবাসার কথাও স্বীকার করেছিলেন এভাবে- Red is not only the auspicious color of marriage, it signifies sexuality.

অমৃতার মতন স্লিপ নামের একই শিরোনামে পৃথিবী বিখ্যাত আরেক শিল্পী গুস্তাভ কুরবেরও একটি মাস্টারপিস আছে, অমৃতার মতন এধরণের ছবি আঁকতে পারঙ্গম ছিলেন এই শিল্পী। গুস্তাভ কুরবের স্লিপে চরিত্র ছিল দুটি আর অমৃতার স্লিপে একটি। Nudity’র দিক থেকে অমৃতার ‘Sleep’কে বলা হয় একপ্লিসিট বা বিশদভাবে তুলে ধরা নগ্নতা।

অমৃতা শেরগিল সম্পর্কে সবচেয়ে পারফেক্ট মন্তব্য হল- She is reflected in men’s desire but she is in command.নারীমনের কামনা বাসনা শক্তিমানরূপে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর আঁকায়। অন্যদিকে অমৃতা’র ‘Professional Model’যেন ‘Sleep’এর বিরোধী আরেকটি ছবি। সেখানের নগ্নিকার চেহারা হতাশ ও শ্রীহীন, কেমন বিবর্ণতার প্রতীক। এই ছবিতে একজন প্রফেশনাল মডেলের শ্রীহীন পড়ন্ত যৌবন বেদনার মধ্য দিয়ে ধরা দিয়েছে অমৃতার ব্রাশের স্ট্রোকে।

অমৃতা মনেপ্রাণে যে দুজন চিত্রশিল্পী হিসেবে ধারণ করতেন তাঁদের একজন হলেন পল সেজান আরেকজন পল গগ্যা। একারণেই সম্ভবত জীবনের সেরা এবং সাহসী ছবিটি এঁকেছিলেন তিনি ১৯৩৪ সালে। এটি ছিল নগ্ন হয়ে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি ‘Self portrait as Tahitian’, এখানে অমৃতা নিজেকে তুলে ধরেছেন তাহিতি দ্বীপের মেয়েদের মতন করে। তাহিতি’র প্রতি অমৃতা’র এই ভালোবাসার কারণ হল তাঁর প্রিয় চিত্রশিল্পী মাস্টার পল গগ্যা। ফ্রান্সে জন্ম হলেও নিজদেশে যথার্থ সম্মান না পেয়ে গগ্যা ১৮৯১ সালে চলে যান নির্জন তাহিতি দ্বীপে আর সেখানেই সৃষ্টি করেন তাঁর পৃথিবীবিখ্যাত তিন মাস্টারপিস ‘Tahitian Women’,‘Where do we come from’ এবং ‘By the sea’।

পল গগ্যার এই তাহিতিপ্রীতি সঞ্চারিত হয়েছিল অমৃতার মাঝেও, সেই ভালোবাসা থেকেই তিনি নিজেকে নিয়ে এঁকেছেন ‘সেলফ পোট্রেট অ্যাজ তাহিতিয়ান’।তবে গগ্যা যেমন তার মডেলদের ফুল দিয়ে যৌনউদ্দীপক হিসেবে সাজাতেন অমৃতা তা করেননি। বরং তাহিতির মেয়েদের প্রতীক হিসেবে নিজেকে নিসুতো আর নিখুঁত করে এঁকেছেন।

১৯৪১ সালে এঁকেছেন Camels ও Ancient storyteller ছবি দু’টি, এই ১৯৪১ সালেরই ৫ ডিসেম্বরই মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে অমৃতা মারা যান জরায়ুর রক্তপাতজনিত ইনফেকশানে। স্বামী ডাক্তার ভিক্টর ইগান অমৃতা’র গর্ভপাত ঘটাতে যান, যাতে ঘটে এই বিপত্তি। পরে অবনতি ঘটায় শহরের নামী ডাক্তার রঘুবীর সিংকে ডাকলেও রঘুবীরের হাতে কোনো উপায়ই ছিলোনা। তিনি শুধু অমৃতা’র চলে যাওয়াই প্রত্যক্ষ করেন।

আর্ট শিক্ষক বরিস টেজলস্কির সাথে লিভ টুগেদার, ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহেরুর সাথে গোপন সম্পর্ক, বান্ধবী মেরি লুইস চেনাসির সঙ্গে লেসবিয়ান সম্পর্ক, ব্রিটিশ যুবক ওয়াল্টার কলিন, আকবরপুরের নবাব ইউসুফ আলী খানবা বিখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক ম্যালকম মুগরিজসহ অনেকের সঙ্গে লিভ টুগেদারে নানাসময়ে তিনি একাধিকবার গর্ভবতী হয়ে পড়েন। স্বামী ভিক্টর ইগান একাধিকবার তাঁর গর্ভপাত ঘটান, এমনকি ইগানের সঙ্গে বিয়ের আগেও ইগানকে তা করতে হয়েছে একাধিকবার।

১৯৩৮ সালের ১৬ই জুলাই অমৃতার বিয়ে হয়েছিল জ্ঞাতিভাই ইগানের সাথে, বাবা উমরাও সিং এই বিয়ে মেনে নেননি শিখদের মাঝে জ্ঞাতিভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রচলন নেই বলে। কিন্তু অমৃতা হয়ত প্রথাবিরোধী বলে শুধু জেদের বশেই বিয়েটা করেন। এতে উমরাওসিং এতটাই রেগেছিলেন যে অমৃতাকে লেখা জওহরলাল নেহেরুর প্রেমপত্রগুলি তিনি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

অমৃতা ছিলেন পুরোপুরি প্রথাবিরোধী একজন শিল্পী। ব্যাক্তিগত জীবনে ও শিল্পীজীবনে কখনোই তিনি কোনো প্রথার ধার ধারেননি। তাঁর ন্যুড পেইন্টিঙের কানায় কানায় পূর্ণ আছে আছে যৌনতা আর জীবনের বর্ণছটা। কয়েক বছর আগে ব্রিটেনের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গার্ডিয়ান পত্রিকা তাঁকে নিয়ে লিখেছে ‘The line of beauty of Amrita’ নামের এক প্রবন্ধ।

অমৃতার ভাগ্নে ভিভেন সুন্দরমও বর্তমান ভারতের আরেক সেরা শিল্পী। কিন্তু অমৃতাকেই মূলত ভারতীয় চিত্রকলাকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করানোর কৃতিত্ব দেয়া হয়। ভারতের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর সময় অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র যেমন সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল এই মহান শিল্পীর মনে, তেমনি পাশ্চাত্যে বেড়ে উঠেও প্রাচ্যের প্রতি তিনি ছিলেন শতভাগ নিবেদিত। হয়ত একারণেই নিজেকে নিয়ে দম্ভোক্তিও করেছেন এভাবে- I can only paint in India. Europe belongs Picasso, Matisse, Braque but India belongs only to me.

এই মহান নারী শিল্পীর মৃত্যুকে শিল্পবোদ্ধারা অভিহিত করেছেন নানা উপমায়, তারমাঝে অন্যতম হল-The princess who died unknown। বোদ্ধাদের হিসেব মতে তিনি ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক শিল্পী। দিল্লীর একটি রাস্তার নাম রাখা হয়েছে অমৃতা শেরগিল মার্গ, একাধিক ডাকটিকিটে আছে তাঁর হিল উইমেনসহ নানা চিত্রকর্ম। বত্তিচেল্লি, জর্জিনো, গুস্তাভ কুরবের সাথে তাঁর আঁকা স্লিপ পৃথিবীর সেরা ন্যুড মাস্টারপিসগুলির অন্যতম। একজন শিল্পীর জীবন এরচেয়ে সার্থক হতে পারে কি?

তাঁর সম্পর্কে দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে- She provided a role model for women artists of future generation. তাঁকে যেসব উপনামে অভিহিত করা হয় তার অন্যতম হল- India’s Frida Kahlo।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্ভবত এমন উদ্দীপ্ত তরুণদের উদ্দেশ্যেই বলেছেন- রঙের খেলা খেলিতে খেলিতেই তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত! পৃথিবীকে চমকে দেয়া যত ক্ষণজন্মা গুণী মানুষ জন্ম নিয়েছেন নিঃসন্দেহে অমৃতা তাঁদের মাঝে অনন্য একজন। মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সের মাঝে এই শিল্পী পৃথিবীকে যা দিয়ে গেছেন তার জন্য তাবৎ পৃথিবী আর শিল্পমহল কৃতজ্ঞতাভরে তাঁকে স্মরণ করে যাবে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন তিনি প্রকাশ করে গেছেন স্বমহিমায়- আপন রঙে ও ঢঙে। তাই তাঁর সম্পর্কে রবি ঠাকুরের এই চরণগুলি বলাই যায়-

ভেদি মরুপথ গিরি পর্বত
যারা এসেছিল সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর-
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে
তার বিচিত্র সুর।

তথ্যসূত্র:
১. Amrita Sher-gil: Essays By VivanSurandam, Marg Publications; New Delhi
২. The Princess who died unknown, Kanwarjit Singh, The Sunday Tribune, 13th March 2010
৩. FIrst Lady of Modern Canvas, Indian Express, 17th October 1999
৪. আইনস্টাইনের বাড়ি ভ্যাগঘের হলুদ ভুবন, বরেন চক্রবর্তী, অন্যপ্রকাশ
৫. পৃথিবীর জলছবি নদী আখ্যান, শিকোয়া নাজনীন
৬. Great Minds, The Tribune, 12th March 2000
৭. India’s 50 most Illustrious women by Indira Gupta
৮. A Biography, Malcom Muggeridge, Page 136-137
৯. Art on indian postage stamps, indiapicks.com
১০. Works in Focus, Tate Modern, 2007
১১. The free spirit of Indian art, The Daily Telegraph, 24th February 2007
১২. Truth, love and a little Malice, An autobiography of Khushwant Singh
১৩. Women Painters at 21st century, indianart.com

আপনার মন্তব্য