প্রকাশিত: ২০২৩-১২-২৮ ১৭:০০:১০
আবুবকর সিদ্দিক
মাসকাওয়াথ আহসান:
কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক মারা গেছেন। তাঁকে আসলে অনেক আগেই মেরে ফেলা হয়েছে। আজ তা দৃষ্টিগোচর হলো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ছিলেন। আমার আম্মা তাঁর ছাত্রী ছিলেন। আম্মার মুখে তাঁর প্রাণবন্ত ক্লাসরুমের গল্প শুনতাম। পরে তাঁর কথাসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়।
তাঁর জলরাক্ষস ও খরাদাহ উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছিলো; আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পদ্মা নদীর মাঝি" নিয়ে পড়ে থাকায় আবুবকর সিদ্দিকের ধ্রুপদী উপন্যাস দুটো লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেলো। কিংবা আওয়ামী লীগের কোলে ঝাঁপ দিয়ে পড়া মিডিওকার লেখকদের নিয়ে সাহিত্যপাতা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যস্ত থাকায়; আমরা জানতেও পারলাম না আবুবকর সিদ্দিকের গদ্যের শক্তি।
আমাদের চলচ্চিত্রকারেরাও এক জীবনে নিজেরাই কাহিনীকার হতে চেষ্টা করেন। ফলে বাংলাদেশকালের কথাসাহিত্য নেড়ে চেড়ে দেখার অবসর তাদের হয়না। ক্লাসিক বলতে তারা তারাশংকর কিংবা বড় জোর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বোঝেন। হয়তো নিজের শক্তি কম হওয়ায় কো-ব্র্যান্ডিং-এর প্রয়োজনে মিডিয়ায় পরিচিত লোকের গল্প নিয়ে ছবি বানান বড়জোর। অথবা নিজের শক্তির ভ্রান্ত অধ্যাসে নিজেই দুর্বল কাহিনী ফাঁদেন ও দুর্বল চলচ্চিত্র বানান।
ভারতে স্বকালের হিন্দি-ইংরেজি সাহিত্য খুঁজে খুঁজে নাট্যরূপ দেয়া হয়, চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়; পাকিস্তানে উর্দু সাহিত্যের গল্প থেকে নাট্যরূপ দেয়া হয়; ফলে নিজেদের সাহিত্যিকদের শক্তির উদ্ভাসের সঙ্গে পরিচিত হয় নতুন প্রজন্ম।
আর আবুবকর সিদ্দিকের গল্পগ্রন্থ ভূমিহীন দেশ, মরে বাঁচার স্বাধীনতা, চরবিনাশকাল রয়ে যায় অনাঘ্রাতা কুমারীর মতো অপরিচয়ের বনবাসে।
একুশে বইমেলায় একবার এক লেখকের গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের অনুরোধ জানালে অধ্যাপক সিদ্দিক বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, আমাকে কে চেনে; যাও পরিচিত কোন লেখক জোগাড় করো! উনার দৃষ্টিতে যে বিবমিষা দেখেছিলাম, যে বিষণ্ণতা লক্ষ্য করেছিলাম; তা আমাকে বেদনাহত করেছিলো। পরে অবশ্য উনি কার্টিয়াস মানুষ বলে ঠিকই গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন।
ঐদিন আমার অভিমান হয়েছিলো আমাদের পশ্চাৎপদ শিল্প-সাহিত্য জগতটির ওপর। নেহাত বিটিভি হুমায়ূন আহমেদকে পুনরাবিষ্কার না করলে; আমরা তাঁকেও চিনতে পারতাম। অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলে অনেক গুণী লেখক রয়ে যেতেন অপরিচয়ের আড়ালে। এই যে আমাদের অনগ্রসর শিল্প-সাহিত্য জগত; যেখানে দৈবচয়নে চোখে না পড়লে; অথবা দলীয় সহমত সভায় নাম না লেখালে; কোন লেখকের টেক্সট কেউ পড়ে না! কারো সাহিত্যের অন্তর্গত শক্তি, গদ্যের সিগনেচার, বোধের আলোড়ন কেউ পরখ করে দেখে না। রবাহূত এক সাহিত্য জগত; বাংলা একাডেমি মা, প্রথম আলো মা, কালি ও কলম মা; পাশের বাড়ির আনন্দ বাজার মা না কাঁদলে সাহিত্যিককে দুধ দেয় না। কী আজগুবি এক শিল্পচয়ন পদ্ধতি। তাইতো মিডিওকারেরা উত্তরীয় পরে বাংলা সাহিত্যের অনিশ্চিত যাত্রার বরযাত্রী হয়। আর আবুবকর সিদ্দিককে মরে প্রমাণ করতে হয় যে উনি মরেননি।
আমাদের ঢাকা শহরটিই বাংলাদেশের একমাত্র অজো গ্রাম বলে, শক্তিশালী সাহিত্যিককে তার মেয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে বিয়ে করলে কানাকানি ও ফিসফাস করে; সাহিত্যিক আওয়ামী লীগ গোত্রচ্যুত করা হয়। আওয়ামী লীগের শিল্প পুরোহিতেরা সাহিত্য করবেন কখন; তাদের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়, কে কাকে বিয়ে করলো! কে আওয়ামী লীগের বাইরে প্রেম করলো! এইসব কালোতালিকা রচনায়। এই করে করে এরা শক্তিশালী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে টিএসসিতে ডেকে এনে অপমান করে; হার্ট অ্যাটাক করে মেরেছিলো। পরে আওয়ামী লীগ গৃহপালিত বিরোধীদল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে বিয়ে করলে মুখটা কুমড়োর মতো বসে থাকে শিল্পঘাতকেরা।
আর আছে আধাখেঁচড়া লোকজ মেট্রোপলিটন ঢাকার সেন্টার বনাম পেরিফেরি ম্যাগালোম্যানিয়া। যেহেতু আবুবকর সিদ্দিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; আর তিনি হাসান আজিজুল হকের মতো আওয়ামী লীগের স্বপক্ষের শক্তির বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেননি; তাই ঢাকা তাঁকে ফেলে দিয়েছে পেরিফেরি কোটায়। তাইতো বিশ্বমানচিত্রের পেরিফেরি মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের এইসব ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের সুপিরিয়র বহিঃপ্রকাশে শিল্প ও শিল্পীর এথনিক ক্লিনসিং চলেছে ধারাবাহিকভাবে।
আমাদের দোজখের কড়াইয়ে পাহারাদার দরকার নাই বলে, নিজেদের সেরা লেখকগুলো খুঁজে খুঁজে সুচিহ্নিত করায়; ভারত-শ্রীলংকা-পাকিস্তানের লেখকেরা সমকালের বিশ্বসাহিত্য সভায় তাদের কিছু কাজ প্রদর্শন করেছে। আর বাংলাদেশে কোটারিভুক্ত আওয়ামী সাহিত্য ও ডেইলি স্টারের হেই ডুড ফেস্টিভ্যালের নেপোটিজম করে করে বিশ্বসভায় এমন সব ডোয়ার্ফ লিটারেচার নিয়ে গিয়ে হাজির করেছে যে; হিটে আউট হয়ে আবার ঢাকায় ফিরে এসেছে বাংলা একাডেমি মা, প্রথম আলো ডেইলি স্টার মা ও কালি -কলম মায়ের কোলে। নেন আপনার আদরের ছেলেমেয়েকে শুধু আপনার আয়োজিত সাহিত্য সভাতেই প্রিন্স ও প্রিন্সেস হিসেবে উপস্থাপন করুন।
আবুবকর সিদ্দিক বড্ড আমোদপ্রিয় মানুষ ছিলেন। আমরা একবার ঈশ্বরদী রেল জংশনের ব্রিটিশ আমলে লাল ইটের প্লাটফর্মে শিশু-কিশোরের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম। তিনি সেখানে তাঁর বক্তৃতায় শিশু-কিশোরদের গল্পে গল্পে এনগেজড করলেন। আমার বক্তৃতা শুনে মঞ্চ থেকে নামার সময় কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, তুমি তো ম্যারাথন লোক হে! জীবনে প্রেমের ক্ষেত্রে সচেতন থেকো। সাহিত্যিকের জীবনে প্রেম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম; ডায়াজিনিজের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গল্পের ফাঁকে তিনি হঠাৎ প্রেমের কথা তুললে ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ঈশ্বরদী সুস্বাদু মিষ্টান্নে আপ্যায়িত করলে তিনি শুধু বললেন, কী করে জানলে আমি ঈশ্বরদীর মিষ্টির ভক্ত!
পরে ঢাকায় উনার সঙ্গে দেখা হলে বারবারই মনে হয়েছিলো প্রাচীন বরেন্দ্রভূমিই যথার্থ ছিলো; অমন রসনগরী ফেলে বিষণ্ণতার শহরে আসাই যে ভুল।
আবুবকর সিদ্দিকের মৃত্যুকে আমার কাছে যীশুর রেজারেকশানের মতো মনে হয়। যে শক্তিশালী কথাসাহিত্যিককে নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলো নেপোটিজমের সাহিত্য করিয়েরা; সেই আড়াল পুনরাবিষ্কারের সুযোগ এলো। তাঁর ধ্রুপদী সাহিত্য-কর্ম পাঠই স্বকালের বাংলা সাহিত্যের শক্তিমত্তার উদঘাটন।
আপনার মন্তব্য