পাঠ প্রতিক্রিয়া: ১৯৭১ ভারতের বাংলাদেশ যুদ্ধ—মহিউদ্দিন আহমদ

 প্রকাশিত: ২০২৩-০৭-২২ ২২:৪৩:৫৮

শরীফ-আর-রাফি:

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও পরবর্তী সময়ের ডামাডোলের অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ের ইতিহাস নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করার জন্য লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এখন অনেক জনপ্রিয়। মূলত কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার ও প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে সে ঘটনা সম্বন্ধে উল্লেখিত তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়ে তিনি সে সময়কার ইতিহাসের একটা প্রায় পূর্ণ রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত অনেক ন্যারেটিভকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। এর ঝুঁকিও আছে, কারণ স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী অনেক ঘটনাকে এমন ভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দেবতাশ্রয়ী ও প্রবাদের মত করে সাজানো হয়েছে যে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাও জীবনসংহারী হয়ে উঠতে পারে, কিংবা ন্যূনতম অবমাননার নামে হয়রানির শিকার হওয়ার উদাহরণও বিস্তর। এই ঝুঁকিকে মোকাবেলা করার জন্য অনেক কৌশলী হয়ে ইতিহাসচর্চা করতে হয়, মহিউদ্দিন আহমদ সে দিক দিয়ে আপাত সফল।

সাক্ষাৎকার ও প্রকাশিত বইয়ের তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়ে ইতিহাস লেখার যে কৌশল মহিউদ্দিন আহমদ অনুসরণ করেন, সে ধারায় সবচেয়ে তথ্যভিত্তিক-বিস্তৃত ও পরিশ্রমী বই হলো "১৯৭১ ভারতের বাংলাদেশ যুদ্ধ"। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে ৭১-এর মার্চের ক্র্যাকডাউন পর্যন্ত আমাদের বর্ণিত ইতিহাস অনেকটা দায় দেবার মত করে প্রচলিত, যেখানে আমরা নিরীহ-দুর্বল-ধূর্তদের বিশ্বাস করার মত বোকা। সে প্রচলিত ইতিহাসই কি সত্যি? সত্যি হলেও বা কতটুকু?

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে কিংবা ক্র্যাকডাউনের পরে ভারত কীভাবে জড়িত হলো, সেটা জানার পর নির্মোহ থাকা এখনো মুশকিল, কারণ আমাদের রাজনীতি ভারত প্রেম ও বিরোধিতা দিয়ে এখনও তীব্র ভাবে প্রভাবিত। এই বইয়ে পাঠককে সেই অগ্নিপরীক্ষায় ফেলবে নিশ্চিত।

২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে কে বেশি দায়ী, কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান কোথায় তা খুব খেয়াল করে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে দায় দেবার বা নেবার ব্যাপারে প্রচলিত বিশ্বাস ভাঙার একটা সম্ভাবনা থাকবে। এটাও লেখক বিভিন্ন প্রকাশিত বই বা আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করে উপস্থাপন করে পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।

এছাড়াও অস্থায়ী সরকার গঠন, পরিচালনা, আভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাংলাদেশের পক্ষে অনেকের পক্ষত্যাগ, সর্বোপরি এর মাঝে মাঝে গৃহীত শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রভাব আলোচনায় এসেছে, এসেছে বাংলাদেশ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের দুর্দান্ত কৌশলী ভূমিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জড়িয়ে যাওয়া, ও পাকিস্তানি শাসকদের ভুল করে যাওয়াও উঠে এসেছে। সে ভুল যুদ্ধবিরতি নাকি আত্মসমর্পণ, সে নিয়েও ছিলো!

যুদ্ধোত্তর পাকিস্তানে আটকে পড়া এক সামরিক অফিসারের সাক্ষাৎকার এক নতুন ধারনা দেবে। নির্মোহ পাঠক একটু হলেও জাতিগত অতিরঞ্জনের অভ্যাসের গন্ধ পাবে। নিজের পক্ষে অতিরঞ্জনে সবসময়ই আমরা বিশ্বসেরা, এমন বদ্ধমূল বিশ্বাস আমার নিজেরই আছে। এছাড়া ঘটনার ধারাবাহিকতায় এসেছে আরও অনেক তথ্য, যেমন: ১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানীর না থাকা! এ না থাকা কি শুধুই কাকতাল?

মহিউদ্দিন আহমদের বইগুলোর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অংশ হলো বইয়ের ভূমিকা ও সমাপ্তিতে সামগ্রিক ভাবে করা তার নিজস্ব মন্তব্য ও উপলব্ধি। আজ পর্যন্ত তার এই মন্তব্যে ও উপলব্ধিকে অসংলগ্ন মনে হয়নি, ক্ষেত্র বিশেষে মনে হয়েছে অনেক সাহসী।

মহিউদ্দিন আহমদের বাকি বইগুলো পড়ুন বা না পড়ুন, এই বইটা পড়ুন। তবে বইটার কলেবর বড়, মূল্যও অনেক বেশি। এই ধরনের বইয়ের পেপারব্যাক ভার্সন বের করা জরুরি, যেন মানুষের হাতে পৌছাতে পারে সহজে, সাথে কিন্ডেল বা ইপাব ভার্সন বের করাও এই সময়ের জন্য খুবই প্রযোজ্য।

বই পড়ে ইতিহাস না জানলে মানুষের ইতিহাস জ্ঞান হয় অগভীর, ফেসবুক ইউনিভার্সিটিতে অর্জিত জ্ঞানের মত পঙ্গু, যেমন ভারতে ইদানীং বর্ণাঢ্য ইতিহাস অস্বীকার করা হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট বেড়ে যাচ্ছে, তেমন।

এত কিছুর পরও বইটাতে অনেক কথা অনুচ্চ থেকে গেছে, হয়তো সেটা প্রকাশের মত অবস্থা তৈরি হয়নি, বা সহ্য করার মত রাজনৈতিক পরিপক্বতা আমরা অর্জন করিনি। এই অতৃপ্তিটা লেখকের নিজেরও আছে। তার ইংগিত আছে সর্বশেষ প্যারাগ্রাফে। সেটা দিয়েই শেষ করছি, যেন অন্তত উচ্চারিত সত্যটা জানার আগ্রহটা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়।

"একাত্তরের মূল চরিত্রগুলো খোজার চেষ্টা হয়েছে এ বইয়ে। তারা হচ্ছেন মুজিব, ভুট্টো, ইয়াহিয়া, ইন্দিরা, নিক্সন, কিসিঞ্জার, পদগর্নি, কোসিগিন, চৌ এনলাই প্রমুখ। তারা পরস্পরকে কীভাবে দেখেছেন, কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, সেটা তাদের ভাষ্যে উঠে এসেছে। এখানে হয়তো অনেক অতিরঞ্জন আছে, হয়তো অনেক কিছু বলা হয়নি। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, জনসভার বক্তৃতা কিংবা খবরের কাগজে ছাপা হওয়া বিবৃতিতে সবটা বলা হয় না। অনেক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় একান্ত বৈঠকে গোপনে। তার সবটা কখনো জানা যায় না। যতটুকু অবমুক্ত হয় তার ভিত্তিতেই লিখতে হয় ইতিহাস। তাই ইতিহাস কখনোই পূর্নাংগ অবয়বে ধরা দেয় না।"

আপনার মন্তব্য