গল্প: আলোকচিত্রী এবং মিথিলা

 প্রকাশিত: ২০২৩-০৮-১২ ১৫:৩৭:০৭

কবির য়াহমদ:

বাগানে ফুল ফুটেছে। বাগানে ফুল ফুটবে সেই স্বাভাবিক, এখানে বলাবলির কী আছে? ফুল ফুটবে, গন্ধ ছড়াবে, মৌমাছি আসবে, প্রজাপতি আসবে! আরে ধুর! মৌমাছি আসবে কেন? ওখানে কি মধুর চাক আছে যে মৌমাছিকে আসতে হবে! তা নয় হয় নেই কিন্তু ভেবে নিতে সমস্যা কোথায়! পথচলতি পথিক হঠাৎ করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

অতি-উৎসাহী পথিক যার ঘাড়ে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে মাতিয়ে চলে পাড়া-পাড়া সে অবাক হয়ে ফুলের কাছে গিয়ে জানিয়ে দেয় নিজের উপস্থিতি; ক্লিক-ক্লিক, ক্লিকানোর মাধ্যমে! তারপর মুচকি হেসে দেখে নেয় নিজস্ব আবিষ্কার প্রথমে সংকুচিত অবয়বে তারপর একসময় জুম করে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। মনে মনে ভাবে নাহ, হলো না এবার! তারপর আবারো ক্যামেরা তাক করে ফুলের ওপর। নিজেকে বাঁকা-ত্যাড়া করে কখনো দ আকৃতি নিয়ে ঝুলে পড়ে অন্য কোনও নিরীহ গাছের ওপরে। আশপাশকার গাছগুলো অতি নিরীহ তারা হ্যাঁ-না কিছুই করতে পারে না মানুষস্বরে। তারা মুখ বুজে সহ্য করে নিজস্ব রীতিতে নিজের প্রতিবাদ জানিয়ে চলে কিন্তু ক্যামেরাম্যান অথবা আলোকচিত্রীর কান সে শব্দ অথবা প্রতিবাদ ধারণ করতে পারে না ফি-বার। তাই আবারো ক্লিক, ক্লিক! আরেকটা ছবি! এবার আলোকচিত্রী খানিকটা সন্তুষ্ট হলে ক্যামেরা দিকে তাকায় আর অস্ফুটস্বরে বলে— শাহ্‌! আলোকচিত্রীর সন্তুষ্টচিত্তের প্রকাশের সাথে সাথে নিরীহ গাছগুলো নিজের অবস্থানে চলে আসে। আলোকচিত্রীর কাষ্টমুখের আনন্দ হাসির সাথে সাথে পথ ধরে আবারো নতুন কিছুর দিকে আর পেছন ফিরে আবারো ফুলের দিকে তাকিয়ে যায় আড়চোখে; কে জানে হয়তো এখানেও অনুবাদ হয় নূতন কোনও চিত্রকল্পের পাঠ!

এ আলোকচিত্রী একটা চরিত্র হয়ে যায় পাড়ায়-পাড়ায়। নিজেকে সে স্থান দিতে চায় অন্য কোনও এক উচ্চতায় যেখানে সে কোনদিনও পৌঁছাতে পারেনি কিংবা এমনও হতে পারে তার অগ্রজদের কেউই যায়নি সেই সে চূড়ায়। তবু তাঁর নিয়ত সাধনা ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘুমোতে যাবার আগ পর্যন্তই। কে জানে ঘুমের ঘোরেও সে সেখানে যেতে চায় কি না!

এ আলোকচিত্রীরও একটা জীবন আছে বলে জানা গেছে। তার সে জীবনে খানিকটা কাহিনীও ছিলো। এ কাহিনীর কোন দৃশ্যে শেষ কবে তাদের পরস্পরের কথা হয়েছে তা মনে পড়ে না। হয়তো খুব বেশিদিন হয়নি অথবা অনেক দিন হয়ে গেছে বলে সময়ের হিসেব রাখা হয়ে উঠেনি। ব্যাপারটা আসলে অদ্ভুতই ঠেকে মাঝে মাঝে। অদ্ভুত মানে ভূতের আছর করা, নইলে এ শব্দের মাঝে ভূতের উপস্থিতি থাকবে কেন? আর কেনই বা এ শব্দ নিয়ে এতো বেশি আশ্চর্যরকমের কাহিনীকর্ম। হতে পারে ভূতের উপস্থিতি আছে বলেই অদ্ভুত শব্দটা সত্যিকার অর্থেই অদ্ভুত!

গল্পের প্রয়োজনে একটা চরিত্রের নাম দেওয়া হবে। নাম দিয়ে গিয়ে অনেক অনেক নামের ভিড়ে একটা মানানসই নাম খুঁজে নেয়া কষ্টকর। এ নাম দেওয়া মানে একটা মানুষ চরিত্রের অবয়ব দেওয়া। মাধ্যমিক স্তরের পাটিগণিতের মতো মনে করি গল্পের চরিত্রের নাম মিথিলা।

মিথিলা, বাহ বেশ সুন্দর নাম তো! এ নামে গল্পটি চলবে ভালো। নামের কারণেই কমবয়সী পাঠকেরা এ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। কমবয়সীদের প্রতি সবারই লোভ! সবাইই এদেরকে নিজেদের দলে ভেড়াতে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকে সব সময়।

কমবয়সীদের স্বপ্ন পসরা নিয়ে বসে থাকে। তাদের হরেক রকম স্বপ্নের ভিড়ে মিথিলা একটা বিশাল স্থান যে দখল করে নেবে তা নিয়ে মনে হয় খানিকটা নিশ্চিতই থাকা যায়! স্বপ্নের মাঝপথে এ কমবয়সীরা মাঝে মাঝে আঁতকে উঠবে রোমান্সের গন্ধ পেয়ে। ভাববে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড ঘুমের ঘোরে থাকতে পারলেই হতো। অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যেতো মাঝরাতে খুব একাকী সময়ে। মিথিলাকে খুব কাছ থেকে দেখা হতো! কিন্তু তা হওয়ার নয়। পাঠকেরা মিথিলাকে পেয়ে গেলে গল্পের কী হবে! ওই একরাতেই গল্পের কাহিনী শেষ হয়ে যেতো। কমবয়সীদের হাতে সারাদিনের ভাবনা-উপলক্ষ তবে হাতছাড়া হয়ে যেতো। ইস আর উফ—এই ধ্বনিযুগল মনের মাঝে দিনমান বাজবে বলে আড়ালের কেউ এই অনতিতরুণদের ঘুম ভাঙিয়ে দেন নিয়ম করেই! এছাড়াও এখানে আলোকচিত্রীর প্রতি খানিকটা সহানুভূতির ব্যাপার তো আছেই!

ধরে নেওয়া যাক, মিথিলা খুব একটা সুন্দরী নয়। তার দেহসৌষ্ঠব খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তাকে অবশ্য নাদুস-নুদুস বানানো যাবে না। এতে করে অনতি তরুণ পাঠকেরা ক্ষেপে যেতে পারে। তাদের ক্ষেপানো যাবে না। কারণ তারা এ গল্পের প্রাণভোমরা। তারা দিনমান স্বপ্ন দেখবে। তারা সারাদিন থাকবে রাতের অপেক্ষায়। মিথিলা তাদের সাথে দেখা করতে আসবে স্বপ্নের মাঝে। বিগত রাতে যেখানে স্বপ্নের শেষ হয়েছিলো তার কয়েক মিনিট আগ থেকেই তাদের স্বপ্ন শুরু করতে চাইবে। তাদের হিসেবের বিগত রাতের স্বপ্ন শুরু হবে আগের দিনের শুরুর কয়েক মিনিট আগ থেকে; এর শেষের ব্যাপ্তি আগেকার রাতের কয়েক মিনিট পর— এমনই তাদের প্ল্যান! হাজারো তরুণ, হাজারো স্বপ্ন, লক্ষাধিক ভাবনা। তারা পাঠক অথবা স্বপ্নপিয়াসী স্বপ্নপথিক। তারা স্বপ্ন দেখে বুকের বা’দিকে চিন চিন করে ব্যথা জেগে ওঠে। এ ব্যথার ব্যাপ্তি বাড়ে পেটে-তলপেটেও!

কমবয়সীদের অনেক স্বপ্ন মিথিলাকে নিয়ে। তারা দিনভর স্বপ্ন দেখে, রাতেও দেখে, নবরূপে নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায়। তারা নিজেদের নিয়ত সাজায় নিজস্বরূপে। দিন দিন প্রতিদিন, কিন্তু কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি অদ্যাবধি। তারা রোজ রোজ ব্যর্থ হয় কাছে পেতে, কিন্তু ব্যর্থতায় উদ্যম হারায় না। তাদের এ উদ্যম আচানক। হতে পারে পারে কমবয়সী আকাঙ্ক্ষা জড়ানো যেখানে থাকতে পারে লোভনীয় কিছুর আচানক রঙ।

আর সবার মতো কোন একদিন আলোকচিত্রীও প্রেমে পড়ে মিথিলার। আলোকচিত্রীর বয়স খুব বেশি না হলেও কমবয়সীদের চেয়ে খানিকটা বেশি। আলোকচিত্রী নিজেও জানেও পঁচিশে ছেলেদের ম্যাচুইরিটি আসে। সে সময়ে খুব বেশি লোক পাওয়া যায় না যারা মাত্র প্রেমে পড়ে। কিন্তু আলোকচিত্রীর এছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। মনে হতে পারে আলোকচিত্রী তবে জোরপূর্বক পড়ে গেছে মিথিলার প্রেমে। এ জোর করা ব্যাপার আসেনি মিথিলার পক্ষ থেকে, অথবা অপরাপর কোনও পক্ষের কাছ থেকে। আলোকচিত্রী নিজের অজান্তেই মিথিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। তারপর এ ব্যস্ততা আকর্ষণে রূপ নিলে তার করার ছিলো না কিছুই। আসলেই কি কিছুই ছিলো না করার— এও প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার বলে আড়ালে অনেকেই প্রশ্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু উত্তরদাতা এখানে নিজের অবস্থান খানিকটা ধোঁয়াটে রাখতে চান বলে এর উত্তর পাওয়া কষ্টকর বৈকি!

আলোকচিত্রীর সাথে মিথিলার ঘনিষ্ঠতা প্রকৃত অর্থে ছবির সূত্র ধরে। ক্যামেরার লেন্সে আঁকা মিথিলা বাস্তবের চাইতে অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে আলোকচিত্রীর মন পড়ে যায়। ফুল-পাখির সাথে মিথিলা অন্য অর্থে ধরা দেয়। তাই দিনভর কাজের শেষে মাঝরাতের কোনও একান্ত সময়ে নিয়ম করে মিথিলার দেহসৌষ্ঠবে আলতো করে হাত দেয় আলোকচিত্রী। তখন অন্য এক মানবীয় আর মাধুর্যময় রূপ নিয়ে হাজির হলে বেচারা আলোকচিত্রীর পঁচিশের যুবামন নিজের পৌরুষকে বিসর্জন দিতে পারে না! হামলে পড়ে নিজস্বতায়, যৌবনের গতি নিয়ে প্রতিরাতে নিয়ম করে। তারপর কোনও একদিন কমবয়সী যুবাদের মতো মাঝরাতে স্বপ্নের মাঝে আবিষ্কার করে মিথিলাকে। অবিবাহিত পুরুষের মানসিক আর শারীরিক আকাঙ্ক্ষাকে মাঝরাতে স্বপ্নের মাঝে আলোকচিত্রী আবিষ্কার করে নয়ারূপে যা সে জাগরণকালে ভাবেনি কখনো অন্তত মিথিলাকে নিয়ে। তাই কমবয়সী যুবাদের মতো আঁতকে উঠে মাঝরাতে; মিথিলাকে স্বপ্নের মাঝে পেয়ে।

স্বপ্ন এগোয় ক্রমশ। মিথিলা কাছে আসে, পাশে বসে। হাত বাড়িয়ে দেয় আলোকচিত্রীর হাতের দিকে। আলোকচিত্রীর নীলাভ চোখগুলো লোভাতুর হয়ে ওঠে। মিথিলা হাত রাখে আলোকচিত্রীর বাম হাতে। মাঘের শীতের মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে আলোকচিত্রীর হাত। নিজেকে ভাবতে বসে সে সত্তরোর্ধ্ব পুরুষ। মিথিলা মুচকি হাসে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে ফিরে পাবার প্রাণান্ত চেষ্টায় মেতে উঠে আলোকচিত্রী। মিথিলার ধরা বাম হাতে ঠক ঠক কাঁপন থামাতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চাপে। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে আলোকচিত্রী নিজের বাম হাতে নিজের ডান হাত এগিয়ে দেয় কাঁপন আটকাবে বলে। ক্রমে নিজেকে ফিরে পায় আলোকচিত্রী। একপ্রস্ত হাসি বিনিময় পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মিথিলার হাত ধরতে যায় সে তাড়াহুড়ো করে। ঠিক সে সময়েই ঘুম ভেঙে যায় কমবয়সী যুবাদের মতো। বিছানায় তড়পড়িয়ে ওঠে। মনোজগৎ আর শারীরিক খানিক পরিবর্তনে অবাক হয় সে। এই বয়সে এমন কেন হয় ভাবতে গিয়ে ভাবে সে তো আর অনতিতরুণ নয় যে রাতে রাতে নয়া নয়া স্বপ্ন দেখে নিজের শারীরিক পরিবর্তন আর চাহিদাকে জানান দেবে। পরক্ষণে ভাবে সেও তো অবিবাহিত যুবা!

সেই শুরু। তারপর আলোকচিত্রী নিজেকে মনোনিবেশ করে দিনের কাজে। দিনকার মতো সেও ফুল-পাখির পিছু ছোটে। ফুলের দিকে ক্যামেরা তাক করলে মাঝে মাঝে মিথিলা আসে। আকাশে ওড়া পাখির দিকে ক্যামেরা তাক করলে মিথিলা আসে। সে আগ্রহ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলে। মনের মাধুরীর পুরোটাই ঢেলে দেয় ওখানে। একসময়ে ক্যামেরার সংকুচিত ক্ষুদ্র স্ক্রিনে মিথিলাকে দেখতে গিয়ে অবাকই হয়— সে আসলে মিথিলাকে তুলে আনতে পারেনি। মিথিলার বদলে হাজির হয়েছে রোজকার মতো ফুল-পাখি আর অন্য কিছু। যা নিয়ে আগেও তুলেছিলো অনেক অনেক ছবি। যার মাধ্যমে কোনও একদিন সে সরকারি কোন এক অনুষ্ঠানে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর হাত থেকে নিয়েছিলো সম্মাননা আর পুরস্কার। আলোকচিত্রী অবাক হলেও এ যাত্রায় হতাশ হয় না।

আলোকচিত্রী বুঝতে পারে মিথিলাতে মগ্ন হয়ে গেছে সে। তাই কোনও এক সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বাহানায় তার কাছে ভিড়ে। মিথিলাও হতাশ করে না তাকে। কাছাকাছি থেকে কাছে আসা। আলোকচিত্রী স্বপ্নে দেখা কাহিনীর অনুবাদ করতে চায় বাস্তবে। স্বপ্নে যা পারেনি তার ষোলকলা পূর্ণ করতে চায় বাস্তবে। আচমকা শারীরিক পরিবর্তনকে সামলে নিয়ে মিথিলাকে বলে ঘুম ভাঙার পরের সময়ের কাহিনী। প্রথম দিন মিথিলা খানিক রাগ দেখিয়ে চলে গেলেও পরের দিন একইভাবে নতুন মশলা জোগান দিয়ে কাহিনী বলে নিলে মিথিলা আকর্ষণ বোধ করে। সে শুনে যায় সব। খানিক লজ্জায় লাল হয় মুখাবয়ব। আলোকচিত্রী বোঝে মিথিলার চোখের ভাষা। সে বুঝতে পারে এপর্যায়ে এসে কিছুটা হলেও নিজের দিকে টেনে আনতে পেরেছে। মিথিলা খানিক অবাক হবার ভঙ্গিমা দেখালে মনে মনে সেও এ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ভেতর থেকে কে যেন তার মনোজগতে নাড়া দিয়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে তার দেহের কোষে কোষে। কিন্তু তা সে এ যাত্রায় প্রকাশ করে না নারীত্বের দোহাইয়ের কারণে। এ দোহাইয়ের প্রকাশ সে শেখেনি কারো কাছ থেকে, কিন্তু প্রকৃতি তাকেও শিখিয়ে দিয়েছে নিজস্বতায়।

আলোকচিত্রী আঁচ করতে পারে মিথিলার মনোজগতের পরিবর্তন। তাই সে বারবার একই কাহিনীর বলে যায়। মিথিলাও শোনে। কিন্তু বাস্তব জগতে আসতে ভয় পায় সে। সামাজিকতা এখানে সামনে এসে দাঁড়ায়। তাছাড়া আগামীর খণ্ডিত ভাবনা। আলোকচিত্রী জীবনের ছলাকলার কথা বলে উপভোগের কথা বলে। মরে গেলেই সব শেষ। মিথিলাও মাথা নাড়ে। মুচকি হাসি ফোটে আলোকচিত্রীর ঠোঁটের কোণে।

ছবির প্রয়োজনে কয়েকবার আলোকচিত্রীর বাসায় এসেছে মিথিলা। একা একা আসা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। আলোকচিত্রী নিজস্ব পটে তুলেছে তার ছবি; ঘরে-বাইরে! মিথিলা আলোকচিত্রীর স্থিরচিত্র হতে পেরে খুশি আর আলোকচিত্রীও খুশি চিত্রকল্প আঁকতে পেরে। আলোকচিত্রী মিথিলাকে নিয়ে অনেক দূর এগোতে চায়। ঠিক তেমনিভাবে মিথিলাও চায় এগিয়ে যেতে।

আলোকচিত্রীর খুব ইচ্ছা একদিন শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে সাঁতার কাটবে মিথিলাকে সাথে নিয়ে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলে মিথিলা না করতে পারে না। কিন্তু বিপত্তির জায়গাতে দেখা যায় শহরের পাশ দিয়ে যে নদী বয়ে চলে গেছে সেখানে সাঁতার কাটার উপযোগী পানি নেই। পানি নাম নিয়ে যা আছে তা আসলে আবর্জনার স্তূপীকৃত অংশ। তাই তাদের আপাত পরিকল্পনা বাদ পড়ে যায়। তারা অন্য পথে এগোয়। ভাবে দূরে কোথাও গিয়ে নিজেদের হারিয়ে নেবে অজানার উদ্দেশে। এমন করে তাদের ভাবনাগুলো পাখা মেলে আপনা থেকে। দিন দিন নতুন ভাব আসে; ভেবে যায়। পরিকল্পনাগুলো পরিকল্পনাবিহীন হয়ে উঠলে বাস্তবায়নের পথে নেমে আসে অসাড়তা! স্বপ্ন দেখার সময়ে স্বপ্ন দেখে চলে। সাঁতার কাটা হয়ে ওঠে না কোনও নদীতে একইসাথে! ওড়া হয় না বাস্তবে দূর আকাশে, শুধু শুধু ভাবনার পসরারাজি ছাড়া।

মিথিলা একদিন বায়না ধরে রেললাইন ধরে হেঁটে যাবে মাইলের পর মাইল। এ জীবনে সে কখনো রেল চড়েনি শুনে অবাক হয় আলোকচিত্রী। রেল চড়ার মজার অভিজ্ঞতা বলতে যায় সে। মিথিলা শোনে আর অবাক হয়ে বলে রেল লাইনের স্লিপারের ওপর দিয়ে কয়েক মাইল হেঁটে গেলে তার রেল চড়ার শখ পূর্ণ হয়ে যাবে। রেলের গতি এতো ধীর কেন এমন ছেলেমানুষি প্রশ্নের জবাবে আলোকচিত্রী বলে— জীবনের সাথে রেলের মিল অনেকখানি। জীবন যেমন ধীর লয়ে এগিয়ে চলে গন্তব্যের দিকে, রেলও তেমন ক্রমে ধেয়ে চলে মাইলের পর মাইল হয়ে তার গন্তব্যে। জীবন যেমন কোনও একদিন নিয়ম করে নিশ্চিতভাবেই তার শেষ ঠিকানায় পৌঁছায়, রেলও তেমন করে নিশ্চিতভাবেই গন্তব্যবিন্দুতে গিয়ে থামে। আলোকচিত্রীর উত্তরের ধরন আর আত্মবিশ্বাসে মিথিলা অবাক হয়।

আলোকচিত্রীর বাসার পাশ দিয়ে একটা রেললাইন চলে গেছে অনেক দূর। আলোকচিত্রী নিশ্চিত করে জানে না কোথায় সে গন্তব্য, কিন্তু এ পথে তার হাঁটা হয়েছে অনেক দিন। কখনো ছবি তোলার জন্যে, আবার কখনো বা কিছুদিনের পরিচিত কারো সাথে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে। এ পরিচিতজনদের মাঝে কয়েকজন মেয়েও ছিলো, কিন্তু সে পরিচয় ছিলো পরিচয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ। পরিচয় থেকে এর ব্যাপ্তি বেশিদূর এগিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কে পৌঁছায়নি তা। এই প্রথম কোন মেয়েকে নিয়ে এমন করে রেললাইন ধরে হাঁটছে সে। যার সাথে তার সম্পর্ক অন্যমাত্রা ছাড়িয়েছে আগেই।

রেললাইনের সরু স্লিপার খাঁ খাঁ রোদে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে গেলেও এ তপ্ততার মাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে ভেতর থেকে আসা খানিক মৃদুমন্দ হাওয়া। আলোকচিত্রী এ তপ্ত রোদে মিথিলার হাত ধরতে চায়। মিথিলা না করে না। সেও আগ্রহ নিয়ে বাড়িয়ে দেয় হাত। বাদামি রঙের আলোকচিত্রীর হাতের মাঝে আশ্রয় নেয় হলুদ রঙা মিথিলার হাত। আশপাশজনের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না এ নিয়ে আলোকচিত্রী মোটেও মাথা ঘামায় না। সে হলুদ রঙা একটি হাত নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে চলে রেললাইনের স্লিপার ধরে।

আলোকচিত্রী অবাক হয় চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে হাঁপিয়ে ওঠা মিথিলার মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ না পড়ায়। সে বুঝতে পারে এ আসলে ভালোবাসাময় খেলা। ভালোবাসার কারণেই এমন হয়ে যায় সব। তাই আবারো কোন একদিন আমন্ত্রণ জানায় সে এমন করে কোনও অভিযানে নামতে। মিথিলাও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। আলোকচিত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে দেখিয়ে দেয় আকাশ ভেঙে আজ রোদ নেমেছে রেললাইনের ওপরে। সাথে থাকা বালুময় মাটি চিক চিক করে শুষে নিয়ে রেখেছে সূর্যের সমূহ আলো। তাই ওপর থেকে যতটা না গরমে অতিষ্ঠ হয় আর বাকি সব ক্লান্ত পথিক তাদের ক্লান্তির পালে আরও জোরে হাওয়া লাগায় নিচের মাটি। অন্য সবার চোখে মিথিলা-আলোকচিত্রী হয়ে যায় পথিককুলের কোন চরিত্র। কিন্তু তাদের বিশ্বাসে তারা থেকে যায় আর অনেক কিছু। রেললাইন তাদের অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে রেখেছে, একসাথে নিজেদের নিয়ে এসেছে বলে।

পাখিদের বাদানুবাদের মতো কোন একদিন আলোকচিত্রী আর মিথিলার মাঝে খানিকটা বাদানুবাদ হয়ে এলে পাখিসমাজের মতো তারাও একদিন নীড়ছাড়া হয়। আলোকচিত্রী নিজস্বতায় ফুল-পাখিতে ব্যস্ত সময় কাটাতে চাইলে মিথিলা চলে আসে নিজস্ব পৃথিবীতে। আলোকচিত্রী আর ইদানীংকার কয়েকদিন মাঝরাতে স্বপ্ন দেখে না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙে না তার। ইতস্তত হয়ে নিজের বিসর্জনের দিকে অবাক হয় না সে খুব একটা। বয়সের কারণে কিংবা অতিব্যবহার কে জানে তবে তার মাথার মাঝে কেবলই বাড়ে ফুল-পাখি আর গাছের সমারোহ। তাই মিথিলা থেকে আপাত দূরে চলে যায় নিজের অজান্তেই।

একাকী সময়ে একদিন মিথিলা আসতে চায় আলোকচিত্রীর কাছে স্থিরচিত্র হবে বলে। আলোকচিত্রী ফিরিয়ে দেয় সময় নেই অজুহাতে। মিথিলার অবাক চোখ নিজেকে সংবরণ করে হাঁটা ধরে পা পথের দিকে। আলোকচিত্রী নিজেকে মনোনিবেশ করে মূর্ত স্থিরচিত্রে। ফুল-পাখি আর গাছেদের কাছে তার অনেক কিছু পাওয়ার আছে বলে নিজে নিজেকে প্রবোধ দেয়।

রাত হয়। দিন নামে। আলোকচিত্রীর ব্যস্ততা বাড়ে। নির্ঘুম রাত সখা হয়ে আসে তার। মাঝে মাঝে ঘুমাতে যায় ভোর করে। মাঝে মাঝে ভোর হয়ে আসে মাঝরাতেই। চিত্র আর স্থিরচিত্রে মজে যায় সে আজন্ম বোবাদের মতো! ভুলে যাওয়া স্বপ্ন একদিন ফি-বার উঁকি দেয় মাঝরাতে। একটি হলুদ রঙা হাত ধরে ফেলে তার বাম হাত। ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে পুরো আত্মা। নিজেকে সামলাতে গিয়ে পারে না সে। ধড়ফড়িয়ে ওঠে ঘুম থেকে। গলা শুকায় অসময়ে।

কমবয়সী যুবাদের মতোই আলোকচিত্রী নিজেকে আবিষ্কার করে আবারো সেই আগের পৃথিবীতে!

আপনার মন্তব্য