নজরুলের বুলবুল অথবা বুলবুল-ই নজরুল

 প্রকাশিত: ২০২৩-০৫-২৫ ২২:৪৭:৫৯

শ্যামলাল গোসাঁই:

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে দুই বাংলায়। সংগীত, সাহিত্য, সুর, বিদ্রোহসহ নানা আঙ্গিকে নিজের জীবনকে ছন্দময় করে তুলেছিলেন বাংলার জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। যেমন বৃহৎ নজরুল রচিত সাহিত্য ভাণ্ডার, সংগীতের সুধারা কিংবা সুরের মুনশিয়ানা ঠিক ততোটাই বিস্তৃত আর সুগভীর ছিল জাতীয় এই কবির জীবন। জীবনের চরম চড়াই, উৎরাই, উত্তেজনা কিংবা নিভে যাওয়া সবই যেন নজরুলকে করে তুলেছিল আরও রহস্যময় কিংবা আকর্ষণীয় এবং সৃজনশীলও। ফলত আজ তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও নজরুলকে ঘিরে একটুও কমেনি পাঠক আর সাহিত্যিক আগ্রহ।

নজরুল ইসলামের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যেতে পারে তাঁর ছেলে বুলবুলকে। প্রাণাধিক প্রিয় বুলবুলকে কবি পছন্দ করতেন সবার থেকে বেশি। বুলবুলও যেন জন্মের পর থেকে মাত করে রেখেছিল কবি নজরুলের আঙিনা। কিন্তু সেই প্রাণের বুলবুলের মৃত্যুর পর চেনা নজরুল হয়ে গিয়েছিলেন অচেনা। দারুণ প্রাণচঞ্চল, বিনোদনপ্রিয় হাস্যোজ্জল একজন মানুষ হয়ে গেলেন স্তব্ধ। যেন বুলবুলের মৃত্যুতে কালের সঙ্গে সর্বকালের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলেন নজরুল ইসলাম। হয়ে ওঠেছিলেন নিগুঢ় আধ্যাত্মিক একজন মানুষ।

জানা যায়, কবির তিনপুত্রের মধ্যে বুলবুলকেই কবি সবচেয়ে বেশি আদর করতেন। বুলবুলের জন্ম হয় কবি কলকাতার কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন। এই কৃষ্ণনগরে বসেই কবি সৃষ্টি করেছেন অমর সব সংগীত। ১৯২৭ সালের ১৩ মার্চ কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ছেলে বুলবুলের অন্নপ্রাশন করেন কবি। কিন্তু এর কিছুদিন পর কৃষ্ণনগরের বাড়ি ছাড়তে হয় তাদেরকে।

বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে কবিপুত্র বুলবুলের মৃত্যু হয় ১৯৩০ সালের ৭ মে। ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিল ছোট্ট বুলবুল। তাই যেন মরমে সয়নি কাজী নজরুল ইসলাম। যাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন তাঁকে এমন মৃত্যুশয্যায় দেখে বারবার আকুল হয়ে উঠতেন নজরুল। যখন বুলবুলের ব্যথায় জর্জরিত নজরুল ইসলাম তখনো দুঃখ ভুলতে নজরুল একের পর রচনা করে চলেছেন হাস্যরসাত্মক সব সাহিত্য। চন্দ্রবিন্দু-র মতো মহাকাব্য নজরুল রচনা করেছেন স্বীয় পুত্রের মৃত্যুশয্যায় বসে তা আজ মেনে নিতে পাঠকেরও হয়তো মন আন্দোলিত হবে।

কিন্তু তিনি যে নজরুল; শক্ত হৃদয়ের এক বিদ্রোহী। শৈশব থেকে যিনি লড়াই করেছেন এবং নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সাহিত্যের উঁচু সিংহাসনে। তাই হয়তো বারবার বেদনার কণ্টকের মাল্য বারবার পরতে হয়েছে কবিকে। বুলবুলের চোখেও বসন্ত হয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকলে অন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু নজরুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল বুলবুল বড় হয়ে ভালো কোনো গায়ক বা বাজিয়ে হবে। বুলবুল বাবার সাথে থেকে থেকে সেসব সেভাবেই রপ্ত করেছিলো। শুধু কী নজরুল, কবিপুত্র বুলবুল প্রভাব রেখেছেন কবির বন্ধুবান্ধবদের উপরও। সকলেই বুলবুলকে তাই আদরও করতেন। বুলবুল যখন মৃত্যুশয্যায় পিতাকে ছাড়েনি একটু সময়ের জন্যও। নজরুলও ছেলের মাথার পাশে বসে থাকতেন জগতের সকলের হতাশা নিয়ে। আশা রাখতেন কোনো এক জাদুবলে সুস্থ হয়ে যাবে বুলবুল।

একবার কবি জানতে পারলেন একজন সাধু আছেন যিনি এর আগে বসন্ত রোগীকে সুস্থ করে তুলেছেন। কবি তাঁর দুই বিশ্বস্ত বন্ধুকে পাঠালেন সেই সাধুকে নিয়ে আসতে। যদি বুলবুল ভালো হয় তাঁর হাতের পরশে। এই এক বিশ্বাসে নজরুল পাঠালেন তাদেরকে। তারা যেদিন ফিরে আসলেন সাধুকে নিয়ে ততক্ষণে জগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বুলবুলের; পৃথিবীর সব থেকে বড় পাথর এসে সেদিন বুকে চেপে বসেছিল কবির। কবির দুই বন্ধু যখন সাধুকে নিয়ে গৃহপ্রাঙ্গণে মাত্র প্রবেশ করেছেন; তখন নজরুল ঢুকরে কেঁদে ওঠে তাদেরকে বললেন- ওরে মঈনউদ্দি, তোমাদের সাধু কী মরা মানুষ জীবিত করতে পারে? পরে জানা যায় সাধুকে নিয়ে ফেরার মাত্র দশ মিনিট পূর্বে মৃত্যু হয় কবির প্রাণপ্রিয় পুত্র বুলবুলের।

বুলবুল যখন বসন্তের থাবায় চিরতরে চলে গেলেন চিরতরে ভেঙে পড়লেন বিদ্রোহী কবি। যেন সহ্যসীমানা অতিক্রম করেছিলো বুলবুলের মৃত্যুর ঘটনা। এরপর থেকে একেবারে বদলে গেলেন তিনি। কারো সাথে কথা বলেন না, সারাক্ষণ বুলবুলের ঘোরে বসে থাকেন। বুলবুলের প্রভাব এসময় নজরুল সাহিত্যেও ব্যাপকভাবে পড়তে থাকে। যেন নজরুল বুলবুলকে হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আসলেও, তাই হয়েছিলেন কবি। কখনো বুলবুলকে হারানোর বেদনা ভুলে থাকতে লিখেছেন হাস্যরসাত্মক কবিতা, ছড়া।

এ সম্পর্কে কবি জসিম উদ্দিন বলেন- একদিন আমি ডিএন লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি লাইব্রেরির এক কোণায় বসে আছেন আমাদের কবি নজরুল। সেখানে বসে একমনে বুলবুলের স্মৃতিতে হাস্যরসের সব ছড়া লিখছিলেন তিনি। কিন্তু চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছিলো তাঁর। চোখ দুটো কাঁদতে কাঁদতে লাল করে ফেলেছিলেন।

কবি জসিম উদ্দিনের লেখা ছাড়াও পরবর্তীতে নজরুল নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের লেখায়ও কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে বুলবুলের যে প্রভাব তা ফুটে উঠেছে পরিষ্কারভাবে। বুলবুলের আরকটি নাম (অরিন্দম খালেদ) রেখেছিলেন কবি। যদিও অরিন্দম খালেদের চাইতে বুলবুল নামেই নজরুল ইসলাম তাঁকে ডাকতেন বেশি।

বুলবুল যখন মৃত্যুর একদম কাছাকাছি, সে সময় নজরুল তার শয়নে বসে বসে অনুবাদ করছিলেন কবি হাফিজের কিছু রুবাইয়াৎ। বুলবুলে উৎসর্গ করে ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ওই কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল রুবাইয়াৎ ই হাফিজ। এই বইটির উৎসর্গপত্রে শোক সন্তপ্ত নজরুল লিখেছিলেন- তোমার মৃত্যুর শিয়রে বসে বুলবুল ই সিরাজ হাফিজের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি- উড়ে গেছো। যে দেশে গেছো সে কী বুলবুলিস্তান, ইরানের চেয়েও সুন্দর? জানিনা তুমি কোথায়? যে লোকেই থাকো তোমার পিতার এই শেষদান, শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।

আপনার মন্তব্য