উনিশ বসন্ত এবং একজন রাসসুন্দরী দেবীর পুনর্জন্ম

বই আলোচনা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৩ ১০:৪৪:৩৫

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৩ ১০:৫৩:২৮

ফরিদ আহমেদ:

‘আমি আমার আত্মজীবনী লিখছি।‘হঠাৎ করেই প্রীতি বলে।
আমার ভিমড়ি খাবার দশা।
‘কী! কী লিখছো? আত্মজীবনী?‘আমার বিস্ময় ঢাকা থাকে না।
‘হ্যাঁ, আত্মজীবনী লিখছি, নাম উনিশ বসন্ত।‘নির্বিকার গলায় প্রীতি বলে।
হেসে ফেলি আমি। বলি, ‘উনিশ বসন্ত কথাটা ঠিক না।‘
‘কেনো ঠিক না। আমার বয়সতো উনিশ, তাই এই নাম।‘সে যুক্তি দেখায়।
‘বয়স উনিশ হলেই উনিশ বসন্ত হয় না।‘আমি পাল্টা বলি।
এবার ওর অবাক হবার পালা। ‘কীভাবে? আমি তো উনিশটা বসন্তই পার করেছি জীবনে।‘
‘তা করেছো। কিন্তু, বসন্ত বোঝার জন্য, একে উপলব্ধি করার জন্য মানুষের শরীরে যৌবন আসা লাগে। এর আগে ঋতুর পার্থক্য কেউ করতে পারে না। তখন সব ঋতুই এক মনে হয়।‘

এর উত্তরে প্রীতি কী বলেছিল, মনে নেই আমার। মনে থাকার প্রয়োজনও নেই। উনিশ বছরের একটা মেয়ে তার জীবনী লিখছে, এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কী হতে পারে আমার জন্য। আমি মধ্য বয়সের একজন মানুষ, উনিশ বছরের একটা মেয়ে আমার কাছে বাচ্চা সমতুল্য। ডিম ফুটে বের হয়েছে, বা নাক টিপলে দুধ বের হয় এর চেয়ে বেশি কিছু না। সেই মেয়েটাই যখন এমন অদ্ভুত কাজ করছে, তখন বিপুল বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর গতি থাকে না।

প্রীতির চেয়ে কম বয়সে কেউ যে আত্মজীবনী লেখে নি এমন নয়। ছোট ছোট বাচ্চারা প্রায়শই আত্মজীবনী ধরনের লেখা লিখে থাকে। সিরিয়াস আত্মজীবনী বলতে যা বুঝায়, তা সবচেয়ে কম বয়সে লিখে গিয়েছে অ্যান ফ্রাংক। ডায়েরি লেখার সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র তেরো। হালের তরুণী গায়িকা এবং অভিনেত্রী হ্যানা মন্টানাখ্যাত মাইলি সাইরাসও আত্মজীবনী লিখেছে মাত্র পনেরো বছর বয়সে। আমাদের দেশে এতো কম বয়সে আর কেউ আত্মজীবনী কেউ লিখেছে বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশের বা বাংলা সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ আত্মজীবনী লেখক হিসাবে প্রীতি স্বীকৃতি পেলেও আমি খুব একটা অবাক হবো না।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্নাঙ্গ আত্মজীবনীও কোনো পুরুষ সাহিত্যিকের হাত দিয়ে রচিত হয় নি। রচিত হয়েছে একজন নারীর মাধ্যমে। আরো বিস্ময় হচ্ছে যে, এই নারী শহরবাসিনী বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, ছিলেন না প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যিকও। আটপৌরে এক গ্রাম্য নারী ছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে বিশাল সংসারের ঘানি টেনেছেন তিনি সারাজীবন। কোনো বিদ্যালয়ে তিনি যান নি, কেউ তাঁকে বাড়িতেও বিদ্যাশিক্ষা দেয় নি। নিজ আগ্রহে বহু কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে নিজে পড়া শিখেছেন তিনি, পূর্ণ বয়সে লেখাও শিখেছেন। তারপর ষাট বছর বয়সে অত্যন্ত ঝরঝরে, সহজ সাবলীল এবং সতেজ ভাষায় লিখে ফেলেছেন তাঁর আত্মজীবনী। আর এর মাধ্যমেই তিনি জড়িয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে। কারণ, এটাই বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনী। তাঁর এই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের গ্রাম বাংলার কুসংস্কারসমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা, গৃহে আবদ্ধ বিদ্যাশিক্ষা বঞ্চিত নারীর নিগৃহীত জীবনের সকরুণ বিবরণী। এটা শুধু একজন নারীর জীবনবৃত্তান্তই নয়, হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিলও।

এই নারীর নাম রাসসুন্দরী দেবী। যদিও রাসসুন্দরী দাসী নাম নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’নামে। গ্রন্থটির প্রথম অংশ তিনি লিখেছেন ষাট বছর বয়সে, পরবর্তীতে অষ্টাশি বছর বয়সে এর দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করেছেন গ্রন্থের সাথে। বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। পরবর্তীতে এর সংগে দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করে প্রকাশ করা হয় ১৮৯৭ সালে। এই বইটার প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয়েছে তাঁর নিজের লেখা কবিতা বা ভক্তি গান দিয়ে।

উনিশ বছর, জীবনের দৈর্ঘ্যে খুব স্বল্প একটা সময়, অভিজ্ঞতাহীন স্বপ্নালু মুহূর্ত মাত্র। জীবনের বহু রঙই তখন পর্যন্ত থেকে যায় অনুপস্থিত। জীবনকে প্রতি মুহূর্তে সামনে দেখে দেখে একজন পরিণত মানুষ যে, নিজস্ব অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞান লাভ করে, সেই জ্ঞান অনুপস্থিত থাকে একজন উনিশ বছরের। ফলে, জীবনকে সে যে চোখে দেখছে, সেখানে ভ্রান্তি থাকতে পারে, থাকতে পারে অনিশ্চয়তা, থাকতে পারে ভাবালুতা। প্রীতির ক্ষেত্রে এর কোনোটাই হয় নি। খুব নির্মোহভাবে নিজের জীবনকে উপস্থাপন করেছে সে। বাড়িয়েও বলে নি নিজের সম্পর্কে কিছু, আবার বিনয়ী হতে গিয়ে অস্বীকারও করে নি নিজেকে কোথাও। তার জীবনী পাঠ করতে গিয়ে অপরিণত বয়স্ক কেউ বলে মনে হবে না তাকে, আবার ইঁচড়ে পাকাও ভাবার অবকাশ থাকবে না কোনো।

প্রীতি তার বয়সজনিত অভিজ্ঞতার ঘাটতিকে পুষিয়ে দিয়েছে বিপুল পরিমাণে বই পড়ে। তার বয়েসী একটা মেয়ে যে অবিশ্বাস্য পরিমাণে বই পড়েছে, সেটা ভাবলেই বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। বিস্ময় শুধু তার বই পড়াতেই নয়, তার নানামুখী প্রতিভা এবং সৃষ্টিশীলতাতেও বিরাজমান। এই বয়সে সে এক গাদা পুরস্কার পেয়ে বসে আছে নানা প্রতিষ্ঠান থেকে নানা প্রতিযোগিতায় জিতে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার গভীর আগ্রহও তার মধ্যে আছে বলেই মনে হয়। নিজেকে যাচাই করে দেখার, নিজেকে আরো ক্ষুরধার করার একটা প্রচেষ্টা হয়তো তার এটা। প্রীতি ব্রান্ড এম্বাসেডর হিসাবে কাজ করছে মাইক্রোসফটের সাথে। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাকে ডাকেন চাইল্ড প্রডিজি নামে। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল যাকে এই সম্মাননা দেন, তার প্রতিভা সম্পর্কে অন্য কারো সন্দেহ থাকার আর কোনো অবকাশই থাকে না। আমারও নেই। এই মেয়েটা খুব অল্প দিনের মধ্যেই তার বিপুল প্রতিভা দিয়ে, তার অসীম সৃষ্টিশীলতা দিয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রানির আসনে বসবে, সেই ভবিষ্যতবাণী এখনই আমি করে দিতে পারি। আমার গলা কাঁপবে না একটুও। যে দ্রুতলয়ে প্রীতি এগিয়ে যাচ্ছে জীবনস্রোতে ভেসে সমুদ্র সন্ধানে, সেই গতি অব্যাহত থাকুক, এই শুভ কামনা রইলো।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীর এবং সবচেয়ে কম বয়সের আত্মজীবনীর সাথে উত্তরবঙ্গও জড়িত হয়ে গেছে। প্রথম আত্মজীবনীর রচয়িতা রাসসুন্দরী দেবী সিরাজগঞ্জের মানুষ। কাকতালীয়ভাবে, সবচেয়ে কম বয়সের আত্মজীবনীর রচয়িতা প্রীতিও সিরাজগঞ্জের মেয়ে। রাসসুন্দরী দেবীর না জেনে ইতিহাস সৃষ্টি করার দেড়শো বছর পরে, প্রীতিও নিজের অজান্তেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে।

আমাদেরও সৌভাগ্য যে, আমাদের চোখের সামনেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছি। আমার জন্য বিষয়টা আরেকটু বেশি। কারণ, এই লেখাটার মূল ভার্সন আমি লিখেছি বেশ কিছুদিন আগে। এটি সেই লেখারই বর্ধিত অংশ। মূল লেখাটা স্থান পেয়েছে প্রীতির বইয়ের ফ্ল্যাপে। শুধু এ'টুকুই নয়। প্রীতি এই বইটা উৎসর্গও করেছে আমাকে এবং অভিকে। উৎসর্গে প্রীতি লিখেছেঃ

অভিজিৎ রায়: প্রিয় অভি’দা, আমি এতো দ্রুত নিজের কিশোরী বেলা, তরুণী বেলার কথা কোনো বইয়ের মলাটের ভেতরে বলবো ভাবি নি। যখন আপনার সঙ্গে কথা হতো, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনের চিন্তা-ভাবনা যাঁরা বদলে দিতে পারেন, সেই ম্যাজিশিয়ানদের দুইজনকে বই উৎসর্গ করবো। সেই বই লেখা সমাপ্ত, কিন্তু আপনি নেই।

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে...

-আপনি সেখানে বাঁচুন।

ফরিদ আহমেদ: পৃথিবীতে যেসব নগন্য সংখ্যক মানুষকে কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগে, নিঃসন্দেহে আপনি তাঁদেরই একজন। অসাধারণ ও প্রিয় লেখনীর কাছেও মনুষ্যত্বই যেখানে প্রধান আকর্ষণ। প্রবাসে থেকেও যে ব্যক্তির প্রতিটি লেখায় এক মানচিত্রহীন দেশকে ফুটে উঠতে দেখি, তিনি আপনি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চাইতে সংরক্ষণ করতে আমার বেশি ভালো লাগে। আপনার প্রতিও একরাশ জমানো কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা।

অনেক অনেক শুভকামনা রইলো উনিশ বসন্ত এবং এর ক্ষুদে স্রষ্টার জন্য।

তরুণীর আত্মকথন উনিশ বসন্ত
লেখক : জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
প্রচ্ছদ : সোহেল আনাম
প্রকাশক : ইফতেখার আমিন, শব্দশৈলী
একুশে গ্রন্থেমেলা, সোহওয়ার্দি উদ্যান স্টল নং ৪৩৪-৪৩৫-৪৩৬

আপনার মন্তব্য