প্রকাশিত: ২০২৩-০৬-১০ ১৫:০৩:৩৪
আপডেট: ২০২৩-০৬-১১ ০২:১৫:০৫
বিজিৎ দেব:
অনুশীলন, প্রজ্ঞা, সৃজনপ্রতিভা, বিচক্ষণতা, সততা, সার্বজনীন কল্যাণভাবনা, স্বার্থহীনতা, উদারমানবতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গুণের দ্বারা অনেক মনীষার নৈকট্য লাভ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সম্পাদিকা বিপ্লবী লীলা নাগ (১৯০০-১৯৭১)। এসবের প্রবেশদ্বার তাঁর পরিবার। তাঁর পরিবারের ত্যাগী মনন, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, শিক্ষাদীক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের গতি-প্রকৃতি ছিল পরিচ্ছন্ন। তাঁর পিতা গিরিশচন্দ্র নাগ একটি পরিবারের সন্তান। কিন্তু তাঁর আকাঙ্ক্ষার ছিল উচ্চাঙ্গ এবং মানবকল্যাণমুখি। অসীম সন্ধানে নিজেকে ব্যাপ্ত করেছিলেন দেশ-সমাজের মানুষের পক্ষে।
গিরিশচন্দ্র নাগ শ্রীহট্টের রাজনগরের ঐতিহাসিক গ্রাম পাঁচগাঁও-এ জন্মগ্রহণ করেন। একটি মফস্বল পরিবারে জন্ম নিয়েও সমগ্র ভারতবর্ষের মৌলিক বিন্যাসে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল গিরিশচন্দ্র নাগের পরিবার। ত্যাগ আর মনুষ্যত্বের অপরিসীম চিন্তনপ্রক্রিয়ার জন্যই ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিনে তাঁরা চুলোয় আগুন বসাননি। তাঁদের পরিবারের সকল সদস্যগণ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন।
মেধাবী, জেদি এবং জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র নাগ প্রথমে কটক র্যাভেশন কলেজে দর্শনের অধ্যাপনা পদে যোগদান করেন। আইন ব্যবসাও করেন। পরে আসামের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। সিভিল সার্ভিসে থাকাকালীন কোনও আপোষ করেননি ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে। এরজন্য তাঁকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হতে হয়েছে। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে অবসর নেন। তখন পুরোদমে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে আদর্শিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এবং সমাজসেবায় নিয়োজিত থেকে সমগ্র জীবনকে দেশের কাছে বিলিয়ে দেন।
গবেষক দীপঙ্কর মোহান্ত তাঁর লীলা রায় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পাঁচগাঁও থেকে বালাগঞ্জ রাস্তাটি গিরিশচন্দ্র নাগ করেছিলেন। পাঁচগাঁও-এ এখনও তাঁর ঐতিহ্যিক বাড়ি বেদখলে আছে। তবুও নীরব সাক্ষী দিচ্ছে এই বাড়ির প্রতিটি অঙ্গন; এই বাড়ি যে বিপ্লবীর এবং দেশযোদ্ধাদের আস্তানা ছিল। লীলা নাগের মাতা কুজ্ঞলতা দেবী চৌধুরী বিয়ের পরে হন কুজ্ঞলতা নাগ অত্যন্ত মেধাবী এবং ত্যাগী। কুজ্ঞলতার বাবার বাড়ি ছিল গোলাপগঞ্জে। কুজ্ঞলতার মা ওইসময়ে সমগ্র ভারতবর্ষের মেধাবৃত্তি পরীক্ষায় পান তৃতীয় স্থান। সে-হিসেবে লীলা নাগ পিতৃকুল ও মাতৃকুলের উত্তরাধিকার বহন করে সমগ্র ভারতবর্ষকে আলোকিত করেছেন। এ-আলো এখনও আমাদের নারী সমাজ তথা সবার জন্য বাতিঘর।
বিশ শতাব্দের সূচনালগ্নে লীলা নাগের আবির্ভাব সমগ্র ভারতবাসীর জন্য আশীর্বাদের বার্তা ছিল। বিশেষত অবহেলিত, নিগৃহীত ও নির্যাতিত নারী সমাজের জন্য লীলা নাগ ক্ষণজন্মা। এই মহীয়সী নারী ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন আমাদের গোয়ালপাড়া শহরে। তাঁর পিতা তখন গোয়ালপাড়া মহকুমার এস.ডি.ও। প্রাথমিক শিক্ষা ১৯০৭-১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কলিকাতার ব্রাহ্মস্কুলে। স্কুল শিক্ষা ১৯১১-১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকার ইডেন গার্লস স্কুল। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১ম বিভাগে বৃত্তিসহ পাশ করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বেথুন কলেজ থেকে মাধ্যমিক আর্টসের ছাত্র হিসেবে ১ম বিভাগে বৃত্তিসহ পাশ করেন। বি.এ সম্মান ইংরেজি বিষয়ে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন বৃত্তিসহ। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হন। উল্লেখ থাকে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওইসময়ে মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্র ছিল না। লীলা নাগের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেয়েদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন। আর লীলা নাগ হলেন এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। ইংরেজিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ২য় শ্রেণিতে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীসংঘের প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক-বিপ্লবী অনিল রায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পিতা-মাতার অনুরোধে বিয়েতে রাজি হন তিনি। কিন্তু তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। কারণ বিপ্লব-রাজনীতি আর কারাবাসের মধ্যেই তাদের বিপ্লবময় বর্ণালি জীবন অতিবাহিত হয়েছিল।
লীলা নাগ পরিবার থেকে সবকিছুর যোগান পেয়েছিলেন। যা তাঁর কর্ম-সৃজনে পথপ্রদর্শক । আদর্শিক বলয়ের সম্মুখে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দুর্বার, গতিময় এবং স্বচ্ছ। এজন্য অনেক বাধার সম্মুখে পতিত হয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সাফল্যের দ্বার তাঁকে বঞ্চিত করেনি। যখনই বিপদে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষ বসু, পিতা গিরিশচন্দ্র নাগ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, স্বামী অনীল রায়সহ অনেক মনীষার আদর্শকে সামনে রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হওয়া গৌরব ও সম্মানের। লীলা নাগ রবীন্দ্রনাথের স্নেহটুকু অর্জন করেছেন স্বীয় কর্মগুণে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিমোহনা থেকে সঞ্চয় করেছেন স্থৈর্য ও ধৈর্যগুণ। স্বভূমে শিকড় থাকবে কিন্তু শাখা-প্রশাখা প্রলম্বিত হবে পৃথিবীর মানচিত্রে। এই শিক্ষা অবশ্যই প্রেরণার অকুস্থল। লীলা নাগ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা জয়শ্রীতে ‘‘আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ’’ শিরোনামে তাঁর রবীন্দ্রচিন্তার সারবত্তা তুলে ধরেছেন।
কারাবাসের জীবন লীলা নাগের। জীবনের সিংহভাগ কেটেছে কারা-অভ্যন্তরে। এসব সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশ, নারী সমাজকে এগিয়ে নিতে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, মিছিল-মিটিং এবং সমাজপ্রগতির কাজে কোনও কমতি রাখেননি। তাঁর শ্রেষ্ঠ-কর্মের মধ্যে জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশ তাঁর কর্মজীবনকে দিয়েছিল মহাকালের কাছে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রয়াস। লীলা নাগ মানুষকে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাঙালি সংস্কৃতি, রাজনীতি,অর্থনীতি ও সমাজসেবায়। মানবসভ্যতার বিনির্মাণে তাঁর ভালোবাসার প্রকাশ অন্যরকমের । যা তাঁর বাণীতে প্রকাশ পায়। কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি উদ্দিষ্ট জনতাকে বলেছেন, ‘‘চির বিপ্লবীর জীবন চাই, মানুষকে ভালোবাসি, চিরদিন বেসেছি। আমার সকল কাজের উৎসাহ তাই; কিন্তু ভালোবাসা আমার বন্ধন নয়, প্রেরণা ও আনন্দ।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লীলা নাগ
প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ লীলা নাগকে বলেছিলেন, ‘‘লীলা আমাদের এনার মতো দেখতে’’। এই আন্তরিক অভিবাদন থেকে উপলব্ধি হয় লীলা নাগ কবিগুরুর কী পরিমাণ স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, লীলা নাগকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু লীলা নাগের পথ ছিল বৈপ্লবিক্য। বিপ্লবীদের জীবন, সেতো বিষের পেয়ালা। তাই তিনি প্রস্তাবনাকে বিনয়ের সঙ্গে নাকচ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দীপালী সংঘের মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথের গভীর সান্নিধ্য পেয়ে অধিকার অর্জন করেছিলেন।
‘দীপালী সংঘ’ (১৯২৩) এবং ‘দীপালী ছাত্রীসংঘ’ (১৯২৬) এই দুটি সংঘের প্রতিষ্ঠাতাআজীবন বিপ্লবী লীলা নাগ। বুদ্ধি-বিবেক-বিচক্ষণতা-আত্মনির্ভরশীল নারীসমাজ গঠনই ছিল এ-সংঘের প্রধান উদ্দেশ্য। নারীমুক্তি ও দেশাত্মবোধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করার মানসপ্রক্রিয়া থেকে দীপালী সংঘ কাজ করে গিয়েছিল। সংঘের ছাত্রীদের নিয়ে স্টাডি সার্কেল তৈরি করেন। এঁদের পরাধীন ভারতবর্ষের গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণ পাঠ্যবই পড়তে দেন। যখন ব্রিটিশ সরকার দীপালী সংঘের কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন সাদারল্যান্ডের ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ বইটি ছাত্রীদের পড়তে দিয়ে। ওইসময় সবদিক দিয়ে অরাজকতা, বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন চলছিল। ব্রিটিশ তাবেদার বাহিনী আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাংলার নিরাপদ মাটিতে গেঁথে দেয় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প। লীলা নাগের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে তখন ঢাকায় ‘ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ; লীলা নাগ তথা বাঙালি জীবন মাহেন্দ্রক্ষণে সমবেত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভাগমন সবাইকে প্রাণের স্পন্দনে শিহরিত করে এবং উচ্ছ্বাসভরা পরিবেশে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়। লীলা নাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কবিকে দীপালী সংঘের পক্ষ থেকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি দীপালী সংঘের অভিনন্দনের জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘‘এশিয়ায় এতো বড় মহিলা সমাবেশ আর কখনও দেখি নাই।’’ ড. রঙ্গলাল সেন তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে ‘‘প্রবাসী পত্রিকায় এই মহতী সভার উল্লেখ করে লেখা হয়: কবি (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) অতিশয় প্রীত হন এবং বলেন, তিনি অন্য কোথাও একত্র সমাবিষ্ট এতো মহিলার অভিনন্দন পান নাই।’’ লীলা নাগের ওপর রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ দ্রুত জমতে থাকে পান্থজনের সখা হিশেবে।
দীপালী সংঘের মাধ্যমে বয়স্কশিক্ষা স্কুল, অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, কারিগরি স্কুল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও লীলা নাগ বিপ্লব নারী সমাজের মুখপত্র হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন লিখেছেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকার নামকরণ করেন জয়শ্রী। নন্দলাল বসু একটি স্কেচও জয়শ্রীর জন্য পাঠান। জয়শ্রী পত্রিকার মাধ্যমে লীলা নাগ সৃজনশীল মানসী হিশেবে রবীন্দ্রনাথের নিকট পরম-আত্মীয় হয়ে ওঠেন। ঢাকা থেকে লীলা নাগের সম্পাদনায় ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় জয়শ্রী পত্রিকা। পত্রিকা প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ হন। সঙ্গে সহ-সম্পাদিকা রেণু সেনসহ আরও কয়েকজন কারারুদ্ধ হন। কিন্তু তাঁর সহকর্মীরা পত্রিকা প্রকাশ করা থেকে বিরত হননি। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভয়মন্ত্র পাঠালেন জয়শ্রী ও লীলা নাগের জন্য। এই অভয়মন্ত্রটি হলো-
‘‘বিজয়িনী নাই তব ভয়
দুঃখে ও বাধায় তব জয়।
অন্যায়ে অপমান
সম্মান করিবে দান
জয়শ্রীর এই পরিচয়।’’
একসময় জয়শ্রী পত্রিকা ব্রিটিশের রোষানলে পড়ে এবং পত্রিকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে লীলা নাগ এবং তাঁর সহকর্মী জেল থেকে মুক্তি লাভ করলে আবার জয়শ্রী পত্রিকা প্রকাশ করেন লীলা নাগ। তখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লীলা নাগকে অভয়বাণী পাঠালেন। যা লীলা নাগের জন্য পরম প্রাপ্তি। আর এ প্রাপ্তি তাঁর একার না, তা হয়ে গেল জয়শ্রী পরিবারের এবং বাংলার স্বাধীনতাপিয়াসী জনগণের। লীলা নাগের কারামুক্তি উপলক্ষে কবিগুরু চিঠি লেখেন তাঁকে, ‘‘কারাবাস থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে তুমি বেরিয়ে এসেছো শুনে আরাম বোধ করলুম। মানুষের হিংস্র বর্বরতার অভিজ্ঞতা তুমি পেয়েছো। আশাকরি এর একটা মূল্য আছে, এটা তোমার কল্যাণসাধনাকে আরও বল দিবে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করে পাশব বলে মনুষ্যত্বকে চিরকালের মতো পিষ্টকরে দেবে, কিন্তু মনুষ্যত্বের মহিমার জোরেই সেটা সত্য না হোক। পশুশক্তির ঊর্ধ্বে জয়ী হউক তোমার আত্মার শক্তি।’’
সত্যিকার অর্থেই লীলা নাগ নিজেকে ব্যাপ্ত করেছিলেন কল্যাণসাধনায়। একে একে নারীদের শিক্ষাবিস্তারে গড়ে তোলে ছিলেন স্কুল এবং কলেজ। নারীমুক্তি, স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা, আত্মআবিষ্কার-আত্মনির্ভরশীলতা এবং সমাজপ্রগতির অবিচ্ছিন্ন ধারা; এই সপ্তসিঁড়ির চারিত্রিক গুণাবলীর বৈচিত্র্যক বৈজয়ন্ত লীলা নাগের সমস্ত দেহে এবং মনে আজীবন গ্রথিত ছিল। কারাবাস এবং নির্যাতন তাঁর আদর্শিক স্থৈথধার কারণে তাঁকে উদ্দিষ্ট পথ থেকে বিচলিত করেনি। পশুত্বের বৈরি হাওয়াকে উড়িয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করলেন গানে জীবনে যৌবনে। প্রাণের বাসনাকে রোধ করতে পারে, যদি মর্মে থাকে মর্তবাঁশির অগ্নিসুর।
রবীন্দ্রনাথ লীলা নাগের বৈপ্লবিক জীবনে সাহস আর নান্দনিক চেতনার উৎস। লীলা নাগকে দেওয়া কবিগুরুর আশীর্বাদ থেকেই বোঝা যায়-
মান অপমান উপেক্ষা করি দাঁড়াও,
কণ্ঠক পথ অকুণ্ঠ পদে মাড়াও,
ছিন্ন পতাকা ধূলি হতে লও তুলি
রুদ্রের তাতে লাভ করো শেষ বর
আনন্দ হোক দুঃখের সহচর
নিঃশেষ ত্যাগে আপনারে যাও ভুলি।
জয়শ্রী বারবার ব্রিটিশের রোষানলে পড়ে। কিন্তু তাতে লীলা নাগের রুদ্রতা নেভে যায়নি, রুদ্রওম আরও দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হতে থাকে। ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে পুনর্জন্ম নিয়েছে। কাটা থাকবে তাই বলে কি মাড়াবো না। জয়শ্রীর কর্ণধার সেই কাজটুকুই করলেন। ‘ছিন্ন পতাকা ধূলি হতে লও তুলি’ জয়শ্রীর কথাই রবীন্দ্রনাথ সজোরে বলেছেন। তিনি জানতেন যে, লীলা নাগ সকল বাধাকে উপেক্ষা করে নবযৌবনে সারথি। নৈর্ব্যক্তিক বাসনাই তাঁর চিরন্তন উৎসভূমি। লীলা নাগের জন্য রবীন্দ্রনাথ যে-সমস্ত চেতনা দান করেছিলেন এর ঋণ পরিশোধেও তিনি সফল হয়েছেন তাঁরই স্বীয় কর্তব্য পালনে এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনপূর্বক চিন্তা- চেতনায় আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ শিরোনামায় প্রবন্ধ লিখে। যা জয়শ্রী পত্রিকায় পত্রস্থ হয়। লীলা নাগ তথা তাঁর সহযোদ্ধাদের জন্য এই আশীর্বচন গৌরবের। শুধু গৌরব নয় গতিবাদেরও উৎস। বিজয়িনী লীলা নাগসহ তাঁর সহযোদ্ধারা পেয়েছিলেন অগ্নিশিখা। এই শিখা দিয়েই সামনের অন্ধকার দূর করার পূর্ণ শক্তি পেয়েছিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ লীলা নাগকে বিজয়িনী উপাধি দিয়ে লীলা নাগ এবং জয়শ্রীর অগ্রযাত্রাকে শত সহস্র মাইল এগিয়ে নিলেন। একদিকে রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতাকামী উদারচিত্ত অপরপক্ষে লীলা নাগের দৃঢ়তা দুটি মিলে একাকার হয়েছে জয়শ্রীর অভিযাত্রা।
আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ ও লীলা নাগের রবীন্দ্রযাপন
লীলা নাগ নিজের মান-সম্মান খ্যাতির স্পর্শে কখনও বিহ্বলিত হননি। কৈশোর বয়সে নিজের জন্মদিন পালন করতে দেননি, বরং অনেক তাত্ত্বিক ও দার্শনিক কথা-বার্তা জমা হয়েছিল পিতা-কন্যার মননঝুলিতে। এই কথন হলো, ‘‘জান বাবা, আজকাল আমার জন্মদিনে সুখের পরিবর্তে ভয়ানক দুঃখ হয়। ...আমার মনে কত ভালো কাজ করার ইচ্ছা হয় কিন্তু কোরতে পারি না বলে মনে হয় সময় সময়, যে ঐসব সৎ ইচ্ছা মনে জাগলেই ভালো ছিল। আমার ক্ষুদ্র শক্তি যদি একটি লোকেরও উপকার করতে পারত তবে নিজেকে ধন্য মনে করতুম। সত্যি বলছি এ আমার বক্তৃতা নয়, এটা আমার প্রাণের কথা।...আমার উদ্দেশ্য নয় পৃথিবীতে লোকের প্রিয় হওয়া, কিন্তু পৃথিবীতে খাঁটি হওয়া। খাঁটি হয়েও যদি প্রিয় হতে পারি তো কথাই নেই।’’ লীলা নাগ নিজের আত্মজীবনী লিখেননি সহযোদ্ধাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও। লীলা নাগ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে চিন্তা-চেতনার আদান-প্রদান এবং এর বিস্ফোরিত প্রকাশের অভিযাত্রার অভিনবত্ব উপলব্ধি করা যায় লীলা নাগের লেখা ‘‘আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ’’ রচনায়।
একটিমাত্র প্রবন্ধে রবীন্দ্র-সারবত্তাকে তুলে ধরেছেন। এতে তাঁর চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেক- বৈরাগ্য ও সুন্দরের সাধনার স্তর বৈচিত্র্যভুবনে আত্মপ্রকাশ করেছে। সৃষ্টি নিয়ত সুন্দরের খেলায় মত্ত, কিন্তু সুন্দরের আহ্বান যে সামষ্টিক কল্যাণবোধে প্রতিষ্ঠিত এই বোধটুকু রবীন্দ্রনাথের মানুষী মনন ও সাহিত্যসৃজন থেকে উপলব্ধি করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর জীবনের প্রথম ধাপ থেকে শেষবিকেল পর্যন্ত কাছে রেখেছেন, তাতে পেয়েছেন উত্তাপ, পথ-চলার সঞ্চয়, অনিন্দ্যসুন্দর হওয়ার প্রত্যয়, যৌবনের বিশালতা আর ত্যাগের মহিমা। জীবন বলতে সাধনা চাই, সে সাধনা কীভাবে হবে, রবীন্দ্রনাথ লীলার জীবনে দিয়েছেন সেই কর্মপন্থা আর সামনে এগুবার মহামন্ত্র। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গিয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা প্রকাশ করেও নিজেকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তুলেছেন। এ তার বিশাল মহত্ব। তিনি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের করে এ আলোচনা নয়, কারণ তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগের সূত্র একান্তই আকস্মিক এবং সংকীর্ণ। সাহিত্য আমার পেশা বা নেশা কোনটাই নয়।[...] কাজেই বাংলার কোনো সাহিত্যিকলমে রবীন্দ্র-তর্পণও এ নয়। সে তর্পণের প্রাচুর্য, বৈচিত্র্য ও বৈদগ্ধ আগামী কয়েকদিনে পত্র-পত্রিকা, স্যুভেনীরে প্রকাশ করবে। আমার দাবি আরও সার্বজনীন। বিগত শতাব্দীর না হোক, অন্ততপক্ষে বিগত অর্ধ-শতাব্দীর শিক্ষিত বাঙালিদের একজন হিসেবে, আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্তি স্বীকারের সামান্য এ প্রয়াস।’’ সত্যিকার অর্থেই লীলা নাগ রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লীলা নাগের যুগে যেমন ছিলেন আজও সমভাবে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর চিন্তা- চেতনার খোরাক। তিনি উপলব্ধি করে বলেছেন যে ‘‘[...] এ যুগের প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির ললাটে জন্মক্ষণেই অঙ্কিত হয়েছে রবীন্দ্র-যুগের টিকা।’’
রবীন্দ্রনাথের কথা-কবিতা-গান মন্ত্রপূত। এ যেন অশরীরী আত্মার এক মহা-উদ্ভাসন। তা জগৎ ভুলায় না, নিয়ে যায় শক্তি সম্ভাবনার নিষ্কণ্টক পথে। তাঁরা ছাত্রাবস্থায় পারিবারিক সম্মিলিত প্রার্থনাঘরে রবীন্দ্রনাথের তেজদীপ্ত মোহনীয় গানকে নিজের জন্য পরমের পথে আবিষ্কার করতেন। এ পরম সংগ্রাম আর পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মহামুক্তির অমিয় বাণীসুধা। রবীন্দ্র-প্রসাদ সিঞ্চনে দেহ-মনকে করতেন পরিশুদ্ধ। নিজের সুখের পরিবর্তে দেশ-দশের বেদনা-জরা-দুঃখকে নিজের করে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের সংগীত নিয়ে লীলা নাগের মন্তব্য সংক্ষিপ্ত ও সরল কিন্তু তা সমগ্রতাস্পর্শী। তাঁর অমিয় মন্তব্য হলো, ‘‘লক্ষ উপদেশাবলি যা করতে পারত কিনা সন্দেহ, রবীন্দ্র সংগীতের ভাব ভাষা ও সুর অতি সহজে স্বাভাবিকভাবে তা করেছে। কেবলই কি তিনি কবি! জীবনের সকল সৌন্দর্যানুভূতি, গভীর বেদনাবোধ, ক্ষমতাবানের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠিন শপথ, দেশাত্মবোধের সর্বস্বপণ-করা প্রেরণা, কি না পেয়েছি তাঁর নিকট!’’
লীলা নাগ রবীন্দ্রনাথকে নক্ষত্র-সূর্য-চাঁদ-তারা এবং পৃথিবীর চির চেনা আলো-বাতাসের মধ্যেই দেখেছেন। অনন্ত জিজ্ঞাসা আর অন্তহীন ধ্বনিকে আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্র-নামক মহাপৃথিবী থেকে। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি সাহিত্যিক গীতিকার নন, বাঙালির অধিকার আদায়ের স্বৈর্বব আন্দোলনেও যে তার সরব উপস্থিতি ছিল তা লীলা নাগ তাঁর প্রবন্ধে সুন্দর করে বিধৃত করেছেন। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ানবাগের পৈশাচিক অত্যাচারের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নাইট পদবি পরিত্যাগ করেছেন, সভ্যতার সংকটের কথা তুলে ধরেছেন লীলা নাগ তাঁর প্রবন্ধে। প্রচুর পাঠ-অনুশীলন ছিল লীলা নাগের। তাঁর বিচিত্র কথা-ভঙ্গি থেকে তা উপলব্ধ হয়। ১৯৩১ সালে হিজলী বন্দি-নিবাসে নিরস্ত্র আটক বন্দিদের গুলি করে হত্যা করা হয়, জাতীয় পতাকা তোলার অপরাধে। এর প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে সভার আয়োজন করা হয়। কবি সভাপতিত্ব করেছিলেন সেখানে। তিনি হল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বক্তৃতা করেন। কবি তখন এই পশুত্বের বিরুদ্ধে, কাপুরুতার বিরুদ্ধে ভাষণ দেন। এই ভাষণের বদৌলতে লীলা নাগ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন ‘‘যে কবির প্রতিভা তাকে গজদন্ত প্রসাদে বসে মধুর বীণাদানে নিযুক্ত রাখেনি কিন্তু মনুষ্যত্বের সকল অপমান-লাঞ্ছনার ক্ষণে নিজের আশ্চর্য সুকুমার অনুভূতি দিয়ে বারে বারে জাতির চিত্তকে স্পর্শ করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে, বিচিত্র চিন্তাকে সংহত রূপ দিয়েছে সে কবির ঋণ শোধ আমরা করবো কীভাবে?’’
লীলা নাগের ভাষাবোধ এবং চিন্তনপ্রক্রিয়ার সারাৎসার আমাদের মোহনীয় করে তোলে। যদি লিখতেন খুব বড় মাপের তত্ত্ব-সাহিত্যিক হতে পারতেন। ‘আমাদের রবীন্দ্রতর্পণ’ প্রবন্ধটি কবিগুরুর প্রয়াণের পর একটি ভাষণের প্রতিলিপি। যা জয়শ্রীতে পত্রস্থ হয়েছিল।
লীলা নাগ বিশ-শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত। তাঁর মাধ্যমেই বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন। অনেক বীরকন্যাকে তিনি স্বাধীনতা এবং নারীজাগরণের মন্ত্রে প্রস্তুত করেছিলেন। আজ সময়ের দাবি, লীলা নাগের পৈতৃক ভিটা উদ্ধার করার। তাঁর স্মৃতি ও কর্মকে নবীন-প্রবীণে সামনে তুলে ধরা। তাঁর মায়ের নামে পাঁচগাঁও-এ ‘‘কুঞ্জলতা প্রাথমিক স্কুল’’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিদ্যাপীঠ এখনও আলো দিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবীর আড়ালে লীলা নাগের সাহিত্যিক প্রতিভা আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আশা করব যে, তাঁর সমগ্র কর্মসম্ভার গবেষক-শুভানুধ্যায়ীরা তুলে আনবেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন তিনি এই নশ্বর দেহ রাখেন কলকাতায়। তাঁর দুঃখও ছিল, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে নতুন ভোর আর নতুন আলোর সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটলো, পিতার ভূমি, তাঁর লালিত দেশ তাঁকে থাকতে দিল না। চলে গেলেন অভিমান নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে। অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন ঢাকায়। এর নাম গন্ধও আজ আর নেই। মনে সংশয় জাগে জাতি হিসেবে কি আমরা কৃপণ আর অকৃতজ্ঞ! তা না হলে বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে এই দেশের কতিপয় কুচক্রীরা হত্যা করতে পারে? এটা কি বংশগতিবিদ্যার সূত্র। প্রশ্ন রইলো আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্বের নিকট।
দায় স্বীকার: অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন; অধ্যাপক ড. অজয় রায়; সম্পাদিকা ও সভানেত্রী উমা দেবী; অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল খালিক; কথাসাহিত্যিক আকমল হোসেন নিপু; জেলা শিল্পকলা একাডেমি, মৌলভীবাজার; লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদ, পাঁচগাঁও, রাজনগর; জয়শ্রী।
সহায়ক-গ্রন্থ:
দীপঙ্কর মোহান্ত। লীলা রায় ও বাংলার নারী জাগরণ। সাহিত্য প্রকাশ। ১৯৯৯। ঢাকা;
লীলা নাগ : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সম্পা. অজয় রায়, আনিসুজ্জামান, রঙ্গলাল সেন, মাহফুজা খানম, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক ও বিপ্লবী লীলা নাগ জন্মশতবার্ষিক উদযাপন পরিষদ। সাহিত্য প্রকাশ। জানুয়ারি ২০০৩। ঢাকা;
বিজিৎ দেব। লীলা নাগ। মদনমোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদ। ২০১৮। সিলেট।
আপনার মন্তব্য