ছোটগল্পে সার্বজনীন রবীন্দ্রনাথ

 প্রকাশিত: ২০১৮-০৫-০৮ ০০:১৭:২৬

 আপডেট: ২০১৮-০৫-০৮ ০০:২১:০৭

সুকান্ত পার্থিব:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) ‘বেতাল পঞ্চবংশতি’ (১৮৪৭) নামে অনূদিত গ্রন্থটির ঘটনা উপস্থাপনায় প্রথম গল্পরসের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বাংলা সাহিত্য প্রথম ছোটগল্পের আভাস পেয়েছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪) ও ‘রাধারাণী’ (১৮৭৫) গল্পে। পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৪-১৮৮৯) ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘দামিনী’ প্রভৃতির মধ্যেও ছোটগল্পের একটা আভাস পাওয়া গিয়েছিল। তবে সাহিত্যকাঠামোর বিভিন্ন রূপের দৃষ্টিকোণ থেকে এর সবগুলিই ছিল উপন্যাসধর্মী রচনা। পরে স্বতন্ত্র প্রতিভা স্পর্শে ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯)। তাঁর ভূত ও মানুষ, মুক্তামালা, মজার গল্প ও ডমরুচরিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে ছোটগল্পের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া হয়। তবে তাঁর রচনায় উদ্ভট কাহিনীই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। স্বর্ণকুমারী দেবীর (১৮৫৫-১৯৩২) নবকাহিনী গ্রন্থের কোনো কোনো গল্পেও ছোটগল্প রচনার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের আর একজন গল্পকার হলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৬১-১৯৪০)। তিনি প্রেম ও রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে ছোটগল্পে বিশেষত্ব দান করেন।

প্রকৃত অর্থে বাংলা সাহিত্যের সার্থক ছোটগল্পকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে, ১৮৬১-৭ আগস্ট, ১৯৪১)। তাঁর প্রথম গল্প ‘ভিখারিনী’ ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) গল্পটিই প্রথম সার্থক ছোটগল্প হিসেবে বিবেচিত হয় বাংলা সাহিত্যমহলে। ১৮৮৪-৮৫ সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই তিনজনের সাহিত্যকর্মেই প্রভাব ছিল সংস্কৃত ভাষার। সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে বাংলা ছোটগল্পের বন্ধ দরজা খুলে দিলেন দৃপ্ত প্রয়াসে। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই তিনি করলেন অবাধ বিচরণ।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মহৎ সাহিত্যিক হিসেবে প্রায় সব গুণই ধারণ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তার উদার ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি যেকোনো পাঠককে দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে এক বিস্তৃত ও ধ্রুপদী উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়। তাই দ্বিধাহীনভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার ভেতর বাঙালির শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই আকাশের রবির মতো উজ্জ্বল। বাঙালির চিরায়ত নিদর্শনে ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আপাদমস্তক মানবতাবাদী সাহিত্যিক। তাঁর সৃষ্টিকর্মে তিনি মানুষের জীবনজগতকে ফুটে তুলেছিলেন বাস্তবতার নিরিখে। তাঁর চারপাশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, সুখ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, প্রকৃতি-পরিবেশ, জীবনাচরণকে নিজে গভীরভাবে উপলব্ধি করে ঠাঁই দিয়েছিলেন নিজের সাহিত্যভাষায় বিশেষভাবে ছোটগল্পে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পা রেখেছিল বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে। ছোটগল্পকে তিনি করে তুলেছিলেন গণমুখী। আমরা তাঁর ছোটগল্পে যে সামাজিক বাস্তবতার উপস্থাপন দেখতে পাই, সেটা রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্যান্য ধারা থেকে আলাদা। বিশ্বসাহিত্যের যে কয়জন শ্রেষ্ঠ গল্পকার রয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

গ্রাম্যবধূ যেমন সুনিপুণ যত্ন-দক্ষতায় অধীর আগ্রহ ও ধৈর্যে অমলিন কাপড়ে সুঁইয়ের ফোঁড়ে-ফোঁড়ে স্বপ্নের মণিকোঠায় গেঁথে তোলে নকশি কাঁথা, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় সযতনে আপন মহিমা আর প্রতিভায় বিচরণ করে গেছেন। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্য কেবল স্বভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই আমাদের সাহিত্য বিশ্বজনীন বা সার্বজনীন হয়ে ওঠে ক্রমশ। বাঙালি জাতি ব্যক্ত করতে থাকে বিশ্বজনীন হওয়ার দ্ব্যর্থ প্রয়াস।

বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের, অনুরূপভাবে বাংলা ছোটগল্পের সার্থক সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। এই সার্থকতা এতোটাই উচ্চমানের যে, কোনো কোনো সাহিত্য বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু ছোটগল্প সৃষ্টির জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখেন। মানবজাতির অভিন্ন অনুভূতি ও প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখেও স্বীকার করতে হবে, আমাদের জীবনাচার ও প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পাশ্চাত্যের ভাবনার রয়েছে যোজনব্যাপী দূরত্ব। তাই বালজাক, চেখভ অথবা মোপাসাঁর ছোটগল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথরচিত ছোটগল্পের তুলনা করতে গিয়ে অনেককে হিমশিম খেতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্পের অন্দরে-বাহিরে অবাক করা এক ভুবন তৈরি করে গেছেন যা কেবল বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের অমিতাভ বিভারূপে বিরাজমান। কবিতা, গান, উপন্যাসসহ নাটকের যে দখল, তার ছোটগল্প সেগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। সময় আর সভ্যতার প্রয়োজনে নয় বরং রবীন্দ্রনাথ নিছক প্রকৃতি আর প্রেমের বাস্তবিক রূপ প্রকাশের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি গল্প এবং যা পরবর্তীতে এক বিশাল মহীরূহরূপে বিরাজমান আমাদের সাহিত্য আসরে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীর অনেক চিঠিই এ মন্তব্যের স্বপক্ষ সমর্থন করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রসঙ্গে ছিন্নপত্রাবলীর ১৪৯ নম্বর পত্রে লিখেছিলেন- ‘পুরোনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তিমনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে। ঢাল চত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাঁড় করিয়েছিলুম, সেটা আমারই খেয়ালেরই খেলনা’। (পত্র-১৪৯; ছিন্নপত্রাবলী।)

গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্প সম্পর্কে সোনার তরী কাব্যের ‘বর্ষা যাপন’ কবিতায় বলেছেন- ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ছোটো ছোটো দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল/সহস্র বিস্মৃতি রাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/তারই দু’-চারটি অশ্রুজল’।

বাস্তবিক অর্থে তিনি জীবনের বহুবিধ রূপ বর্ণনার সার্থক শিল্পী, মানব মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর ছোটগল্পে সঠিক ধারার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। সাধারণ বাস্তবতা ও ব্যক্তি মানুষের অন্তঃবেদনার এক মনোরম বহিঃপ্রকাশ তাঁর ছোটগল্পে। একজন সার্থক শিল্পীর মতো জীবনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের অনুভূতির সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শিল্পিত করেছেন। বিশেষ করে নারীর চাওয়া-পাওয়া ভালোলাগা, মন্দলাগা, তথা মনোবিশ্লেষণে তিনি একজন দক্ষ শিল্পী। তাঁর ছোটগল্পের নারী চরিত্রগুলো আমাদের সদাজাগ্রত চিরচেনা জগতের বাসিন্দা, আমাদের একান্ত কাছের আপনজন। বাঙালি নারী সমাজের নিপীড়নের নানা চিত্র শিল্পিত রূপে প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে নারী জীবন, বাস্তবতার স্পর্শে মহিমান্বিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। গ্রাম্য বিধবা, গৃহবধূ, কুমারী, বাল্যবধূ, তরুণী প্রভৃতির সমাবেশ গল্পগুলো অবিসংবেদীরূপে প্রত্যক্ষধর্মী হয়ে উঠেছে। ‘দেনাপাওনা’র নিরূপমা, ‘মানভঞ্জন’র গিরিবালা, ‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া; ‘মাল্যদান’ গল্পের কুড়ানি; ‘সুভা’ গল্পের সুভা আমাদের সবার অতি পরিচিত নারী চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রত্যেকটি নারী চরিত্রই স্বমহিমায় ভাস্বর।

বাংলা সাহিত্যে বহু বিশেষণে বিশেষিত বাংলা ছোটগল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল বিষয় বাস্তব জীবন ও সমাজ সংসারের আলেখ্য। পল্লী গ্রামবাংলায় বেড়ে উঠা অতি সাধারণভাবে যেসব জনমানুষের চিত্র আঁকা হয়েছে, তাদের সবাইকে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে পাঠক অবলীলায় মেনে নেয়। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লেখা শুরু করেন ১২৯৮ বাংলা সালে। তখন থেকে ১৩১০ সনের মধ্যে তাঁর বেশিরভাগ গল্প রচিত। তাঁর একটি বিখ্যাত গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকে তিনি জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়েছেন। তাঁর দিন কেটেছে পদ্মার উপরে নৌকায় ভেসে ভেসে শাহজাদপুর ও শিলাইদহে। আনন্দময় বৈচিত্র্যে ভরপুর এ সময়ের জীবনযাত্রা। তিনি পদ্মাবোটে চড়ে পাড়ি জমিয়েছেন আত্রাই, বড়াল, নাগর, করতোয়া, পদ্মা আর যমুনায়। তাঁর ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিপত্রে শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর ও পতিসরে যাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।

‘বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মা থেকে কোলের ইছামতিতে, ইছামতি থেকে বড়ালে, হুড়ো সাগরে, চলনবিলে, আত্রাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সাজাদপুরে’। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখতে মাঝে মধ্যেই নওগাঁর পতিসর আসতেন। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এ জমিদারি কিনেছিলেন ১৮৩০ সালে। সেই জমিদারি দেখাশোনার জন্যেই ১৮৯১ সালে কবিগুরু প্রথম আসেন পতিসরে।১৮৯১ থেকে ১৯০১ -প্রায় একনাগাড়ে তিনি থেকেছেন পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার নির্জন প্রান্ত, নদী তীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুচর, অবারিত সবুজ মাঠ, ছায়া সুনিবিড় গ্রামে সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, অভাবক্লিষ্ট অথচ শান্ত-সহিষ্ণু গ্রামবাসী কবি হৃদয় বিমুগ্ধ বিস্ময়ে, পুলকে, শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে এসবের অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করেছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। পল্লীজীবনের নানা বেদনা আর আনন্দ যখন তাঁর মনকে অধিকার করে বসলো, তখন তাঁর ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনা-আপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে শুরু করলো।

১৮৯৪ সালের ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোটছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লিখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আবার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধঘরের সঙ্কীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াব’।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, দিনাতিপাত ও সাধারণের জীবনদর্শনকে কাজে লাগিয়ে তুলে ধরা যাবে পুরো সমাজচিত্র এবং এর মাধ্যমেই সমৃদ্ধ হবে গোটা বাংলা সাহিত্য। যদিও পদ্মা বোটে, পাবনার শাহজাদপুর ও নওগাঁর পতিসরে জমিদারি তদারকির সুবাদেই রবীন্দ্রনাথের গল্পে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের উঁচু স্তর থেকে পুরোপুরি নিচুস্তরের মানুষের কথা, আচার-ব্যবহার-সংস্কৃতি আর নির্বিকার শুদ্ধ জীবনাচার। তাঁর পুরো সাহিত্য জীবনকে বিশ্লেষণ করলে ছোটগল্পের সময়টুকু যে খুব বড় তা নয় বরং ব্যাপক বর্ণাঢ্য ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গিমার সার্থক উপমা। তাঁর গল্পের অধিকাংশ ঘটনা ও চরিত্র বাস্তব এবং কেবলমাত্র ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো এসব চরিত্রের প্রকাশ। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটিও প্রণিধান আবশ্যক, ‘এগুলি নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তাতো করিনি আমি’। (-রবীন্দ্রনাথের উক্তি, আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ)

রবীন্দ্রনাথের গল্পে অবলীলায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতি। তাঁর জীবনে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ছোটগল্পের চরিত্রগুলোও কী বিচিত্র! অধ্যাপক, উকিল, এজেন্ট, কবিরাজ, কাবুলিওয়ালা, কায়স্থ, কুলীন, খানসামা, খালাসি, কৈবর্ত, গণক, গোমস্তা, গোয়ালা, খাসিয়াড়া, চাষি, জেলে, তাঁতি, নাপিত, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগা, দালাল পণ্ডিতমশাই, নায়েব, ডাক্তার, মেথর, মেছুনি, মুটে, মুদি, মুন্সেফ, যোগী, রায়বাহাদুর, সিপাহী, বাউল, বেদে প্রমুখ। তাঁর গল্পের পুরুষ চরিত্র ছাড়া নারী চরিত্র অধিকতর উজ্জ্বল।

বিভিন্ন গল্পের চরিত্রের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একসময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে’।

সত্যিকার অর্থেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনাচারের সামগ্রিক উপমার সবিশেষ ফলাফল পেয়েছিলেন নিজেকে জমিদারিতে নিযুক্ত করে। ছোটগল্প লেখা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কেই করে গেছেন সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি, ‘আমি প্রথমে কেবল কবিতাই লিখতুম, গল্পে-টল্পে বড় হাত দিই নাই’।মাঝে একদিন বাবা ডেকে বললেন, ‘তোমাকে জমিদারির বিষয়কর্ম দেখতে হবে’। আমি তো অবাক; আমি কবি মানুষ, পদ্য-টদ্য লিখি, আমি এসবের কী বুঝি? কিন্তু বাবা বললেন, ‘তা হবে না, তোমাকে এ কাজ করতে হবে। ‘কী করি? বাবার হুকুম, কাজেই বেরুতে হলো। এই জমিদারি দেখা উপলক্ষে নানা রকমের লোকের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় এবং এ থেকেই আমার গল্প লেখারও শুরু হয়’।

কেবল ছোটগল্প সৃষ্টিই নয় বরং তিনি তৎকালীন সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসী ও বিশ্বসাহিত্যকর্মীদের সামনে। আরও একটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর গল্পে, সেটিকে ভাষাশৈলীর চরম উৎকর্ষতা বললে ভুল হবে না- সেটি প্রকাশ ভঙ্গিমা। তাঁর গল্পগুচ্ছের সর্বমোট ১১৯টি গল্পের প্রকাশ ভঙ্গিমা ব্যতিক্রমধর্মী। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ যে কথা কবিতায়, গানে প্রকাশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যে কথা তিনি সাধারণ, সাবলীল ভাষায় বলতে পারেননি তাই ব্যক্ত করেছেন গল্পে। তারপরও জীবনাচার, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে না গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ছোটগল্পের মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি নিজেই সারথি ও নিজেই অর্জুন।

প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ, জীবনের আপাততুচ্ছ ব্যাপারকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় হিসেবে অনুভব করা, এসবের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, নিজেকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করে দিয়ে একমনে জীবনকে প্রকৃতির সব অভিব্যক্তির মধ্যে উপভোগ করা- এসবই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজনীনভাবে আমৃত্যু গভীরভাবে ধ্যান-জ্ঞান বিলিয়ে দেওয়ার সাধনায় নিমিত্ত থেকে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কখনও তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কবিতায়, মানুষের জীবনের শোকগাথাকে তুলে ধরেছেন ছোটগল্প-উপন্যাসে, কখনও বিজয়মুকুটে আসীন হয়েছেন সঙ্গীতের মূর্ছনায়। মানবসত্তাকে বিশ্বপ্রকৃতির কাছে প্রকাশ করতে, বিশেষভাবে বাঙালিকে শেখাতে চেয়েছিলেন- সার্বজনীন হয়ে বিশ্বমানবতার পথে হাঁটতে। তাই রবীন্দ্রনাথ তার মহৎ সাহিত্যকর্মের জন্যই মানুষের কাছে বাঙালির পাঠকের কাছে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বাংলা, বাংলা সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথ একই সত্তা। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার পরিপূর্ণতা অর্জন কখনই সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যিক আশ্রয়। আমাদের জাতিসত্তার শেকড়ে প্রোথিত যে মূল মর্মবাণী তার পুরোটা জুড়েই কেবল রবীন্দ্রনাথ।

আপনার মন্তব্য