ধারাবাহিক উপন্যাস: পিঞ্জিরা

 প্রকাশিত: ২০২৫-১২-০২ ০১:৪১:১৭

রিপন ঘোষ:

ধারাবাহিক উপন্যাস: পিঞ্জিরা
পর্ব-১: আঁধার রাতের অশ্বারোহী

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষ। গত তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি একটু কমেছে। আকাশও পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। মেঘ সরে গিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে প্রায় গোল একটা চাঁদ। আর দু-একদিনের মধ্যেই গুরু পূর্ণিমা, তাই চাঁদের অবয়ব বিশাল।

ভরা বর্ষায় জলের স্পর্শ পেয়ে হাওরের শুকনো জমি রূপ নিয়েছে এক দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রে। সেই হাওরের জলরাশি আপাত শান্ত মনে হলেও, মাঝে মাঝেই তা ফুঁসে উঠছে অজানা আক্রোশে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে চেনা সীমানায়। সেই উত্তাল, প্রলয়ঙ্করী জলরাশির বুকে হঠাৎ দূরে জ্বলে উঠল অসংখ্য আলোর বিন্দু। যেন মেঘমুক্ত আকাশে জ্বলজ্বল করছে অজস্র নক্ষত্র। একটি বা দুটি নয়, সাত-সাতটি বিশাল 'ভাওয়ালি' নৌকার এক রাজকীয় বহর জল কেটে এগিয়ে আসছে।

গ্রামের মানুষ জানলার ফাঁক দিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখছে সেই দৃশ্য। এ সাধারণ কোনো নৌবহর নয়। মাঝখানের নৌকাটি দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। লম্বায় প্রায় নব্বই ফুট, চওড়ায় পঁচিশ ফুটেরও বেশি, যেন জলের ওপর ভাসমান এক প্রমোদভবন। এর গলুইতে পেতলের কারুকাজ করা মকরমুখ, যা ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় নদীর বুকে আগুনের মতো জ্বলছে।

মূল নৌকার দুই পাশে পাহারাদার হিসেবে চলছে আরও ছোট ছোট ছিপ নৌকা। একটি থেকে ভেসে আসছে রান্নার ঘ্রাণ। পোলাও আর কোরমার সুবাস হাওরের মিঠে বাতাসের সাথে মিশে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়াচ্ছে। অন্যটিতে বাজনাদারের দল তবলা, সারিন্দা, খটতাল আর লাউয়া নিয়ে প্রস্তুত। নৌকার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র বরকন্দাজ, তাদের হাতে বল্লম, কোমরে তলোয়ার।

এই সাত নৌকার বহর যার, তিনি এই জলমহালের মুকুটহীন একচ্ছত্র অধিপতি। তার হুকুম ছাড়া এই তল্লাটে গাছের পাতা নড়ে না, নদীর স্রোতও যেন তার ইশারার অপেক্ষায় থাকে।

বড় নৌকার অন্দরমহলে বাইরের বাতাসের কোন প্রবেশাধিকার নেই। মায়াবী এই নৌকার অন্দরে পারস্য দেশীয় নীল গালিচায় মোড়া মেঝে, ছাদ থেকে ঝুলছে বেলোয়ারি ঝাড়লণ্ঠন। মোমের স্নিগ্ধ আলোয় মখমলের পর্দাগুলো রক্তলাল দেখাচ্ছে। কামরার একপাশে রুপোর কাজ করা গড়গড়া থেকে ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ছে সুগন্ধি তামাকের ধোঁয়া।

কামরার ঠিক মাঝখানে, মখমলের তৈরি বিশাল ফরাশে আধশোয়া হয়ে আছেন সেই রহস্যময় পুরুষ। তাকে দেখলেই চোখ ফেরানো দায়। দীর্ঘকায় এই পুরুষসিংহের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চনের মতো লালচে ফর্সা, যা সচরাচর এই অঞ্চলের মানুষের দেখা যায় না। কাঁধ পর্যন্ত দুলছে ঘন কালো বাবরি চুল, মুখে মানানসই গোঁফ, যা তার আভিজাত্যকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ।

তার পরনের পোশাকেও রয়েছে আভিজাত্যের স্পষ্ট ছাপ। পায়ে ঢিলেঢালা মখমলের পাজামা, গায়ে বোতামহীন ত্রিকোণাকার গলার মিহি পাঞ্জাবি, আর তার ওপর জড়ানো চুমকির কাজ করা চোগা। মাথায় জরির কাজ করা পাগড়ি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন কোনো মুঘল শাহজাদা পথ ভুলে ভাটি বাংলায় এসে পড়েছেন।

সামনে বসে আছে লখনৌ থেকে আনা বাইজিদের দল। নূপুরের নিক্বণ আর সারেঙ্গীর সুরে কামরাটি বুঁদ হয়ে আছে। কিন্তু দেওয়ান সাহেব আজ গানে মন দিতে পারছেন না। তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা। তিনি উপরে হাত তুলতেই বাজনার শব্দ থেমে গিয়ে কামরার মধ্যে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। বাইরে ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ সেই নীরবতাকে মাঝে মাঝে ভেঙে দিচ্ছে।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। জানলার কাছে গিয়ে কালো জলের দিকে তাকালেন। "রাত কি অনেক হলো?" তিনি গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন।

তার খাস ভৃত্য, যে দরজার কাছে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল, বিনীতভাবে বলল, "জি হুজুর। দ্বিতীয় প্রহর শেষ হতে চলল।"

দেওয়ান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দিনের বেলা তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার। তার আস্তাবলে বাঁধা থাকে আরব আর পাঞ্জাব থেকে আনা তেজী সব ঘোড়া, যাদের নাম শুনলেই মানুষ সম্ভ্রম করে। জং বাহাদুর, চান্দ মুশকি, খোদাদাদ মুলকী, বাংলা বাহাদুর - কী তাদের নামের বাহার! কিছুদিন আগেই ঢাকার নবাবের সাথে বাজি ধরে তার দেশি ঘোড়া জং বাহাদুর হারিয়ে দিয়েছে নবাবের বিলাতি ওয়েলার ঘোড়াকে। সেই জয়ে তার দম্ভ আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি জানেন, তিনি হারতে শেখেননি।

কিন্তু রাতের বেলা? রাতের বেলা এই বিজয়ী পুরুষটি বড় একা। তার মনে হয়, এই যে বিশাল জমিদারি, এই যে সুনামগঞ্জ থেকে রামপাশা পর্যন্ত তার হুকুম চলে, এসব কি সত্য? নাকি সব ভেলকি?

তিনি বিড়বিড় করে বললেন, "সবই আছে, তবুও কিচ্ছু নাই। আমি আসলে কে? আমি কি এই মখমলের পোশাক, নাকি এর ভেতরে থাকা হাড়-মাংসের খাঁচাটা?"

তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল পাশের নৌকা থেকে আসা এক তীক্ষ্ণ চিৎকারে। পাখির ডাক। কর্কশ, কিন্তু বুনো। দেওয়ান সাহেবের মুখে এবার এক চিলতে হাসি ফুটল। শিকারি সত্তা জেগে উঠল মুহূর্তে। তিনি পাখিপাগল মানুষ। বিশেষ করে কোড়া পাখি তার জান।

কোড়া পাখিকে আভিজাত্যের পরিচায়ক হিসেবে দেখা হয়। তার সংগ্রহে রয়েছে শতাধিক পোষা কোড়া পাখি। এদের দেখাশোনার জন্যই তিনি বেতন দিয়ে রেখেছেন জনা বিশেক দাসী । এই পাখিদের যত্ন কোনো রাজপুত্রের চেয়ে কম হয় না। এদের স্নান করানো হয়, মাখানো হয় সুগন্ধি, খাওয়ানো হয় সেরা খাবার।

দেওয়ান সাহেব কখনো পাখি হত্যা করেন না। নিজস্ব পোষা কোড়া পাখি দিয়ে জংলী কোড়া শিকারেই তাঁর প্রবল নেশা। বর্ষাকালে দলবলসহ তিনি কোড়া শিকারে বেরিয়ে পড়েন। এজন্য আছে একদল নিপুণ কোড়া শিকারি, যারা কোড়া পাখিকে তালিম দিয়ে প্রস্তুত করে। জংলী কোড়ার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পোষা কোড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন কোড়াদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারি শুরু হয় এবং যখন উভয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন সুযোগমত শিকারি জংলী কোড়াকে ধরে ফেলে।

এভাবে তিনি দিনের পর দিন পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে বিশাল ভাওয়ালি নৌকায় থাকতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কেউ যদি তাঁকে ভালো কোড়া পাখি উপহার দেয়, তবে তা তিনি আহ্লাদের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং উপহারদাতাকে একটি নতুন লুঙ্গি বা ধুতি এবং চাদর, সঙ্গে কিছু টাকা পারিতোষিক হিসেবে দেন।

জলপ্লাবিত ধানক্ষেতে কোড়াপাখি বাসা বাঁধে। দেওয়ান সাহেব নিজেকে সবসময় ‘কোড়া বিশারদ’ ভাবেন। তাই তিনি গানের খাতায় লিখে রেখেছেন - কোড়ার গুণ যত আমি জানিয়াছি ভাই / আমার মত জানে লোক বেশি দেখি নাই।

তিনি ভৃত্যকে ডাকলেন। "শমশের! কাল ভোরে আমরা দেখার হাওরের দিকে যাব। আমার সেরা কোড়াটাকে তৈরি রাখবি। শুনলাম ছাতকের মির্জা সাহেব নাকি নতুন বুনো কোড়া ধরেছে। কাল দেখা যাবে কার পাখির জোর বেশি।”

ভৃত্য কুর্নিশ করে চলে গেল। দেওয়ান সাহেব আবার তাকিয়ায় বসলেন। তার মনে পড়ল, লোকে তাকে নিয়ে কত কথাই না বলে। কেউ বলে তিনি দয়ালু, কেউ বলে তিনি নিষ্ঠুর। কেউ বলে তিনি লম্পট, কেউ বলে আউলিয়া। তিনি হাসলেন। লোকে যা বলে বলুক। তিনি জানেন, তিনি কোনো ভান করেন না। যা করেন, প্রকাশ্যে করেন।

রাত আরও গভীর হতেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো। হাওরের আফালে নৌকোর দুলুনিও একটু বেড়েছে। দেওয়ান সাহেব কাগজ আর কলম টেনে নিলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, বড়জোর নিজের নাম দস্তখত করতে পারেন । কিন্তু তার বুকের ভেতর যে শব্দেরা খেলা করে, তা তো কোনো পুঁথিগত বিদ্যা নয়। তিনি যখন গান বাঁধেন, তখন তার কর্মচারীরা তা লিখে নেয় ।

তিনি নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলেন। সুর ভাঁজছেন। কোনো চেনা সুর নয়। এক বুনো, উদাস করা সুর - "খাঁচার ভেতর... না, খাঁচা নয়! পিঞ্জিরা! মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে….”

শব্দগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, তিনি এই সুসজ্জিত বজরার মালিক নন, তিনি আসলে এই বজরার এক বন্দি। তার আত্মাটা ছটফট করছে মুক্তির জন্য। যেমন ছটফট করে তার আদরের পোষা পাখিগুলো।

তিনি জানলার শিক ধরে বাইরে তাকালেন। ভৃত্যকে ইশারায় কামরার বাতি নিভিয়ে দিতে বললেন। বাতি নিভতেই কামরাজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো। দূরে কোনো জেলের নৌকায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে এই প্রতাপশালী জমিদার, যার ইশারায় বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়, তিনি হঠাৎ শিশুর মতো অসহায় বোধ করলেন।

তার মনে পড়ল তার বংশের ইতিহাসের কথা। তার ধমনীতে বইছে প্রাচীন আর্য রাজা বিজয় সিংহের রক্ত । তার প্রপিতামহ একসময় হিন্দু রাজা ছিলেন, পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই মিশ্র ঐতিহ্য তার রক্তে। তাই তিনি নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের খাঁচায় আটকাতে পারেন না। তিনি নিজেকে কেবল 'মানুষ' আর 'বাঙালি' ভাবতেই ভালোবাসেন।

হঠাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই আলোয় ক্ষণিকের জন্য দেওয়ান সাহেবের মুখটা দেখা গেল। খুব সুন্দর, কিন্তু বড়ই করুণ সেই মুখ।

জানালার পাশে বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে তিনি আবার শুলেন। কিন্তু ঘুম এল না। তার কানে বাজতে লাগল এক অদৃশ্য একতারার সুর। সেই সুর তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে আসার জন্য ডাকছে। কিন্তু তিনি যে শিকল পরে আছেন! সোনার শিকল।
হাওরের জল বয়ে চলে তার আপন গতিতে। আর তার বুকে ভাসমান এক মায়া-প্রাসাদে জেগে থাকেন এক রাজা, যিনি রাজত্ব করেন মাটিতে, কিন্তু যার মন পড়ে থাকে আসমানে।

[চলবে]

 

লেখক পরিচিতি: রিপন ঘোষ, সহকারী শিক্ষক (ভৌতবিজ্ঞান), ঢাকাদক্ষিণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, সিলেট। প্রকাশিত গ্রন্থ: কৃষ্ণচূড়ায় সিক্ত। এটি একটি গল্পগ্রন্থ। ২০২৩ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ‘সুজন পাবলিকেশন’ থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।

আপনার মন্তব্য