শহীদ কাদরী'র বৈঠকখানায়...

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-২৯ ০৯:৪৭:১২

 আপডেট: ২০১৬-০৮-২৯ ১৬:৪৯:৫১

আব্দুল করিম কিম:

রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে/ স্বাধীনতা দিবসের সাঁজোয়া বাহিনী/ রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে/ রেসকোর্সের কাঁটাতার, কারফিউ, ১৪৪ ধারা/ রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে/ ধাবমান খাকি জীপের পিছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি/ কাঠগড়া গরাদের সারি সারি খোপ/ কাতারে কাতারে রাজবন্দী/ রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট...

রাষ্ট্রের এই মানে জেনে প্রেম ও দ্রোহের কবি শহীদ কাদরী স্বদেশ থেকে দূরে মার্কিন মুলুকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন কাটান সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর। বাংলাদেশ থেকে দূরে চলে গেলেও বাংলা ভাষা নিয়েই মগ্ন ছিলেন তিনি। নিউইয়র্কে কবির স্পর্শে বাংলা কবিতার নতুন যাত্রা শুরু হয়। আজ সেই যাত্রা থমকে গেল কবি শহীদ কাদরী'র অকাল প্রয়াণে। কবি আর পৃথিবীতে নেই।

রোববার নিউ ইয়র্কের স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কবি মৃত্যুবরণ করেছেন। নিউইয়র্কে সময় তখন সকাল ৭টা।দীর্ঘদিন থেকেই কবি অসুস্থ। হুইল চেয়ারেই তাঁর চলাফেরা। ঘর থেকে সহজে কোথাও বের হতেন না। সপ্তাহে ৩ দিন এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যেতেন ডায়ালাইসেস ও থেরাপি নিতে। গত ২১ আগস্ট রোববার রাত সোয়া ৩টায় উচ্চ রক্তচাপ এবং জ্বর নিয়ে গুরুতর অসুস্থ কবিকে নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলা ভাষার বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কবির সঙ্গে আমার সামান্য কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। কবির বৈঠকখানায় কাটানো সেই সন্ধ্যার স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছি।

কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। অদ্ভুত এক বিদ্রোহের কবি শহীদ কাদরী কবিতায় অনবরত রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, আওয়াজ তুলেছেন বিদ্রোহের। কবি তাঁর কবিতায় নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়ন করে নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের এক মিথস্ক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন বাংলা কবিতায়। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের নিত্যদিনের সংগ্রামকে কবিতায় তুলে ধরেছিলেন। ৭০-এর দশকে বাংলা কবিতার উজ্জ্বল নক্ষত্র এ কবি হঠাৎ-ই স্বদেশ থেকে হারিয়ে যান। স্বদেশের প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি লন্ডন, জার্মানিসহ বিশ্বের বহু নগর ঘুরে ১৯৮৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসত গড়েন। ২০১১ সালে কবিকে একুশে পদক দেয়া হয়।

প্রায় এক যুগ ধরে শরীরে জটিল রোগ বাসা বাঁধায় চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে লেখালেখিতেই মেতে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছর গুলোতে লেখালেখিও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক ঘণ্টা বই পড়লে বা কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকলে তিন ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়। কবির এই স্বেচ্ছা-নির্বাসন জীবনের ছায়াসঙ্গি কবিপত্নী নীরা কাদরী। নীরা কাদরী'র আতিথেয়তায় কবিগৃহে প্রায় দিনই ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের আনাগোনা চলে। দেশ থেকে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাওয়া কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের নিয়মিত পদচারণায় কবির বৈঠকখানা নিয়মিত সরগরম। সেখানে অবিরাম আড্ডা হয়। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে দর্শন, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি নিয়ে চলা আড্ডার টানে অনেকেই ছুটে আসেন কবির কাছে। এমনই একজন সিলেটের নাট্য আন্দোলনের একসময়ের প্রাণকেন্দ্র প্রান্তিকের সদাহাস্য মুখ, আমার বন্ধু, বড় ভাই নাট্যকর্মী এজাজ আলম। কীভাবে যেন কবির শিষ্যত্ব পেয়ে যান।

এজাজ আলম যৌবনের মধুময় আড্ডার জীবন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। ২০১৫ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে নিউইয়র্কে এজাজ আলম-এর দেখা পাই। 'দয়াল গুরু' 'দয়াল গুরু' বলে সম্ভাষণ করে ১৪ বছর পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করি আমরা।
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম-এর প্রধান  শিষ্য বাউল রুহী ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই তিনি জোর হাতে সম্ভাষণ করতেন 'দয়াল গুরু দয়াল গুরু' বলে। সেই স্টাইল'টা আমাদের খুব পছন্দ ছিল।
আমরা দেখা হলেই পরস্পরকে 'দয়াল গুরু দয়াল গুরু' বলতাম।

এজাজ ভাইয়ের সাথে নানা গল্প ও স্মৃতিচারণ চলে। যুক্তরাষ্ট্র জীবনের গল্প বলতে গিয়ে এজাজ ভাই কবি শহীদ কাদরী'র কথা বললেন। তাঁর মুখেই শুনি কবিগৃহের আড্ডার কথা।

এজাজ ভাই বলেন, শহীদ ভাই ও ভাবী আছেন বলে নিউইয়র্কের এই যান্ত্রিক জীবনকে মানিয়ে নিয়েছি। অনেকটুকু পথ পাড়ি দিয়ে ব্রোঞ্চ থেকে কবির জ্যামাইকার বাসায় প্রায়ই ছুটে আসি। দেশ, কবিতা, সঙ্গীত, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে প্রাঞ্জল আড্ডা দেয়ার লোভে। কবি যে কোন আগন্তুককেই আপন করে নেন।

এজাজ ভাই পরের সপ্তাহে আমাকে কবিগৃহে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এজাজ ভাই এর মুখে কবি শহীদ কাদরী'র কথা শুনেই আমার মনে পরে যায় ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’। মনে পরে- বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/ মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,/ কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ/ প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...।

এজাজ ভাই পরের সপ্তাহে আমাকে কবির ঘরে নিয়ে গেলেন।

কবি শহীদ কাদরী দেখতে কেমন সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।  কবি দেখতে কেমন- সে সম্পর্কে মনে মনে ভেবে নিয়েছি।  
যে কবির কলম থেকে লেখা হয়-

"...অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-
বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ
কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত
চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-
ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।"

-সেই কবির মুখ ভর্তি দাঁড়ি থাকবে, শীর্ণকায় দেহে বাঙালিয়ানা থাকবে, কিছু সময় পরে পরেই ঠোঁট জ্বলবে সিগারেট।

কবির বৈঠকখানায় পৌঁছে দেখি আড্ডা জমে উঠছে মাত্র। কবির শুভানুধ্যায়ী চল্লিশোর্ধ চার নারী আর কবিপত্নী নীরা ভাবী আমাদের জন্য চা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন। এজাজ ভাই পথে থাকতেই ভাবীকে এসএমএস করেছিলেন। আমি চা খেতে খেতে পরিচিত হই। এজাজ ভাই আমাকে নানা বিশেষণযুক্ত করে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি কবি শহীদ কাদরী'র দিকে তাকিয়ে থাকি।

চা-বাগানের ম্যানেজারদের মত হাফপ্যান্ট পরে বিশাল দেহের কবি সোফায় শুয়ে আছেন। সোফার সামনের টেবিল ভর্তি নতুন কেনা বই। কবি আমার সাথে টুকটাক কথা বললেন। সিলেটের কথা জানতে চেয়ে জাফলঙ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বললাম, জাফলঙ-এর বর্তমান অবস্থা। সঙ্গে যুক্ত করলাম, জাফলঙে এখন কেউ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যায় না, দেখতে যায় প্রকৃতিকে মানুষ কীভাবে ধ্বংস করেছে তা দেখতে।

আমার কথার সূত্র ধরে নীরা ভাবী বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে স্বগক্তি করেন।

বাংলাদেশ যে মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয় এমন কথা বলা শুরু করতেই দেখি কবি ক্ষেপে ওঠেন।

শোয়া থেকে বসার চেষ্টা করেন। তাঁকে এজাজ ভাই ধরে বসান।

কবি উত্তেজিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে কি পরিমাণ ধর্ষণ হয় আর বাংলাদেশে কি পরিমাণ হয় তা তুলনা করেন। কবির ভাষ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে খারাপ অবস্থাতে নাই। বাংলাদেশ অনেক ভালো।

ভাবীর ভাষ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সব দিক থেকেই খারাপ।

দু'জন উত্তেজনায় বাংলা থেকে ইংরেজিতে তর্ক শুরু করলেন।

এজাজ ভাই আমাকে ইশারা দিয়ে বোঝালেন সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব স্বাভাবিক বিষয়। কিছু সময় নিরবতার পর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কবির উত্তেজিত প্রতিবাদ দেখে আমি বুঝতে পারলাম প্রায় চার দশক থেকে দেশের বাইরে থাকলেও কবির অন্তর জুড়ে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হলেও কবি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নাই। শুধুমাত্র গ্রিন কার্ড নিয়েছিলেন।

গ্রিন কার্ড গ্রহণ করলেও সিটিজেনশিপ কেন নেননি জানতে চাইলে শহীদ কাদরী বলেছিলেন ‘মাই ডিগনিটি ইজ বাংলাদেশ; আই ক্যান্নট ডু দিস’ (আমার মর্যাদা হচ্ছে বাংলাদেশ, তাই আমি এটি গ্রহণ করতে পারি না)। কারণ, আমি আমার দেশ ও মাটির গন্ধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। সিটিজেনশিপ পেলে আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পেতাম; তা করিনি। তাঁর বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছিল।

এজাজ ভাই পঞ্চমুখে প্রশংসা করার কারণে আমাকে গান গাইতে হয়।

কবিতা লেখার অভ্যেস আছে এটা বলে এজাজ ভাই আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করলেও শহীদ কাদরীকে কবিতা শোনানোর দুঃসাহস আমি দেখাই নাই। তবে আমার লেখা কিছু প্রবচন শুনিয়েছিলাম। সেই প্রবচনের সূত্র ধরে আরও কিছু সময় আড্ডা চলে। একটা সময় আমার নিজের তাড়া থাকায় বিদায় নিতে হয়।

কবি ও কবিপত্নী দেশে ফেরার পূর্বে আরেকবার আড্ডায় যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ করেন। কথা দেই আবার আসবো বলে।

কথা রাখা আর হয় না। দেশে ফিরে আসি।

২০১৬ সালের ২২ মে  মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য আবার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া হয়। সকালে নিউইয়র্কে জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরে পৌঁছে ফোনে কথা হয় দৈনিক প্রথম আলো'র নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আমার চাচাতো ভাই ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন-এর সাথে। তাঁর থেকে জানতে পারি  মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত তিন দিনব্যাপী (২০-২২ মে) আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা আজ শেষ হচ্ছে।

বিকেলেই জ্যাকসন হাইটসস্থ পিএস-৬৯ স্কুলে অনুষ্ঠিত বইমেলা দেখতে যাই। সেখানেই আবার কবির সাথে দেখা হয়ে যায়। হুইল চেয়ারে বসা কবিকে দেখে শারীরিক অবস্থার যে অবনতি হয়েছে তা বুঝতে পারি।

কবির হুইল চেয়ার ঠেলছিলেন এজাজ ভাই। কবিকে আমার কথা মনে করিয়ে দিলেও তিনি আমাকে মনে করতে পারেন নাই।

নীরা ভাবী চিনতে পারেন। বলেন, তোমার-তো আরেকদিন আমাদের বাসায় আসার কথা ছিল।

আমি লজ্জিত ভাবে বলি, ভাবী সম্ভব হয় নাই। তবে এবার যাবো। কিন্তু আমার আর কবির বৈঠকখানায় যাওয়া হয় নাই।

আপনার মন্তব্য